Monday, September 21, 2020

কেন নিজের গান গাইতে পারছেন না শিলাজিৎ? কারা বাধা দিচ্ছে?

 ভাবুন তো 

বব ডিলান "ব্লোয়িং ইন দ্য উইণ্ডস" গাইতে গেলে কারও অনুমতি নিচ্ছেন, "মে আই সিং মাই সং?"
বা রজার ওয়াটার্স কিংবা মাইকেল জ্যাকসন অনুমতি নিচ্ছেন " মে আই? সিং?"
বা সলিল চৌধুরী হারমোনিয়ামের বেলো টেনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন একটা অনুমতির, তবেই তিনি গাইবেন "ও আলোর পথযাত্রী এ যে রাত্রি এখানে থেমো না।"
বা আয়ুব বাচ্চু, বা আবিদা পরভিন, বা চিস্তি বাউল, বা এ আর রহমন বা... আরও অনেক সপ্তসুরের সারথিরা অনুমতি নিচ্ছেন? "আমি কি আমার গান গাইতে পারি?????? মহাশয়, মহাশয়া"

কী ভাবছেন ভুল বকছি? একদমই নয় এমনটাই হচ্ছে। । এই শহরেই হচ্ছে। ঘোরতর ভাবে হচ্ছে, প্রতিনিয়ত, রোজ হচ্ছে।

যার সঙ্গে হচ্ছে তাঁর পাঁজরে আলপিন বিঁধে যাওয়ার মত যন্ত্রণা নিঃশব্দে রক্ত ক্ষরণ ঘটাচ্ছে লাবডুব করা হৃৎপিণ্ডে।
মন, মাথা, শরীর মশাল হয়ে জ্বলছে। নিজের লেখা সুর করা গান তাঁর কণ্ঠ হতে কারা "নিল ভুলায়ে" ?



তিনি শিলাজিৎ মজুমদার। নব্বই এর দশকে নতুন ধারার বাংলা গানকে যে সব শিল্পীরা অন্য খাতে বইয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন আজ নিজের গানের লিরিক ও সুরের কপিরাইটের জন্য খুব কষ্টে আছেন। কোনও পাবলিক পারফরমেন্সে নিজের গান গাইবার আইনত অধিকার নাকি নেই তাঁর।

নব্বই এর দশকে বেসিক বাংলা গানের ধারা বাংলা গানের ইতিহাসে না এলে কী হত তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে গবেষণা করতে পারে আগামী দিনের সাহিত্য বা সঙ্গীতের ছাত্রছাত্রীরা। সেই নতুন ধারার বাংলা গানের এক উজ্জ্বল শিল্পী গাইতে পারছেন না নিজের গান। ভাবতে পারেন 'বাজল ছুটির ঘণ্টা', বা 'ঘুম পেয়েছে বাড়ি যা' বা 'প্রেম যেন ওয়েসিস' এখন শোনা যাবে না শিলাজিৎ এর কণ্ঠে! কোনও লাইভ অনুষ্ঠানে! এমন কি "ওলোলোমামা তালালামাতিনি মামাআমিতে" এই মন মাতানো ইয়ডেলিং ও আমি আপনি আর শুনতে পাব না শিলাজিৎ এর কণ্ঠে! উনি পারবেন না গান গুলি গাইতে! সুরগুলো ছাড়তে! অথচ গান গুলি তাঁরই লেখা। তাঁরই সুর করা। কী রকম কষ্ট হয় ভাবতে পারেন?
ওই যে কোভিড সংক্রমণের শুরুর সময় একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল, মনে আছে? এক স্বাস্থ্যকর্মী মা তিন সপ্তাহ বাড়ি যেতে পারেন নি। তারপর তাঁর স্বামী তাদের তিন বছরের শিশু কন্যাকে নিয়ে এসেছেন হাসপাতালের সামনে। প্রায় কুড়ি ফুট দূর থেকে মা আর মেয়ের দেখা হচ্ছে। ওই স্বাস্থ্যকর্মী মা তাঁর সন্তানকে আদর করতে পারছেন না, পাছে সংক্রমণ ছড়িয়ে যায়। অঝোর ধারায় কাঁদছে মা আর ৩ বছরের শিশু কন্যা! এ বিচ্ছেদ যেন তার সাথেই তুলনীয়। কোথাও তার চেয়েও বেশি। ওই স্বাস্থ্যকর্মী মা হয়ত এখন ফিরে পেয়েছেন তাঁর কোলে সন্তানটিকে কিন্তু আমাদের নাগরিক বাউল?

লেখকরা এক একটা অক্ষর লেখেন অনেক আদর দিয়ে, অনেক আবেগ মিশিয়ে। সুরকাররা লেখায় প্রাণ দান করেন সাত সুর বুলিয়ে বুলিয়ে। আর গায়ক সেই গানে নিজের সেরা এক্সপ্রেশনটা দিয়ে তাকে মানুষের মনে গেঁথে দেন। তাই তো গান হিট হয়। সুর হণ্ট করে। কথা ভাবায়। আর এই লেখা, সুর করা এবং গাওয়া এই তিনটি কাজ যদি একটি মানুষই করে গানটিকে অমর করে তাহলে তো সেই গান তাঁর সন্তানসম। তাঁর থেকে সেই গান কেড়ে নেওয়া তো শুধু অপরাধই নয়, পাপ।

এরকমই কাজ চলছে। আমাদের শহরে। যে মিউজিক কোম্পানির সঙ্গে আজীবন কাজ করে এসেছেন শিলাজিৎ তারাই তাঁকে কপিরাইট স্ট্রাইক করছে। শিল্পী বলছেন "১৯৯৪ এর ১ সেপ্টেম্বর আমার যে অ্যালবাম বেরিয়েছিল আমি তা গাইতে পারব না। আমার লেখা, আমার সুর, আমার চিৎকার, আমার শীৎকার, আমার আবেগ অন্যকে বিক্রি করে দিয়েছে ওই কোম্পানি, আমাকে অন্ধকারে রেখে। তাই আমি চাইলেও ওই গান গুলো গাইতে পারব না। আমার প্রভিডেণ্ট ফাণ্ড নেই, ওই গান গুলিই আমার সন্তান, আমার সম্পদ। অথচ আমাকে তাদের ছুঁতে দেওয়া হচ্ছে না। চাইলেও আদর করে গাইতে দেওয়া হচ্ছে না ওই গান গুলো।"
শুধু 'ভূমিকা'ই নয় ওনাদের সঙ্গে রেকর্ড করা সমস্ত গানেই কপিরাইট স্ট্রাইক করছে শিল্পীকে। আর সেই গানের সংখ্যাও নেহাত কম নয় ৫০এর ও বেশি।

তবে যখন সাধারণ মানুষ হেরে যায় হতাশ হয় তখনই সেই হতাশার স্তুপ থেকেই জেগে ওঠে একজন শিল্পীর সত্ত্বা। তাই বোধহয় শিল্পীদের প্রতিবাদ তাদের সৃষ্টিতে। সেই পথেই হেঁটেছেন শিলাজিৎ। তাই ১ সেপ্টেম্বর ২০২০ থেকে নিজের ইউটউবে শিলাজিৎ শুরু করলেন রি-ভুমিকা। প্রতিদিন গেয়েছেন ১টি করে নদিনে মোট ৯টি গান। সেই গানগুলি গাইতে গিয়ে বারে বারে কথা ও সুর পাল্টেই গেয়েছেন শিলাজিৎ। তৈরি হয়েছে নতুন এক একটা গান। ২০ সেপ্টেম্বর একটি অনুষ্ঠান হল ভুমিকা রিলিজের ২৬ বছরের উদযাপনে। "ভূমিকা থেকে রিভূমিকা" শীর্ষক ওই অনলাইন অনুষ্ঠানের টাইটেল কার্ডে স্বকীয় ভঙ্গিতে শিলাজিৎ বলছেন -" আসবিস আসবিস, না আসবিস না আসবিস, আমরা থাকবিস"।

No comments: