কথায় বলে গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। আজ ঐ ওপরের মানুষগুলোর কথা আমাদের স্মরণে নেই। অথচ বাংলা ভাষার জন্য ওনাদের অবদান কিংবা ১৯শে মে এর গুরুত্ব ২১ শে ফেব্রুয়ারি র চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এগার জন ভাষা শহীদের আত্মবলিদান আজ প্রায় বিস্মৃত, বাঙালি। বাঙালি বলতে আমি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের কথা বলছি। যাঁরা ২১শের সকালে ফেসবুক টুইটার হোয়াটস্যাপে পারলে হ্যাপি ভাষা দিবস মেসেজ পাঠাতেও কার্পণ্য করেন না। শুভ ভাষা দিবস তো মুড়ি মুড়কির মত ছড়িয়ে পড়ে সাইবার মঞ্চে। ভাষা শহীদ দের সাথে 'শুভ' শব্দটা যায় ! আহ বাঙালি ! বাহ বাঙালি ! কেন কী বলা বাঙালি ! অনেকই খুশি হলাম বলা বাঙালি ! খুব কষ্ট হয় যখন ভাবি এই ভাষাটার, উচ্চারণের অধিকার চেয়ে বুলেটের সামনে বুক পাততেও কার্পণ্য করেন নি কিছু মানুষ।কাঁটাতারের দুই পারের বাঙালি, বাংলা ভাষার অভিমানে জীবন বিসর্জন করতেও পিছপা হন নি। ইতিহাস সাক্ষী রেখেছে গরম সীসের আর রক্তে ভেসে যাওয়া জন্মভূমির। জন্মদাত্রী মা , ভাষাও তো মা। ভাষা আবার সেতুও। কিন্তু সেই ভাষা যখন রাজনীতির বিষয় তখনই ঘটে বিপত্তি।
৬০ এর দশকে আসামের বরাক উপত্যকায় বসবাসকারী বাঙালির সংখ্যা অসমের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ ছিল। সেই বরাক উপত্যকার জনসাধারণের ওপর অসমীয়া ভাষাকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী। ১০ অক্টোবর, ১৯৬০ সালের সেই সময়ের অসমের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা অসমীয়াকে আসামের একমাত্র সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। উত্তর করিমগঞ্জ-এর বিধায়ক রণেন্দ্রমোহন দাস এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু ২৪ অক্টোবর প্রস্তাবটি বিধানসভায় গৃহীত হয়।
নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার তাগিদেই তারা অসমীয়কে সরকারী ভাষা মেনে নিয়ে বাংলা ভাষাকে পাশাপাশি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন শুরু করেন ওই এলাকার বাঙালিরা । অন্য ভাষাভাষী গোষ্ঠীও বাঙালিদের এই আন্দোলনকে সমর্থন করে। বরাক তীরের বাঙালীরা দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করে যে কোন মূল্যে বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার। আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। অসমের খাসিয়া, গারো, বোরো, মিশামী, ডিমসা, মণিপুরী, বিষ্ণুপ্রিয়াসহ সংখ্যালঘু প্রায় জনগোষ্ঠীই এতে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন প্রদান করে। এতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। অসমীয়া উত্তেজিত জনতা বাঙালি অভিবাসীদের আক্রমণ করে। জুলাই ও সেপ্টেম্বরে সহিংসতা যখন উচ্চ রূপ নেয়, তখন প্রায় ৫০,০০০ বাঙালি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যায়। আরো ৯০,০০০ বাঙালি বরাক উপত্যকা ও উত্তর-পূর্বের অন্যত্র পালিয়ে যায়।গোপাল মেহরোত্রার নেতৃত্বে এক ব্যক্তির একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কামরূপ জেলার গোরেশ্বর অঞ্চলের ২৫টি গ্রামের ৪,০১৯টি কুঁড়েঘর এবং ৫৮টি বাড়ি ধ্বংস ও আক্রমণ করা হয়; এই জেলা ছিল সহিংসতার সবচেয়ে আক্রান্ত এলাকা।
