Thursday, March 10, 2022

এরকম খবর করলে মন শান্তি পায়




ন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসের সকালে কোয়েল একটা ফেসবুক পোস্ট দেখাল। এক বৃদ্ধা নবান্নের  কাছেই কংক্রিটের ওপরে পথের ধুলোয় পড়ে রয়েছেন। ছবিটা দেখে মনে হল এটা নিউজ মেটিরিয়াল। এক অশক্ত বৃদ্ধা। চোখ গুলো কেমন করুন। অফিসে যাবার জন্য বাইক স্টার্ট দেওয়ার আগে রক্তিমকে জানালাম বিষয়টা।

- এটা করে তবে অফিস এসো। কী বিষয় পুরোটা দেখো। এটাই স্টোরি। 

দেখা শুরু হল আমার। 

তার পরবর্তী গল্প সবার জানা। সে গল্পের অবতারনা এখানে নয়। 

 সে গল্প দেখুন এখানে

আমাদের কাছে সেই খবর পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়। পথ ভোলা পথিক নাকি সন্তান পরিত্যক্তা? প্রশ্ন উঠেছিল হাওড়ার শিবপুর, মন্দিরতলা এবং নবান্ন অঞ্চল জুড়ে মানুষের মধ্যে। মঙ্গলবার রাত্রেই মন্দিরতলার একজন বললেন- পুলিশ নিয়ে গেছেন ওই বৃদ্ধাকে। 

বুধবার সকাল সকাল ফোন করলাম হাওড়া সিটি পুলিশের শিবপুর থানার ওসি অরূপ বাবুকে। তিনি জানালেন সুরক্ষিত আছেন ওই বৃদ্ধা। এখন ভর্তি রয়েছেন হাওড়া জেলা সদর হাসপাতালে।

বুধবার বেলা ১১টা-  হাওড়া জেলা সদর হাসপাতালে নবান্নের ফুটপাথে পড়ে থাকা মাকে। একটা বিছানা জুটেছে তাঁর। আর পথ নয়। ঘুমোচ্ছেন অনেকটা স্বস্তিতে। বৃদ্ধা এখনও নিজের পরিচয় ঠিকঠাক জানাতে পারছেন না চিকিৎসক ও চিকিৎসা কর্মীদের। ফিমেল মেডিক্যাল ওয়ার্ডের খাতায় উনি ‘আন নেমড’। আপাতত পরিচয় একটাই - বেড নম্বর এক্স ৬৫। 

চরম ব্যস্ততা ডাক্তার বাবুদের। একজন পেসেন্ট ঢুকেছেন। পয়জনড কেস। তাঁর স্টম্যাক ওয়াশ পর্ব চলছে। তার মধ্যেই একজন চিকিৎসক জানালেন কেউ একজন এসেছিলেন যিনি ওনাকে নিজের মা বলে দাবি করেছেন। ওয়ার্ড থেকে বলা হয়েছে ওই ব্যাক্তিকে নিজের পরিচয় পত্র এবং প্রমাণাদি এনে যোগাযোগ করতে। হাসপাতাল সুপার ডাঃ নারায়ণ চট্টোপাধ্যায় এর সঙ্গে কথা বললাম। অনুরোধ করলাম যদি কেউ আসেন একবার যেন আমায় জানানো হয়। আর একবার গেলাম বেড নম্বর এক্স ৬৫ র কাছে। তখন তিনি  ডাল, সয়াবিনের তরকারী আর মাছের ঝোল দিয়ে পরম তৃপ্তিতে ভাত মেখে খাচ্ছেন।  

শিবপুর থানায় গেলাম। তারপর ওই নীল সাদা থাম। নবান্নের কাছে। যে স্তম্ভগুলির নীচে হতভম্বের মত বসে ছিলেন ওই বৃদ্ধা। 

বিকেল গড়াতে না গড়াতেই ফোন ঢুকল ডাঃ নারায়ণ চট্টোপাধ্যায় এর। বেড নম্বর এক্স ৬৫ র বাড়ির লোক এসেছেন। জানালাম আমি আসছি ওঁদের একটু অপেক্ষা করতে বলুন। 

তারপর এল বৃদ্ধার ছেলের ফোন। ওনারা আমি গেলে আমার সঙ্গে কথা বলে তবেই মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। 

সন্ধ্যা নেমেছে হাওড়া সদর হাসপাতাল চত্বরে। জানা গেল পরিচয়। দুই ছেলে এসেছেন মা কে নিয়ে যেতে। ৭ মার্চ থেকে মা নিখোঁজ। বড় ছেলে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করেন। ৭ তারিখ সকালে একটু দেরিতে ফিরেছেন। ছোট ছেলের রঙিন মাছের ছোট্ট ব্যবসা। কাজের জন্য তাঁকেও বেরোতে হয়েছে। বড় ভাই বাড়ি ফেরার আগেই বেরিয়ে যান ছোট ভাই। দুই ভাই আর মায়ের সংসার। তাই ওই সময়ে মা একলাই ছিলেন। মানসিক অবস্থা বয়সের কারণে একটু বিঘ্নিত। কানে কম শোনেন।

বাড়ি খালি দেখে মা বেরিয়ে পড়েন বাড়ি থেকে। নিরুদ্দিষ্টের গন্তব্যে। তারপর হন্যে হয়ে দুই ভাই মা কে খুঁজেছেন। ব্যাটরা থানায় মিসিং ডায়েরিও করেছেন। খুঁজে পান নি মাকে। 

তারপর আমদের ওই প্রতিবেদন। তা দেখে বৃদ্ধার ছোট ছেলেকে জানান তাঁর এক বন্ধু - মা রয়েছেন নবান্নের ফুটপাথে। 

ছেলে আসেন নবান্নের সামনের পুলিশ আউটপোস্টে। সেখান থেকে শিবপুর থানা হয়ে সদর হাসপাতালে।

খুঁজে পান মাকে। পুরো প্রক্রিয়াটায় আমরা রয়ে গেলাম একটা ছোট্ট যোগসূত্র হয়ে। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিলেন ছেলেরা। জানতে চাইলাম বৃদ্ধার পরিচয়। ওঁদের বাবা প্রয়াত সুভাষ চন্দ্র বোস। আর মা?

বেড নম্বর এক্স ৬৫ নয়। অনিলা। অনিলা বোস। 

ওঁরা তিন জন ধীরে ধীরে হেঁটে বেরিয়ে আসছেন। ছোট ছেলে সুশান্তকে জিজ্ঞাসা করলাম

- কিসে নিয়ে যাবেন মাকে? টোটো ডেকে দেব? 

-না দাদা বাসেই যাব। টোটো আশি টাকা চাইছে। অত টাকা কোথায়! বাসে যাব, একটু তো পথ। পৌঁছে যাব। 

তিনজন, অ্যাম্বার রঙের পথে মৃদু হেঁটে যাচ্ছেন, নীল রঙের আলোয় লেখা হাওড়া জেলা হাসপাতালের গ্লোসাইনটা জ্বলজ্বল করছে। বাড়ি ফিরছেন যিনি, উনি অনিলা। 

দেখুন বাড়ি ফেরার ভিডিও

No comments: