পুজো কেমন কাটল আপনাদের? তৃতীয় তরঙ্গের আশঙ্কার মধ্যে এবারের দুর্গোৎসব। পুজোর কটা দিনের পর করোনার সংক্রমণ কিছুটা বেড়েছে। তারমধ্যেই আমরা বাঙালির সেরা উৎসবের উদযাপনটা করে নিলাম। এবারের দুর্গাপুজোয় আমি আর আমার স্ত্রী কোয়েল কোনও নতুন জামা কিনলাম না। বিষয়টা এরকম নয় যে কেনার জন্য অর্থের সঙ্গতিতে কোনওরকম অসুবিধা ছিল। দুজনের দুটি নতুন বস্ত্র কেনবার সামর্থ পরম করুণাময় ঈশ্বরের আশীর্বাদে ছিল। কিন্তু একটা লেখা এমনভাবে নাড়া দিয়ে গেল যে নতুন বস্ত্র কেনার ইচ্ছেই করল না। সেই প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। এবারে আমরা দারুণ পুজো কাটিয়েছি।
বাড়ির ছোট আর বড়দের জন্য সামান্য কিছু প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে বেরোলাম। ইচ্ছে ছিল কোনও শপিং মল নয় ছোট দোকান থেকে কিনব যতটুকু প্রয়োজন। গড়িয়াহাটের দোকানে দোকানে ঘুরছি। বহুদিন বাদে ছোট শপিং কমপ্লেক্স গুলো খুলেছে। মানুষগুলো, যারা দোকান দিয়েছেন লড়াই করছেন। অসম লড়াই একটা। অনলাইন শপিং পোর্টালের সঙ্গে লড়াই, বড় ব্র্যান্ডের সঙ্গে লড়াই, ঝাঁ চকচকে শপিং মলের সঙ্গে লড়াই। মূল রাস্তা থেকে অনেকটা ভিতরে, কম সুবিধা প্রাপ্ত, নন এসি, অনেকটা আমাদের এই মফস্বলে বড় হওয়া দম্পতির ছোটবেলায় দেখা দোকানের মত লড়াকু মানুষগুলোর কাছেই গেলাম 'পূজা শপিং' এ। সম্বোধনেই আন্তরিকতার ফারাকটা স্পষ্ট। কর্পোরেট 'স্যার-ম্যাডামের' পরিবর্তে "দাদা আসুন বৌদি বসুন কী দেখাব?"।
লাভলি মিষ্টি শ্রাবণী রাহুল
এরই মাঝে আমার মেয়ের বয়সী এক মেয়ে আর তার বন্ধু আমাদের দিকে এগিয়ে এল। দুজনের মধ্যে বড় যে ষে এগিয়ে এসে হাতের পঞ্চবটী ধুপের গোছা দেখিয়ে বলল "নাও না গো একটা"। আমরা বরাবর ওই ধুপটার জন্য মুখিয়ে থাকি গড়িয়াহাট গেলেই। অন্য শিশুটি ছুট্টে চলে গেল অন্য খদ্দেরের আশায়। ধুপ কিনে আমার স্ত্রী বাচ্চাটির সঙ্গে কথা বলা আরম্ভ করলেন। জানা গেল, ওর নাম লাভলি আর বছর পাঁচেকের পুঁচকেটার নাম মিষ্টি। দূরে মিষ্টি দোকানের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে। ডাকলাম এই মিষ্টি শোন। অপরিচিত কেউ ওর নাম ধরে ডাকছে এটায় ওরা বোধহয় অভ্যস্ত নয়। দুজনের থেকেই ধুপ কিনলাম। আমাদের প্রিয়জনদের জামাকাপড়ের সঙ্গে ওই ধুপগুলোও উপহার দেব ঠিক করেছিলাম। কেনাকাটার পর বাড়ি ফিরব এমন সময়ে দেখা হল আবার লাভলি আর মিষ্টির সঙ্গে। ওরা ওদের দিদি শ্রাবণীকে নিয়ে ঘুরছে।
লাভলি বলল- "আবার তোমাদের সঙ্গে দেখা"।
"দিদি দ্যাখ এই কাকু আর কাকিমাটা আমাদের থেকে কত গুলো ধুপ কিনেছে জানিস"!
কোয়েল শ্রাবণীর থেকেও ক'টা ধুপ নিল
শ্রাবণী- "আমাদের জন্য তোমাদের কতগুলো টাকা ফালতু নষ্ট হয়ে গেল, তাই না"!
বাইরে ঝড় উঠেছে। বাড়ি ফেরার তাড়া। তার মধ্যেই ওদের সঙ্গে অল্প গল্প করলাম আমরা। লাভলি, মিষ্টি, শ্রাবণী আর রাহুলের মত বাচ্চাগুলো গড়িয়াহাটার ফ্লাইওভারের তলায় বাবা মায়ের সঙ্গে থাকে। আমি টিভি নাইন বাংলার একটা ভিডিও শ্যুটে গিয়ে ওদের মত অনেক বাচ্চাকে দেখেছি লক ডাউনের সময়ে। সে কথা ওদের বলতেই ওরা বলল "একদিন তোমরাও খাওয়াবে আমাদের"?
