কলকাতার চিকিৎসাশাস্ত্রের ইতিহাসে ২০শে অগস্ট দিনটি বিশেষ। ১৮৯৭ এর ২০শে অগাস্ট স্যার রোনাল্ড রস স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশার পৌষ্টিকতন্ত্রে ম্যালেরিয়ার জীবাণু আবিস্কার করেন। প্রথমবার প্রমাণিত হয় মানুষের ম্যালেরিয়া রোগের বাহক মশা। এই আবিস্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানে যুগান্তকারী।
তৎকালীন প্রেসিডেন্সি জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক হিসাবে রোনাল্ড রস তখন কলকাতায়। এখানেই তিনি কাজ করেন ম্যালেরিয়া সম্পর্কে তাঁর যুগান্তকারী আবিস্কার নিয়ে। বর্তমানে সেই হাসপাতালকে আমরা এসএসকেএম হাসপাতাল নামে চিনি।
পরিসংখ্যান বলছে প্রতি বছর প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এই কারণে মশা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাণঘাতী প্রাণী। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জি়কা'র মতো মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত পৃথিবীর প্রায় ১০০টি দেশ।
বিজ্ঞানিরা বলেন প্রাণীদেহ থেকে নির্গত কার্বনডাই অক্সাইড,গন্ধ ও তাপমাত্রা মশাকে মানুষের প্রতি আকৃষ্ট করে। কেবল স্ত্রী মশাই প্রাণীদেহ থেকে রক্ত খেয়ে থাকে। আর এই রক্ত মশার বংশবিস্তারের জন্য ডিম তৈরিতে প্রোটিনের উৎস হিসেবে কাজে লাগে। পুরুষ মশারা মানুষকে কামড়ায় না,তারা উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে রস সংগ্রহ করে।
আচ্ছা কখনও ভেবে দেখেছেন যে মশার কারণে আমাদের এত রোগভোগ এই পৃথিবীতে যদি সেই মশাই না থাকত তাহলে কেমন হত? কখনও ভেবে দেখেছেন মশার কি কোনও উপকারিতা আছে? আসলে প্রকৃতির কোনও সৃষ্টিই হেলাফেলার নয়। প্রত্যেকের নিজস্ব কাজ আছে। মশার ও নির্দিষ্ট কাজ রয়েছে।
পৃথিবীতে ৩৫০০টি প্রজাতির মশা আছে তাদের মধ্যে প্রায় ৩৪০০ প্রজাতির মশা কোনো ক্ষতি করে না। মাত্র ৯০টির থেকে একটু বেশি সংখ্যক প্রজাতির মশা মানুষের জন্য বিপজ্জনক। বাকিরা কোনও অনিষ্ট করে না।
বরং তারা পৃথিবীর খাদ্য-শৃঙ্খলে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। কিছু মাকড়সা, টিকটিকি, গিরগিটি, ব্যাঙের মুখ্য খাদ্য মশা। এছাড়া মশার ডিম মাছের খাবার। তাই মাছের খাদ্য চাহিদা মেটাতেও বিশেষ ভূমিকা রাখে মশা। যখন মশা উড়ন্ত অবস্থায় থাকে তখন ফড়িং,ছোট ছোট পাখি ও কীটপতঙ্গ মশা খেয়ে জীবনধারণ করে।
মশা একটি ইনডিকেটর স্পেসিজ। একটি বাস্তুতন্ত্রে মশা থাকা মানে সেখানকার পরিবেশের মাপকাঠিগুলি যেমন তাপমাত্রা,আর্দ্রতা ও জলের মান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়
ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণায় জানা গেছে 'পুরুষ মশা ফুলের মধু খায়, যা পরাগ মিলনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। পৃথিবী থেকে যদি মশা বিলুপ্ত হয়,তাহলে বহু খাদ্য-শৃঙ্খলের উপর তার সরাসরি প্রভাব পড়বে।’ আর একদল গবেষক বলছেন,মশার যায়গায় অন্য পতঙ্গ পরাগ মিলন করলেও মশার প্রতিস্থাপক পতঙ্গটি মশার চেয়েও ভয়ঙ্কর এবং দ্রুতগতিতে রোগ বিস্তার করবে।’
মশা না থাকলে পাখির সংখ্যা ব্যাপক হারে কমবে। অনেক কীট-তাত্ত্বিকদের মতে, মশার কারণে গ্রীষ্মমন্ডলীয় জঙ্গল এলাকায় মানুষ বসবাস করতে পারে না। সেসব অঞ্চলে মশা না থাকলে মানুষ আরও অনেক বেশি গাছপালা কেটে বন উজাড় করে বসতি স্থাপন করত। অনেক বেশি পরিমাণ মশার বসবাস উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে। প্রতি বছর যে পরিমাণ পরিযায়ী পাখিরা এখানে আসে তাদের মূল খাদ্য হচ্ছে মশা। তাই যদি মশা-ই না থাকে, তাহলে প্রায় ৫০ শতাংশ পরিযায়ী পাখি আর দুই মেরুতে আসবে না। ফলে সেখানকার পরিবেশ বদলাতে শুরু করবে। তাছাড়া ভিনদেশ থেকেও বছরের নানা সময় লক্ষাধিক তৃণভোজী পশু এই অংশে মাইগ্রেট হয়ে থাকে। মশার কামড় থেকে বাঁচতে যে জায়গায় মশার ঝাঁক বেশি থাকে, সে জায়গা এড়িয়ে অন্য পথ বেছে নেয় এই তৃণভোজী প্রাণীরা। হঠাৎ যদি কোনো বছর এই মশার ঝাঁক না থাকে, তাহলে কোন দিকে যেতে হবে, তা তারা বুঝতে পারবে না। ফলে রাস্তা হারিয়ে গণহারে সবাই মারা যাবে। আর এরা এত সংখ্যায় তৃণভোজী মারা গেলে অন্যান্য মাংসাশী প্রাণীদের খাদ্য সংকট হবে। তাছাড়াও এদের মলে থাকা বীজের কারণে যে গাছ জন্মায় তাও বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে।
এই বিষয়ের ওপরে আমার তৈরি একটি ভিডিও দেখুন। লিঙ্ক দিচ্ছি।
https://youtu.be/kWudaJV9_i4?si=RIuc1UDJuFAe4b_O
No comments:
Post a Comment