এই অন্যায়ের প্রতিবাদে বরাক উপত্যকায় তৈরী হয় কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ , ১৯৬১ র ৫ ই ফেব্রুয়ারি। ২৪শে এপ্রিল থেকে ২রা মে অসমের ২০০ মাইল ব্যাপী একটি পদযাত্রার আয়োজন করে ওই পরিষদ। গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার চালাতে থাকেন পরিষদের যুবকরা । পদযাত্রার শেষে পরিষদের মুখ্যাধিকারী রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেছিলেন যে, যদি ১৩ এপ্রিল,১৯৬১ সালের ভিতর বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা না হয়, ১৯ মে তে তাঁরা ব্যাপক হরতাল করবেন। ১২ মে তে অসম রাইফেল, মাদ্রাজ রেজিমেন্ট ও কেন্দ্রীয় সংরক্ষিত পুলিশ বাহিনী শিলচরে ফ্ল্যাগ মার্চ করেছিল। ১৮ মে তে অসম পুলিশ আন্দোলনের নেতা নলিনীকান্ত দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন ও বিধুভূষণ চৌধুরী (সাপ্তাহিক যুগশক্তির সম্পাদক) কে গ্রেপ্তার করে। এছাড়াও গ্রেফতার হন ছাত্রনেতা নিশীথরঞ্জন দাস| ভাষা আন্দোলনের ডাক গোটা কাছাড়ের চেহারা পাল্টে দিয়েছিল | তাই এ গ্রেফতারে প্রত্যেকটি জনপদ গ্রাম যেন বিক্ষোভে আরও ফুঁসে উঠল। সহস্র বলিষ্ঠ কণ্ঠে আওয়াজ উঠল মাতৃভাষা-জিন্দাবাদ। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য গোটা কাছাড় প্রস্তুত হয়ে রইল।
শিলচর ,করিমগঞ্জ , হাইলাকান্দিতে ব্যাপক হরতাল ও পিকেটিং শুরু হয় ১৯শে মে ১৯৬১র সকাল থেকে। স্থির করা হয়েছিল বিকেল চারটের ট্রেনটি চলে যাওয়ার পর উঠবে হরতাল ও পিকেটিং। সকাল থেকে একটিও টিকিট বিক্রি হয় নি তখনকার তারাপুর, বর্তমানের শিলচর স্টেশনে। বিমান বন্দরের রানওয়ে তে শুয়ে পড়ে সত্যাগ্রহীরা , অফিসের সামনেও পিকেটিং করেন তাঁরা। জারি হয় ১৪৪ ধারা।
দুপুর আড়াইটে- কাটিগোরার কাছে ৯ জন আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করে একটি ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়ার সময় তারাপুর স্টেশনের পিকেটিংকারীদের তীব্র অবরোধের মুখে পড়ে ওই ট্রাকটি। ভয় পেয়ে ড্রাইভার ট্রাকটি নিয়ে পালতে গেলে অজ্ঞাতপরিচয় কেউ ট্রাকটিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। আগুন নিয়ন্ত্রণ করে দমকল। এরপর দমন ও উৎপীড়ন চরমে ওঠে।
দুপুর ২টো ৩৫- প্যারামিলিটারী বাহিনী লাইনে শুয়ে থাকা ও স্টেশনে অবরোধকারীদের বন্দুক ও লাঠি দিয়ে মারা শুরু করে. এরই মধ্যে চলে গুলি। সাত মিনিটে ফায়ার হয় সতেরটি বুলেট, আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে। বারো জনের দেহে লাগে গুলি। ঘটনাস্থলেই মারা যান ৯ জন। ২জন বীরেন্দ্র সূত্রধর ও সত্যেন্দ্র দেব পরে. ২১শে মে মারা যান। সারা বিশ্বের ভাষা আন্দোলনের একমাত্র নারী শহীদ কমলা ভট্টাচার্য তখন সবে মাধ্যমিক দিয়েছেন , রেজাল্ট প্রকাশিত হয় নি। ষোল বছরের তরুণীর ডান চোখের তলা দিয়ে মাথা ফুঁড়ে দেয় একটি বুলেট।
২০শে মে শিলচরের জনগণ ভাষা শহীদদের শবদেহ নিয়ে শোকমিছিল করেন আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনের ঝাঁঝে সরকারী ঘোষণা আসে। বরাক উপত্যকার ভাষা হিসেবে বাংলা সরকারী স্বীকৃতি পায়।
ছাত্র সমাজের ডাকা এক আন্দোলন গণঅভ্যূথানের চেহারা নেয় শুধুমাত্র ভাষার অভিমানে। আজ তাই মূল্যায়নের সময় এসেছে আমাদের মাতৃভাষার কারণে যাঁরা প্রাণ দিলেন তাঁদের কথা আলোচনার তাঁদের জানার সময় এসেছে।
সবাই ভাল থাকবেন।
আজকের এই লেখাটা শেষ করব আমার খুব প্রিয় দুজনের কথা বলে। প্রান্তিক দেব আর পিয়ালী দাস আমার স্নেহভাজন দুজন , এই ছেলে মেয়ে দুটি নতুন ব্লগ শুরু করেছে। বড় ভাল লেখে ওরা। আমার মতন আবোল তাবোল নয়। ওদের ব্লগে একবার করে বেরিয়ে আসবেন। ভাল লাগবে।
প্রান্তিকের ব্লগ My Travel And Pictures
পিয়ালীর ব্লগ
Piyali's Talk (যাঁরা পিয়ালীকে চেনেন আমি জানি তাঁরা পিয়ালীর ব্লগের নামটার শেষে লিখতে চাইবেন that continues )
আর আমাদের পরিবেশ ও প্রকৃতি সংক্রান্ত আমার পেজ Mother Nature আর আমার শ্যুট করা পাখি সাপ ও অন্যান্য ভিডিও দেখতে চলে আসুন মাদার নেচারের এই চ্যানেলে
2 comments:
Assam er ekjon bangali hisebe nijer porichoi dite valo e lage...karon tar itihas ta bes somriddho..thank you Nandan da...ei samridho itihas take tomar lekhay rup dewar jonno.
Vule jaoa itihaas ke evabe tule dhorar janyo anek dhonyobad. Sob bangalir Jana uchit
Post a Comment