Saturday, January 9, 2021

ওদের সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং শেখাতে হয় না



রোনা আবহে সামাজিক দূরত্ব বা দৈহিক দূরত্ব বজায় রাখা আমাদের ক্ষেত্রে দুষ্কর হয়ে পড়ছে। বারে বারে লকডাউন করে নানান রকমের প্রচার করে সরকার থেকে বেসরকারি সংস্থা সকলেই জোর দিচ্ছে দৈহিক দূরত্ব বা ফিজিক্যাল ডিসটেন্সিং বজায় রাখার জন্য। নিয়ম করা হচ্ছে। নিয়ম ভাঙলে শাস্তির বিধানও জারী হচ্ছে। তবুও আনলক এরপর আর লক ডাউনের আগে বাজারে ভিড় বাড়ছে। দূরত্ব বিধীকে শিকেয় তুলে মানুষ বাঁচার রসদ খুঁজছে। কিন্তু ভাবলে অবাক হবেন মানুষ ছাড়া বেশ কিছু সমাজবদ্ধ প্রাণী অসুস্থ হলে দৈহিক দূরত্ব বজায় রাখে। প্রকৃতি তাদের শিখিয়ে দেয় এই পাঠ ।


পিঁপড়ে, মৌমাছি, বানর, বনমানুষ, বাদুড় ও ইঁদুরের ক্ষেত্রে এ ধরনের আচরণ দেখে চমকে গিয়েছেন জীববিজ্ঞানীরা। এদের আচরণ এর অনেকগুলোই হয়ত মানুষের সঙ্গে মিলবে না কিন্তু অসুস্থতা দূরত্ব বজায় রাখার অভ্যাস যে প্রকৃতি থেকেই শেখা তা হয়ত বোঝা যাবে ।

ব্ল্যাক গার্ডেন অ্যন্ট বা কালো পিঁপড়েদের শ্রমিক পিঁপড়েরা অনেক সময় মেটারহিজিয়াম ব্রুনিয়ম ফাংগাসের দ্বারা আক্রান্ত হয় । ওই ফাংগাসে আক্রান্ত হওয়ার একদিনের মধ্যেই আক্রান্ত শ্রমিক পিঁপড়েটি দিনের অধিকাংশ সময়ই তার বাসার বাইরে কাটাতে থাকে। তাছাড়া কলোনির অন্যান্য পিঁপড়েদের সঙ্গেও তার যোগাযোগ সে কমিয়ে ফেলে ।


আমেরিকান ফাউলব্রুড ব্যাকটেরিয়া আক্রান্ত হয় মৌমাছির লার্ভা। আক্রান্ত লার্ভার গা থেকে দু'ধরনের ফেরোমোনের গন্ধ পাওয়া যায়। একটি স্বাভাবিক ফেরোমন অপরটি আক্রান্ত হওয়ার কারণে একটি বিশেষ ধরনের ফেরোমোন। এই মিশ্রিত গন্ধ যেই পূর্ণাঙ্গ শ্রমিক মৌমাছিরা পায় তারা তৎক্ষণাৎ ওই আক্রান্ত লার্ভা টিকে অপসারণ করে। তাকে তুলে নিয়ে মৌচাকের বাইরে ফেলে দেয় । আমেরিকান বুল ফ্রগের ব্যাঙাচিরা একটি ভয়ঙ্কর ফাঙ্গাস ইনফেকশন চিনে ফেলতে অসম্ভব পটু । ক্যানডিডা হিউমিকোলা নামক ওই ছত্রাকে আক্রান্ত ব্যাঙাচিদের সযত্নে এড়িয়ে যায় সুস্থ ব্যাঙাচিরা ।


