দোলের সকাল। কেমন আর পাঁচটা দিনের সকালের মতো। কাল ন্যাড়া পোড়া হয়েছে, মেয়ের বন্ধুদের খুব মজা হয়েছে। ওরা ন্যাড়া পোড়ার আগুনে পোড়ানো আলু খেয়েছে কাল।
মানুষ আজকাল বড্ড কন্ট্রোলড লাইফ লিড করতে অভ্যস্ত। কেবল বড়রাই না ছোটরাও! জল রঙে অ্যালার্জি। আবিরে কেমিক্যাল শুনেই ওরাও বড় হচ্ছে। আমাদের ছেলেবেলা অন্যরকম ছিল। হাতের রং থাকত প্রায় ১ সপ্তাহ। দোলের এক সপ্তাহ আগে থেকে ঢোল, নাল, খঞ্জনি নিয়ে গান হতো। মনন দা বলে এক বিহারী দাদা ছিলেন গানের দলের পাণ্ডা। শিব মন্দির সংলগ্ন চাতালে গান হতো, প্রতি সন্ধ্যেয়। আমি তবলা বাজাতে পারতাম বলে গানের দলে ডাক পড়ত, নাল বাজাতে। একদিন খোলও বাজিয়েছিলাম। কি আনন্দ! কি মজা!
এই সেদিন প্রবীণ অভিনেতা সুমন্ত্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে এসব স্মৃতির ভাঁড়ার খুলে গেল। আসলে দোলের দিনে যখন রঙের ফোয়ারা ছোটে, আবির, গুলাল ওড়ে তখন স্মৃতিরা ভিড় করে আসে। আমদের ছোট্ট রেল কলোনিতে একজন আসতেন। খাসির মাংস বিক্রেতা। এক হাতে একটা ব্যাগ আর একটা সাদা কাগজ কলম, অন্য হাতে দড়ি বাঁধা একটা ছাগল। বাড়ি বাড়ি ঘুরে কে কত মাংস নেবেন তার লিস্ট করতেন। লিস্টের মাংসের ওজন খাসির ওজনের কাছাকাছি এলেই একটা গাছের তলায় খাসি কাটা হতো। সে কি মজার বিষয়! সুমন্ত্রবাবুও বলছিলেন তাঁর যৌবনের স্মৃতি। বিহারী ফাগুয়ার গান হতো তাঁর বাড়ির চত্বরে। এখন সে সব দিন ম্রিয়মাণ হতে হতে হারিয়ে গেছে। সব সেলিব্রেশন ডিজিটাল মাধ্যমে সারা! তবে স্টার জলসার কথা সিরিয়ালের দোলের শুটিংয়ে সেই পুরনো পাড়া কালচারের ফিল পেলাম।
অথচ আমাদের এই কলকাতা শহরেই এখনও কিছু অঞ্চলে কিছু মানুষ আগলে রেখেছেন কিছু পরম্পরা। যেমন আপনি যদি উত্তর কলকাতার দিকে কলেজ স্ট্রিট, বৌবাজার অঞ্চলে যান এই দোলের সময়ে পাবেন এক বিশেষ মিষ্টি, ঘি পোয়া। চাল গুঁড়ো, গুড় আর আরও সব উপাদান দিয়ে মণ্ড মেখে তা ঘিয়ে ভাজা হয়। এই মিষ্টি ছাড়া দোল আর পঞ্চম দোল ভাবা যায় না ওই অঞ্চলে।
এইরকমই এক অতীত পরম্পরার খোঁজ পেলাম রাজস্থানের জয়পুরে।
গুলাল গোটা। লাক্ষার ফোলানো বলের ভিতরে আবির বা গুলাল দিয়ে বানানো হয়। রাজস্থান ঘোরা থাকলেও হোলির এই কালচার জানেন না অনেকেই। প্রথমে গালা বা লাক্ষার মণ্ড আগুনের তাপে গলানো হয়। তারপর ওই গলে যাওয়া মণ্ড একটি ছোট্ট পাইপের মতো ফাঁপা কাঠির আগায় লাগানো হয়। ওই পাইপকে বলা হয় ফুকনি। মুখ দিয়ে ফুকনিতে হাওয়া ভরে ফোলানো হয় গুলাল গোটা। সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডা জলের গামলাতে ভাসিয়ে দেওয়া হয় গোটা। যাতে তা ঠাণ্ডায় শক্ত হয়ে ওঠে। যে রঙের গোটা সেই রঙের আবির বা গুলাল ভরে কাগজ ও আঠা দিয়ে সিল করে দেওয়া হয় গোটা। প্রায় ২৯৮ বছর ধরে জয়পুরের রাজ পরিবারের আনুকুল্যে মণিহারো কা রাস্তায় হাতে গোনা কিছু মুসলিম পরিবার তৈরি করে চলেছেন এই গুলাল গোটা।
ভারতের গোলাপি শহর, রাজস্থানের জয়পুরের নাম মহারাজা সোয়াই জয় সিংহের নামে। মাত্র ১১ বছর বয়সে পিতা মহারাজা বিষণ সিংহের মৃত্যুর পরে সিংহাসনে বসেন জয় সিংহ। ১৭২৭ সালে রাজস্থানের রাজধানী আমের থেকে জয়পুরে স্থানান্তরিত করেন তিনি। জলের প্রাচুর্য আর পরিকল্পিত শহর তৈরি এই দুই বিষয় মাথায় রেখে গড়ে ওঠে জয়পুর। ভারতের প্রথম পরিকল্পিত শহর। এই শহরের নামের সঙ্গে অমর হয়ে আছেন এক বঙ্গ সন্তান, এক বাঙালি বাস্তুকার। তিনি নৈহাটির বিদ্যাধর ভট্টাচার্য। জয়পুর শহরের নির্মাণের দায়িত্বভার তাঁর হাতেই দেন মহারাজা সোয়াই জয় সিংহ। শিল্পশাস্ত্র ও বাস্তুশাস্ত্রের নিপুন মিশেলে বিদ্যাধর ভট্টাচার্য তৈরি করেন অতীত ভারতের অন্যতম প্ল্যানড সিটি জয়পুর।
No comments:
Post a Comment