বিজ্ঞাপনের ভাষায় শিশু আর শ্রমিকের মধ্যে দূরত্ব রাখা যায় না এ শহরের ফুটপাথগুলোয়। পার্ক সার্কাস আর পার্ক স্ট্রীটের বেলুন বিক্রেতা সাবানা, করিশ্মা আর গড়িয়াহাটের লাভলি মিষ্টি শ্রাবণী আর রাহুলরা মিলে মিশে যায়। আমাদের শহরের শ্রমিক শিশুরা দূরত্ব চায় না। মর্যাদা চায়। শ্রমিকের মর্যাদা। শিক্ষা চায়। একটু মানুষের মত বাঁচতে চায়। এই শহরে, এই দেশে শিশুশ্রম আছে। ঘোরতর ভাবেই আছে। কর্পোরেট চাইলেও আছে না চাইলেও আছে। সংস্কৃতি মনস্ক বাঙালি চাইলেও আছে না চাইলেও আছে। শিশু আর শ্রমের মধ্যে দূরত্ব ঘোচাতে চাইলে শ্রমিক শিশুদের পরিবারের খাদ্যের জোগানকে সুনিশ্চিত করতে হবে আগে। এই শহরে বড়বড় পুজোয় কোটি কোটি টাকা ফুঁকে যায়! স্রেফ ফুঁ দিয়ে উড়ে যায়। আর ধুপের ফেরিওয়ালা শিশুরা সুগন্ধ বিক্রি করে!
গারমেন্ট লাইফ আর রিসাইকেল - পৃথিবীর জন্য জরুরী
পুজোর ঠিক আগে সেপ্টেম্বরের শেষদিকে একটা লেখা পেলাম সোশ্যাল মেসেজিং এ । লেখাটি লিখছেন রুপান্তরণ ফাউন্ডেশনের স্মিতা সেন। এই লেখাটি পড়ে আমরা, মানে আমি আর আমার স্ত্রী মনস্থ করলাম এবার পুজোয় চাই না আমাদের দুজনের নতুন জামা।
স্মিতার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত আলাপ নেই। ওনাকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ওনার পোস্ট করা সোশ্যাল মিডিয়ার সেই বার্তা হুবহু তুলে দিলাম নীচে। অত্যন্ত মুল্যবান এবং দামী কিছু সময়োপযোগী কথা স্মিতা লিখছেন-
সামনেই উৎসবের মরসুম। উৎসব মানেই নতুন জামাকাপড় কেনা। ছোটবেলায় পুজোর সময়ের অতি পরিচিত আলোচনা ছিল কার কটা জামা হল। আজকাল অনলাইন কেনাকাটার দৌলতে সারা বছরই জামাকাপড় বিক্রি হচ্ছে। কেউ কেউ আবার মন ভালো রাখতে শপিং করেন, যেটা বেশিরভাগ সময়ই জামাকাপড়। নতুন জামা সারাবছরে কতগুলো কিনব এবার বোধহয় হিসাব করার সময় এসে গেছে। একটু সহজ করে বলার চেষ্টা করছি।
পরিসংখ্যান বলছে ১৫ বছর আগে আমরা যে পরিমাণ পোশাক ব্যবহার করতাম, এখন করছি তার দ্বিগুণ। ফলে এখন ফ্যাশন থেকে সৃষ্ট বর্জ্যের পরিমাণও অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ। আগে মানুষ একটা পোশাক যে পরিমাণ ব্যবহার করত, এখন তার শতকরা ৪০ ভাগও করে না। এখন একটা পোশাকের গড় আয়ু দুবছর দুমাস। আর সেটি গড়ে ৭ থেকে ১০ বার পরা হয়। আমরা এমন একটা বিশ্বে বাস করছি, যেখানে প্রয়োজনের তুলনায় বহুগুণ বেশি পোশাক উৎপাদন করা হয়। গার্মেন্টসের জঞ্জালে ভরে উঠেছে পৃথিবী।
আপনি ভাবছেন, আপনার টাকায় আপনি ফ্যাশন করবেন। তাতে সমস্যা কোথায়? সমস্যা আছে। একটা সুতির টি-শার্ট বানাতে যে পরিমাণ কাপড় লাগে, সেটির জন্য প্রয়োজনীয় তুলা উৎপাদন করতে ২০ হাজার লিটার জল খরচ হয়। বিশ্বে যত জল ব্যবহৃত হয়, তার শতকরা ২০ ভাগ খরচ হয়ে যায় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে। স্পিনিং, উইভিং, ডায়িং, ফিনিশিং, গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং, পোস্ট কনজিউমিং-প্রতিটা ক্ষেত্রে উৎপাদিত হয় বর্জ্য। পরিবেশদূষণের যত কারণ, তার মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে পোশাকশিল্প। ইউনাইটেড ন্যাশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে ফ্যাশনশিল্পের জন্য গ্রিনহাউস গ্যাস এবং বর্জ্য নিঃসরণ বৃদ্ধি পাবে ৬০ শতাংশ। ২০৫০ সালের মধ্যে আমার-আপনার চাহিদা মেটাতে বর্তমানে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, তার তিন গুণ প্রাকৃতিক সম্পদের প্রয়োজন হবে। ক্লাইমেট চেঞ্জ কিন্তু আর বইয়ে পড়ে ভুলে যাওয়ার বিষয় নয়। অতিবৃষ্টি, অতিগরম, সাইক্লোন, দাবানলের খবরে আমরা টের পাচ্ছি এবার ক্লাইমেট চেঞ্জ বিষয়টা আমাদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। প্রশ্ন হল আমি, আপনি, আমরা - সাধারণ মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষরা কি করতে পারি?
প্রথমত, ‘গার্মেন্ট লাইফটাইম’ বাড়ানো। মানে এক পোশাক বেশি দিন পরা। পোশাকের আয়ু বাড়ানো। যদি নতুন পোশাক না কিনে একটা পোশাক মাত্র ৯ মাস বেশি পরেন, তাহলেই ওই পোশাকের মাধ্যমে কার্বন উৎপাদন আর ওই পোশাকের পেছনে ব্যবহৃত অপচয় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।
পুরোনো পোশাক ফেলে না দিয়ে ‘ভ্যালু অ্যাড’ করুন। শাড়ি দিয়ে পর্দা, কুর্তি থেকে কুশন কভার, শার্ট দিয়ে ব্লাউজ, ফুলপ্যান্ট কেটে হাফপ্যান্ট - পৃথিবীকে এবার আপনার ক্রিয়েটিভিটি দেখানোর সময় এসেছে। রিসাইক্লিংয়ের সবচেয়ে ভালো উদাহরণ আমাদের কাঁথা। ভেতরের দিকে বেশি পুরোনো কাপড়, আর ওপরের দিকে কম পুরোনো কাপড়, শাড়ির সুন্দর পাড় ব্যবহার করে কি দারুণ নকশা বানাতেন আমার ঠাকুমা। এমনকি সুতোটা পর্যন্ত পুরোনো শাড়ি থেকে বের করা হত। আমাদের হাতে টাকা আসায় এই প্রয়োজনীয় ভ্যালুগুলো হারিয়ে ফেলছি। নিজেদের পারদর্শিতা না থাকলে অন্য কারোর সাহায্য নিয়ে রিসাইক্লিং করি।
পরিমিতিবোধের সাথে পোশাক কিনুন। দরকারে কেনাকাটা করুন, ক্যালেন্ডার দেখে নয়। "পুজোয় কটা জামা হল?" এই প্রশ্ন করা সত্যিই অনুচিত।
(এই অংশটি স্মিতা সেনের ফেসবুক পোস্ট থেকে নেওয়া)
একবার রিসাইকেল্ড পোশাক নিয়ে হিডকোর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর শ্রী দেবাশিস সেনের সঙ্গেও কথা হয়েছিল বেশ কয়েক মাস আগে। প্রশাসনিক কর্তা শ্রী সেন নিজের কাঁথা স্টিচের জ্যাকেট দেখিয়ে একটা কথা বলেছিলেন আজও পরিষ্কার মনে আছে , " দেখুন এই জামাটা আমি বাই চান্স নয় বাই চয়েস পরেছি"। এই বাই চয়েস পুরনোকে নতুন করে পরার মানসিকতাই বোধহয় বাঁচাতে পারে পৃথিবীকে। দরকার নেই বেশি কিছুর। আমি একটা সময়ে ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলিকে দেখেছি। এক শার্ট একাধিক অনুষ্ঠানে পরতে কোনও রকম অস্বস্তিতে পড়তেন না বাইশ গজের মহারাজ। সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা মানুষ গুলো বোধহয় নিজের কাজের মধ্যেই উদাহরণ রেখে দেন। আর একজন, প্রিন্সেস ডায়ানা। একাধিক বার গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে একই পরিধেয় 'রিপিট' করতেন লেডি ডায়ানা, যা ওই স্তরের মানুষজনদের মধ্যে বিরল। এভাবেই নিঃশব্দে কাজ করে চলেছেন কিছু মানুষ। আগামী দিনগুলোয় খাদ্যের সংকট, পানীয় জলের সংকট যাতে আমার আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঘিরে না ধরে তার জন্য চলুন না আজ থেকেই ভাবনা শুরু করি, কাজ করা শুরু করি।
1 comment:
খুব খুব উন্নত লেখা
Post a Comment