ওয়েস্টার্ন লোল্যান্ড গরিলারা দলবদ্ধভাবে থাকে। তাদের দলের মহিলারা বারেবারে দল পরিবর্তন করে এক দল থেকে অন্য দলে যাতায়াত করে। ২০১৯ সালের একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে এই মহিলা গরিলাদের দল পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হল ইয়জ নামক এক ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ। ওই রোগাক্রান্ত গরিলাদের মুখে এক ধরনের ঘা হয়। ওই ঘা দেখেই মহিলা গরিলা পুরুষ সঙ্গীকে ছেড়ে সুস্থতর কোন দলে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ৬০০ টিরও অধিক গরিলার ওপর গবেষণা চালিয়ে প্রাণী বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। দেখা গিয়েছে ইয়জ ব্যাকটেরিয়া আক্রান্ত পুরুষ গরিলাদের থেকে সুস্থ মহিলা গরিলারা দূরে সরে গেছে। এতেই প্রমাণিত হয় যে গরিলারা বুঝে গেছে রোগটি সংক্রামক।


শিম্পাঞ্জিদের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে পোলিও আক্রান্ত শিম্পাঞ্জিকে একঘরে করে রেখে দেয় বাকি শিম্পাঞ্জিরা। আবার আক্রান্ত শিম্পাঞ্জিটি সুস্থ হয়ে গেলে তাকে দলে ফেরত নেওয়া হয়।


ম্যানড্রিল গীবনদের দিনের অধিকাংশ সময়ই কাটে একে অপরের লোম আঁচড়ে দিয়ে। দু'বছর ধরে ২৫ টি ম্যানড্রিল গীবনকে নিয়ে চালানো একটি নিরীক্ষায় দেখা গিয়েছে পরজীবী আক্রান্ত ম্যানড্রিল গীবনদের তাদের সঙ্গীরা ততটা আদর যত্ন করছে না।

ভ্যাম্পায়ার ব্যটের বেঁচে থাকতে গেলে প্রতিদিন অন্তত এক চামচ রক্তের প্রয়োজন খাদ্য হিসেবে। পরপর তিনদিন যদি ওই রক্তের জোগান না পায় ভ্যাম্পায়ার ব্যাট তাহলে তারা মারা যায়। এরা অত্যন্ত সামাজিক প্রাণী এবং একে অপরের খাদ্য বন্টন ও গা চুলকে দিতে সাহায্য করে। কিন্তু দেখা যায় যদি কোন ভ্যাম্পায়ার ব্যাট অসুস্থ হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে তাহলে সে নিজেকে অন্য বাদুড়দের থেকে আলাদা করে রাখে এবং তাদের সঙ্গে খাবার ভাগ করে খায় না।


২০১৬ য় ইঁদুরের উপর একটি পরীক্ষা করা হয়। ব্যাকটেরিয়ার লাইপো স্যাকারাইড একটি ইঁদুরের গায়ে ইনজেকশন দিয়ে তাকে রেডিও কলার পরিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। দেখা যায় ওই ইনজেকশন এর ফলে লাইপো স্যাকারাইডের প্রভাবে ইঁদুরটি অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং ওই অসুস্থ ইঁদুরকে তার দলের অন্য ইঁদুর রা দূরে সরিয়ে না দিলেও অসুস্থ ইঁদুরটি অন্য অসুস্থ ইঁদুরদের থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে।

ইউল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এর মতে প্রাণীরা শিকার ধরা ও শিকারি প্রাণীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাদের দৈহিক গঠনে নানা রকম পরিবর্তন ঘটিয়ে কালক্রমে অভিযোজিত হয়ে বিবর্তিত হয়েছে। একইভাবে রোগ সংক্রমণের ফলে দৈহিক ক্ষতি বা মৃত্যু আটকাতেও তাদের ব্যবহারের মধ্যে নানান রকম পরিবর্তন এসেছে। আমাদের যে অভ্যাস সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা ও আইন প্রশাসন জোর করে শেখায়, প্রাণী জগতে অনেক প্রাণীই শুধুমাত্র বাঁচার তাগিদে ও পৃথিবীতে অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে সেই আচরণ অভ্যাস করে আসছে যুগ যুগ ধরে।

No comments: