আমাদের স্কুল বয়সে রেডিও-ই ছিল দূরের জানলা। তাও সেটা সব সময় সহজলভ্য ছিল না। 'মারফি মিনিব্য ডিলাক্স'-এর ব্যাটারি কমে গেলে বা ঝড়-জলে সিগন্যাল ডিস্টার্বড হলে রেডিও শোনার মজাটাও কিরকিরে হয়ে যেত। তখন ধারাবিবরণী শোনার চেয়ে পাড়ার খেলার মাঠই বেশি ডাকত। যেহেতু বেড়ে ওঠার রেলওয়ে কলোনিটা কলকাতা থেকে অনেক দূর, জেলায়- তাই খবরের কাগজ যখন হাতে এসে পৌঁছত, তখন বোধহয় পরের দিনের কাগজ অর্ধেকটা ছাপা হয়ে যেত। আমাদের নিস্তরঙ্গ জীবনযাপনে ঢিল মেরে যেত শেষ বিকেলে হাতে পাওয়া সংবাদপত্রের শিরোনাম। '৮৩-তে ভারতের বিশ্বকাপ জেতার 'সেলিব্রেশান' নেহাতই 'নাদান বয়স' আর ভৌগলিকভাবে আলোকবৃত্তের অনেক বাইরে থাকায় ভালভাবে আঁচই করতে পারি নি।
কিন্তু জীবন আচমকা কত কী দেয়!
২৫ বছরের একটা টাইম ল্যাপ।
কাট টু ২৩ জুন ২০০৮। দিল্লির 'সুন্দর নগর'-এর ৩৯ নম্বর বাড়ির বাইরের রাস্তা। বাড়িটার নাম-ফলকে লেখা মালিকের পরিচয়-- কে, দেব। আমার সঙ্গী রেডিওর বদলে ক্যামেরা। রিপোর্টার দেবাশিসের সঙ্গে সেই পড়ন্ত বিকেলে পায়চারি করছি। আজ একটা ফাটকা খেলছি আমরা। ৮৩'-র বিশ্বজয়ী দলের 'সাপোর্ট স্টাফ'-দের কানাঘুষোতে আড়ি পেতে পাওয়া একটা 'টিপ'(Tip)- কে 'লক্ষ্যভেদ' করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। দেবাশিস বলছে-'১৯৮৩-র ২৫ জুন ওয়ার্ল্ড কাপ জেতার পর থেকে টিমমেট-রা একসঙ্গে কোনও পার্টি করেনি। আজ এই বাড়িতে ২৫ বছরের তুলে রাখা সেই পার্টি! ভাবতে পারছিস? ছবি পেলে কী স্টোরি হবে! আনবিলিভেবল!' তখন ওর রক্তচাপ মাপলে পারদ স্ফিগমোম্যানোমিটারের স্কেলের উচ্চসীমায় ঠোক্কর খাচ্ছে দেখা যেত হয়ত! দুপুর থেকে এই একই কথা বারবার বলে চলেছে।
বিকেল ধীরে ধীরে সন্ধ্যের হাত ধরে রাতের কাছাকাছি যেতে চাইছে। ইতিমধ্যে সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের কেউকেটা দু'-তিনটে চ্যানেলের ডাকসাইটে কয়েকটা চেনামুখের আনাগোনা দেবাশিসের চোয়াল শক্ত করে দিচ্ছে বারবার। বিড় বিড় করে বলতে শুরু করল- ' কেঁচে গেল রে! এক্সক্লুসিভ থাকল না স্টোরিটা।' এরই মাঝে একটা চ্যানেল 'ওবি ভ্যান' পাঠাবে কি না জানার জন্য প্রতিনিধিকে ফোন করল। এপার থেকে- ' সারজি ইয়ে ইনলোগোঁ কি প্রাইভেট পার্টি হ্যায়। বিসিসিআই, স্পন্সর্স কোই ভি অ্যালাউড নেহি হ্যায়, তো মিডিয়া ক্যায়সে অন্দর যা পায়েগি?' ওপার থেকে কী নির্দেশ এল বুঝে ওঠার আগেই ময়দান ফাঁকা। বাকিরাও মহাজনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জুনের সেই সন্ধ্যায় মার্চ করল।
সন্ধ্যের পড়ে-যাওয়া আলোয় মরে যাওয়া আশা আর দেবাশিসের চোখ- দুটোই একসঙ্গে উজ্জল হয়ে উঠল। খোঁজখবর সিদ্ধ চোখ ততক্ষণে দেখে নিয়েছে ৩৯ নম্বর বাড়িটার ভিতরে জ্বলে-ওঠা নরম মোমের আলোগুলো। যারা হাজার বাতির ঝলকানিতে অনায়াস, তাদের নিশিযাপনের 'ট্রেলার' এর আভাষ পেয়ে 'দিল' তখন 'মাঙ্গে মোর'।
ধীরে ধীরে দিল্লির সন্ধ্যে সাবালিকা হচ্ছে। আর বাড়িটার সামনে এক একটা সম্ভ্রান্ত গাড়ি এসে দাঁড়াচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে আসছেন সৈয়দ কিরমানি, দিলীপ বেঙ্গসরকর, সুনীল গাভাসকর, কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত, শ্যাম্পেন হাতে কীর্তি আজাদ। একটা করে ছবি হচ্ছে, দেবাশিসের হাসি চওড়া হচ্ছে। এরপর এসে দাঁড়ানো গাড়ি থেকে নাম্লেন '৮৩র ফাইনালের লাস্ট ল্যাপের 'গোল্ডেন বয়' মহিন্দর অমরনাথ, সস্ত্রীক। এদিকে ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে আজকের 'এক্সট্রা টাইম'-এর 'ডেটলাইন' পেরল। 'ফিড' পাঠিয়ে আজকের বুলেটিনে এই খবরটা ধরানো যাবে না। আর অ্যাসাইনমেন্ট-টায় যা সময় লাগবে, মনে হচ্ছে ততক্ষণ খাবারের সব দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। বিস্কুট খেয়েই আজকের রাতটা কাটাতে হবে। ওদিকে ৩৯ নং বাড়িটার স্নিগ্ধ রোশনাইয়ে উজ্জ্বলতা জোগাতে আগমন হয়েই চলেছে 'ভিভিআইপি' অতিথিদের। সন্দীপ পাটিল, বলবিন্দর সান্ধু, রজার বিনি আর মদন লাল। হঠাৎ মা-র কথা মনে পড়ল।
নিতান্ত বোতল খাওয়ার বয়সে রেডিও চালিয়ে গানের ষড়যন্ত্রে আমাকে ঘুম পাড়াত মা। একবার নাকি বোতলে দুধ শেষ, আর রেডিওতে গান শেষে শুরু হয়েছে ক্রিকেট-ধারাবিবরণী। বহু দূর কোনও ক্রিজে আউট হয়েছেন ব্যাটসম্যান মদন লাল। কমেন্ট্রেটরের গলায় হা- হুতাশ- 'অউর ইয়ে মদনলাল আউট!' রেডিওটার ধারে পাশে থাকা শ্রোতাদের হতাশাব্যাঞ্জক চিৎকার ছোট্ট 'আমি'-টাকে বিচলিত করে এক অদ্ভুত উল্লাস দিয়েছিল। আধা-বোধের সেই দিনগুলোয় 'আউট' শব্দের অর্থভ্রমে কাচের ফিডিং বোতল মাটিতে ফেলে ভাঙা কাচের ওপরে নাকি শুরু করেছিলাম তুড়ুক নাচ। মুখে চিৎকার, 'মদনলাল আউত মদনলাল আউত।' পরে মনে হয়েছে ভাঙা কাচের মধ্যে না বুঝে নেচে আমার চারপাশে সেদিন না-জানি কত গব্বর সিং তৈরি করেছিলাম। হাফপ্যান্ট থেকে ফুলপ্যান্ট হওয়া কৈশোরে এই ক্যাবলামির ঘরোয়া ধারাবিবরণীতে শৈশবে জড়িয়ে থাকা নিতান্ত গুরুত্বহীন এই ঘটনায় কতবার যে আমাকে বিব্রত,লজ্জিত করেছেন মদন লাল।
সম্বিত ফিরে পেলাম এক পরিচিত কণ্ঠের ডাকে- 'আপ এক হেল্প করেঙ্গে?'
উঁচু লোহার গেটটা থেকে বেরিয়েছেন কালো হাইনেক টি-শার্ট আর জেড ব্ল্যাক জিনস পরা 'পামোলিভ কা জওবাব নেহি' হাসিওয়ালা লোকটা। কোলে লোমশ দুধ-সাদা পোষ্য সারমেয়। আড়ষ্টতা নিয়ে এগিয়ে গেলাম। বললাম- টেল মি স্যার হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ? ক্যাপ্টেন দেব ব্ললেন-'অন্দর সাবলোগ পার্টিমে হ্যায়। আপ থোড়া উনকি ভিডিও শ্যুট কর দেঙ্গে?'
বলে কী লোকটা? অনুরোধ? কী বলব একে? এ কি মেঘ না চাইতেই আকাশ ঝেঁপে বৃষ্টি? না কি সূর্যোদয়ের আগে ঝকঝকে রোদ? সম্মতি দিতেই আবার বললেন-'লেকিন এক বাত, কিসিকো ডিস্টার্ব মত করনা আপ।'
বাড়ির মালিকের সঙ্গে গেট পার করে লালচে মার্বেল পাতা ড্রাইভওয়ে পার করে ফুল দিয়ে সাজানো লনটায় যখন ঢুকলাম, তখন অদ্ভুত এক সাম্রাজ্য সেখানে। ভারতের ক্রিকেট-রংবাজির শুরুয়াতের নায়করা বসেছেন নিজস্ব মজলিসে। সঙ্গত দিচ্ছে 'সুন্দর নগর' এর সুন্দরতম এই বাড়ি। আর বাড়ির মেহমান নওয়াজ মালিক। রুচিবোধ, পরিমিতিবোধ আর আন্তরিকতা মিশিয়ে এক স্বপ্নিল প্রতীক্ষার শেষে দাঁড়িয়ে আজ সাফল্য উদযাপন করছে এই বাংলোর প্রতিটা ইট,কাঠ, ঘাস,পাতা,আলো,বাতাস। মৃদু গান বাজছে। শ্যুট শুরু কি করব? উত্তেজনায় বুকে একশো হাপরের টান। কানে বাজছে,' কোই ভি অ্যালাউড নেহি হ্যায়, তো মিডিয়া ক্যায়সে অন্দর যা পায়েগি?' মনের মাথায় মনে-মনে থাপ্পড় মেরে ঠাণ্ডা করলাম। পুরো অ্যামবিয়েন্সটা ক্যামেরাবন্দী করব চেষ্টা করছি। সব শব্দ, সব বর্ণ। হতাশ লাগছিল, সুগন্ধগুলোকে কেন যে ক্যাপচার করার কোনও উপায় নেই! ঘাসে ঢাকা ছোট্ট লনটাতে 'বাফেট কাউন্টার'। মাথায় পাগড়ি পরা শেফ-রা ব্যস্ত খাবার পরিবেশনে। রকমারি স্যালাড, স্টার্টার, মেইনকোর্স পার করে আসছে সুমিষ্ট ডেজার্ট। মাঝে মাঝে 'নহবত'-এর পুতুল মিনিয়েচার। সত্যিই তো, কাপ জেতার সানাইটা এত-দিন একসঙ্গে শোনা হয়ে ওঠেনি এঁদের। কাঠের গুঁড়ি দিয়ে বানানো টুল-চেয়ার। ব্যালকনিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মহারথীরা নৈশভোজে ব্যস্ত। আবহ-র পর এবার প্রত্যেক নায়কদের 'অলগ অলগ ক্লোজ আপ' নিতে হবে। শট ডিভিশনের আবদারটি স্বয়ং কপিল পাজি-র। অতএব ক্লোজ-আপ পর্ব শুরু।
ডিনার তখনও ভেরি মাচ অন। মৃদু শাসন কানে ভেসে এল-'ডোন্ট এভার শ্যুট, হোয়েন সামওয়ান ইজ ইটিং!' বক্তা সুনীল মনোহর গাভাসকর। কী সত্যি,অথচ সহজ কথা! খাওয়ার সময় ক্যামেরার শাসন তো একপ্রকার 'পানিশেবল অফেন্স!' আজও কথাটা সযত্নে মেনে চলি। এদিকে খোশ-আড্ডায়, ঠাট্টায়, বিগত ইতিহাস, বিগত ঝগড়া, বিগত সাফল্যের সতীর্থরা বলছে- ' বন্ধু কী খবর বল, কত দিন দেখা হয় নি!'
অটোগ্রাফ নিচ্ছেন কপিল দেব
এই জমায়েত তো কত দিন আগে হওয়ার! এই সাফল্য শ্যাম্পেনে চুমুক তো এক প্রজন্ম আগে দেওয়ার কথা! অনেকগুলো ব্যস্ত বছর পার করে আজ ওঁরা মুখোমুখি একসঙ্গে। ফ্রেমে বাঁধানো এক শিল্পীর আঁকা রম্যচিত্র হাতে ক্যাপ্টেন। অটোগ্রাফ করাচ্ছেন সহকর্মীদের ওই ছবিটির ওপর। কারণ ছবির বিষয়-কাপ হাতে তিনি। কপিলের বাড়ির দোলনায় কীর্তি আজাদ তখন মৃদু দুলছেন আর স্মিত হাসছেন। '৮৩র দলে না থাকলেও অজয় জাদেজাও উপস্থিত হাসিমুখে। এবার শেষের শুরু। বিদায় নেওয়ার পালা। 'হোস্ট' যেন তাঁর ব্যবহারে সবাইকে বলতে চাইছেন, এটা তোমাদের সব্বার বাড়ি, তোমাদের একসঙ্গে পেয়ে আমি পঁচিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া যুদ্ধজয়ের জন্য ধন্যবাদ দিতে চাই। আর মেহমানরা যেন বলে যাচ্ছেন,'হাম সাথ সাথ হ্যায়'। আগামীকাল কাকভোরে গোটা দল উড়ে যাবে হিথরো। সেখান থেকে লর্ডসের ব্যালকনিতে। ২৫ বছর পর, ২৫ জুন ২০০৮ আবার ওঁরা লর্ডসে। আবার ওই দলটা। ওটা কপিলের ইন্ডিয়া।
আমারও ঝাঁপ বন্ধ করার পালা। কপিলের সেক্রেটরি নাম-ধাম, কোন হোটেলে আছি, কীভাবে ভিডিও ফুটেজটা সংগ্রহ করবেন জেনে নিলেন। ক্যাপ্টেন এসে বললেন 'আপ ডিনার জরুর করকে যাইয়েগা।' আবদার করে বলে বসলাম- আপনার একটা 'বাইট' পেলে খুব ভাল হয়। রাজি হয়ে গেলেন। গেটের বাইরে অপেক্ষারত সহকর্মী দেবাশিস সেন-কে ডেকে আনা হল। সারা হল অনেক না বলা কথায় ভরা সাক্ষাৎকার। তারপর পার্টির হোস্টের তত্বাবধানে এক 'উমদা' ডিনার। 'হরিয়ানার হ্যারিকেন'-এর সৌজন্য আর আতিথেয়তার ঝড়ে উড়তে উড়তে তখন আমরা ভাসছি সাতওয়া আসমানে!
পরে অনেক ভেবেছি। স্পন্সরমুখী, বিপণনমুখী 'সব কুছ বিকতা হ্যায়'- মার্কা 'মেড ইন ইন্ডিয়া'-য় এই পার্টিটাও নিশ্চয় দারুণ একটা 'কমোডিটি' হতে পারত। কিন্তু হতে হতে দিলেন না কপিল দেব ও তাঁর কমরেডরা। কেন গোপনীয়তার মোড়কে আদরে মুড়ে রাখা হল এই সম্মেলন? আসলে ওঁরা হয়ত এখনও বিশ্বাস করেন, পৃথিবীতে এমন অনেক কিছু আছে যেগুলো সযত্নে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে হয়। 'দোস্তি' শব্দটারও একটা সুন্দর মানে পেলাম। আর দেখলাম, এই সব কিছুর নায়ক যিনি, তাঁর নায়ক হয়ে ওঠার নেপথ্যের মানুষগুলোর সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়া, সম্পর্ক। যার জোরে তিনি এই তথাকথিত প্রচারের লোভ সংবরণ করার শক্তি পেয়েছিলেন সেদিন। এটা করতে অদম্য দম লাগে। যে দম-এর নাম কপিল দেব নিখাঞ্জ। আমাদের পোড়া দেশে যার চওড়া হাসিতে অভয় পেয়ে আসমুদ্রহিমাচল এক স্বপ্ন দেখতে-দেখতে কখন যেন একটা খেলাকে ধর্মে পরিণত করে ফেলল।
আমরা যারা আশির দশকে বড় হয়েছি, তাদের মিডল স্ট্যাম্পে কপিল আর বাউন্ডারিতে সুনীল। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং, টেলিমিডিয়া, ঝিনচ্যাক জীবনযাত্রা থেকে 'মিলো দূর' থাকা আমাদের কৈশোরের ভারত। ফেলুদা,ডাকপিওন,চুইংগাম,কলিংবেল,ফুলন দেবী, দূরদর্শন, অল ইন্ডিয়া রেডিও ভরা আমাদের জীবনে '৮৩ ছিল চেটেপুটে, চুষে-চিবিয়ে খাওয়া একমাত্র তৃপ্তির নাম।
এসব শুনে আমার এক বিশ্বনিন্দুক বন্ধু ব্লল-'ধুস,সব নিউমারোলজি, বুঝলি? আসলে ৮ আর ৩ হল ১১। ভারতীয় ক্রিকেটে ১৯৮৩ আর ২০১১ বিশ্বকাপের বছর। শেষ দুটো সংখ্যা ১১। আর এবারও ১১। এবারও তাই হবে।'
আমি বললাম, ১ আর ৫ যোগ করলেও ১১ হয়? চ্যাংড়ামি হচ্ছে!
ও বলল - 'তোরা না পেশাদার অবিশ্বাসী! আরে এবার একে-পাঁচে ১১ নয়, এটা হল ১১ নম্বর বিশ্বকাপ। এবারেও মেন ইন ব্লু, টিম ইন্ডিয়া।'
শুনে ভাই বলল-'কিস্যু ফলো করো না! ট্যুইট-এ ক'জন ফলোয়ার তোমার? হ্যাসট্যাগ ওন্ট গিভ আপ (#won'tGiveUp) শোনোনি?' ভ্যাবলা মুখে ক্যাবলা হয়ে বসে গেলাম ডিজিট্যাল মার্কেটিং চোস্ত 'ট্যুইটার কিং' ভাইয়ের সামনে।
রাজ্য সরকার ৭৫ মাইক্রনের নিচে সমস্ত প্লাস্টিক ক্যারি ব্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞার বাস্তবায়নের অনেকটা নির্ভর করছে আমার আপনার ওপরে। পলিথিন ক্যারিব্যাগ ছাড়া একটা বাজার করতে যাওয়ার কল্পনা করুন। ততক্ষণ অন্য একটা বিষয় নিয়ে একটু কথা চলুক যেখানে এই ব্যানের বাইরে ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিক। যথেষ্ট ভাবে, যথেচ্ছ ভাবে। তা পড়েই থাকে আমাদের চোখের সামনে। আপাতভাবে দূষক বলে মনে হয় না তা। ফেস মাস্ক।
যে ডিস্পোসিবেল মাস্কগুলো সাধারণত আমি আপনি পরছি কিংবা মেডিকেল গ্রেড সার্জিকাল মাস্ক- সেগুলো সবই পলিপ্রোপিলিন প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি। যখন সেই প্লাস্টিক ছোট ছোট টুকরো হয়ে যায়, তখন এটি পচে যেতে বা ডিকম্পোজে হতে প্রায় ৪৫০ বছর সময় লাগতে পারে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য কাপড়ের মুখোশগুলো (reusable cloth face mask) আরও পরিবেশ বান্ধব বা ইকো ফ্রেন্ডলি।
ধরুন আপনি মর্নিং ওয়াক এ গিয়ে মাটিতে একটি মাস্ক দেখতে পেলেন। প্লাষ্টিক হলে হয়ত আপনি হাত দিয়ে সরিয়ে দেবেন কিন্তু খুব কম লোকই মাস্ক তা স্পর্শ করতে চাইবে। সবাই ভাববে যে কোনও সম্ভাব্য ভাইরাস-ভরা শ্বাসকে রক্ষা করেছে ওই মাস্কটি । তাই এটি উড়ে না যাওয়া পর্যন্ত সেখানেই পড়ে থাকে। রাস্তা ঘাট , মুদি দোকান, বাজার থেকে শুরু করে, পার্কিং স্পেস , নদী এবং সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে ল্যান্ডস্কেপকে দূষিত করে তুলছে ফেস মাস্ক।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ১.৫ বিলিয়নেরও বেশি ফেস মাস্ক ২০২০তে মহাসাগরে পড়েছে, যার ফলে অতিরিক্ত ৪৬৮০ থেকে ৬২৪০ মেট্রিক টন সামুদ্রিক প্লাস্টিক দূষণ হয়েছে। বিশ্বব্যাপী, প্রতি মাসে প্রায় ৬৫ বিলিয়ন গ্লাভস ব্যবহার করা হয়। ফেস মাস্কের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ - মাসে ১২৯ বিলিয়ন। অর্থাৎ প্রতি মিনিটে প্রায় ৩ মিলিয়ন ফেস মাস্কের ব্যবহার হচ্ছে। আর একটি সমীক্ষাতে বলছে প্রতিদিন ৩.৪ বিলিয়ন ফেস মাস্ক বা ফেস শিল্ড বাতিল করা হয়। এর মধ্যে এশিয়া প্রতিদিন ১.৮ বিলিয়ন মাস্ক নষ্ট করে। সারা বিশ্বের নিরিখে এই পরিমাণ যেকোনও মহাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশ্বের বৃহত্তম জনসংখ্যা (১.৪ বিলিয়ন) সহ চীন প্রতিদিন প্রায় ৭০২ মিলিয়ন ফেস মাস্ক বাতিল করে।
আমাদের রাজ্যে ৭৫ মাইক্রনের নিচে সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহারে আপাতত দোকানদারদের ওপর ৫০০ টাকার জরিমানা ধার্য করা হয়েছে। আর ক্রেতাদের জন্য জরিমানা ৫০টাকা। পিসিবি ১০২৬টি ক্যারিব্যাগ প্রস্তুতকারক সংস্থাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। পিসিবি, হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যাল এবং আইভিএল ধানসেরি পেট্রোকেমিক্যালকে নির্দেশ দিয়েছে যাতে পাতলা ক্যারিব্যাগ প্রস্তুতকারক সংস্থা গুলিকে প্লাস্টিকের দানা তারা বিক্রি না করে।
এবার শুরুর কথায় ফিরি। আপনার একটা সকাল। আপনার একটা বাজার করা প্লাস্টিক ক্যারি ব্যাগ ছাড়া ভাবতে পারেন কি?
আলবাত পারেন।
শাক সবজির জন্য বাড়ি থেকে কাপড়ের ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন।
মুদিখানার জন্যও আলাদা একটা ব্যাগ।
আর সবচেয়ে চিন্তা যেটা ভাবছেন সেই মাছ বা মাংসের জন্য ব্যবহার করতে পারেন টিফিন বক্স ।
কে বলে পলিথিন ক্যারিব্যাগ ছাড়া বাঁচা যায় না!
বরাভূমের ‘বাহা সাঁদেশ’
এই লেখাটির জন্য অশেষ কৃতজ্ঞতা সপ্তর্ষি
বৈশ্যকে। লেখা পড়ার আগে দেখে নিন ভিডিওটা। চলুন একটু ঘুরে আসি আমার বেড়ে ওঠার সুন্দরী জেলাটায়।
প্রকাশিত লেখার লিঙ্ক
বিটের মূল, নিমের পাতা, আর
পলাশের ফুল। এইটুকুই সম্বল। সেই বিট, নিম আর পলাশের নির্যাস দিয়ে প্রথমবার ‘বাহা
সাঁদেশ’ আবির তৈরি করেছেন পুরুলিয়ার বিরহড় জনগোষ্ঠীর মহিলারা। সাঁওতালি ভাষায়
‘বাহা’ হল ফুলের উৎসব, আর ‘সাঁদেশ’ মানে খবর। এবারের দোলে ওঁদের এই আবিরের ৫০ কিলো
নিঃশেষিত হয়েছে প্যাকিং করার মাত্র ১৭ ঘণ্টা ৫৫ মিনিটের মধ্যে! ওঁদের স্বনির্ভরতার
লক্ষ্যে কাজ করেন যাঁরা, তাঁরাও হতবাক আবিরের এহেন জনপ্রিয়তায়। তাই আবার জোরকদমে
শুরু হয়েছে আবির তৈরির তোড়জোড়। ২০০ গ্রাম ৭০ টাকা আর ৪০০ গ্রামের প্যাকেট ১৪০
টাকা। পাওয়া যাচ্ছে পুরুলিয়া, বলরামপুর বাগমুণ্ডি, বালি, বেলুড়, উত্তরপাড়া
দক্ষিণেশ্বর আর উত্তর কলকাতার সমস্ত মেট্রো স্টেশন চত্বরে। আবির চেয়ে ফোন আসছে
কাটোয়া, বর্ধমান আর উত্তরবঙ্গ থেকেও।
পলাশ- পুরুলিয়ার প্রাইড |
বিট বেটে অযোধ্যা পাহাড়ের ঢালে শুকনো হচ্ছে রোদে |
সবজি বাজার থেকে বিট কিনে তা
কেটে, তারপর বেটে রোদে শুকিয়ে তৈরি হয়েছে বিটের আবির। জঙ্গলের নিম গাছে পাতা বেটে
নিমের বাহা সাঁদেশ। আর পুরুলিয়ার গর্ব পলাশ ফুল দিয়ে তৈরি হয়েছে পলাশের আবির। তবে
সেক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশিকা অক্ষরে-অক্ষরে মেনে একটাও পলাশ ফুল গাছ থেকে পাড়েননি
বিরহড় মহিলারা। গাছের তলায় ঝরে পড়া রক্তিমাভ পলাশ কুড়িয়ে এনে জলে সেদ্ধ করে
মিক্সার গ্রাইন্ডারে পিষে আবির তৈরি করেছেন ওঁরা। এই সব কাজের কারিগরি প্রশিক্ষণ ও
খুঁটিনাটি ওঁদের হাতে ধরে মহিলাদের শিখিয়েছেন ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত
প্রিয়াঙ্কা ভট্টাচার্য। তিনি বলছেন, “পিছিয়ে পড়া, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আবেগের
সুড়সুড়িকে মূলধন করে নয়, বরং গুণমানে বাজারের অন্যান্য ভেষজ আবিরের সমকক্ষ হয়েই
যাতে নিজের স্থান করে নেয় বাহা সাঁদেশ, সেটাই আমাদের লক্ষ্য ছিল”।
মৈত্রেয় ফাউন্ডেশনের সপ্তর্ষি বৈশ্য কলকাতার মানুষ হলেও ইদানিং
নিত্যযাত্রীর মতই তাঁর আনাগোনা বিরহড় ডেরা বেড়সা গ্রামে। তিনিই বলছিলেন, “বাহা
সাঁদেশ বিক্রি করে যে অর্থ উপার্জন হচ্ছে, তা জমা হচ্ছে ওই মহিলাদের
স্বনির্ভরগোষ্ঠীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। আর লাভের একটি অংশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে ওই
মহিলাদের ব্যবসার ভবিষ্যৎ মূলধন। যাতে ওঁরা পরবর্তীকালে এই ধরনের কাজ করতে গিয়ে
কারও মুখাপেক্ষী না হন। এমনকী আমাদের সাহায্য ছাড়াও ওঁরা যাতে প্রকৃত পক্ষেই
স্বনির্ভর হতে পারেন। এটাই এখন আমাদের মূল উদ্দেশ্য।"
জলে ফুল সিদ্ধ করার পর ছাঁকা হচ্ছে পলাশ ফুলের নির্যাস |
বসন্ত ঋতুরাজ। সে তার সেরা সম্ভার হেলায় পথে ছড়িয়ে বীর সন্ন্যাসীর
মতো হেঁটে চলে যায় নীল দিগন্তে। অযোধ্যা পাহাড়ের ঢালে সদ্য নির্মিত নীলরঙের কিছু বাড়িতে
এখন প্রান্তিক, আদিম এই বিরহড়দের ডেরা। এবারের বসন্তে ঝরে পড়া অরণ্যের সম্পদ ফুল পাতা
দিয়ে বসন্তের রঙ বানিয়ে ওঁরা হাজির আমার আপনার সঙ্গে রঙমিলান্তির খেলাতে। ওঁদের তৈরি
এই রঙ যেন আমাদের মর্মে, কর্মে আর যাওয়ার পথে এগিয়ে যেতে লাগে! তাই কি ফুল ফুটিয়েছে
পুরুলিয়ার পাহাড়তলির পলাশবন?
এবার দেখুন ভিডিও যেটা প্রকাশিত হয়েছে টিভি নাইন বাংলা ডিজিট্যালে
পোয়াবারো- ঘি
পোয়া
ফেসবুকের গ্রুপ
কলকাতার নকশি কথা দারুণ। এই গ্রুপের মেম্বারদের অনেকেই কলকাতা ও তার আশেপাশের অনেক
বিষয় নিয়ে পোস্ট দিয়ে থাকেন। তাই এই লেখার জন্য তাঁদের জানাই কৃতজ্ঞতা।
প্রকাশিত লেখাটির
লিঙ্ক
দোল রঙের উৎসব, মিষ্টিরও। মঠ,
বাতাসা, লাড্ডু, সন্দেশ, নাড়ু, খাজা, গজা, জিলিপি, পায়েস, পেঁড়া, ছানা, দই,
ঠাণ্ডাইয়ে মাখামাখি হয়ে বসন্ত যখন জাগ্রত হয় প্রতিবার, তখন ভিড় জমে বৌবাজারের এই
ছোট্ট দু’টি দোকানে। ‘শ্রীহরি’ আর ‘রাধারানী সুইটস’। যেন রাধামাধব আর বৃন্দাবন
বিলাসিনী রাইয়ের যুগলবন্দি। দোল থেকে পঞ্চম দোল—প্রতিবছর মানুষের ঢল নামে দোকান
দু’টোয়। হোলির সময়ে এক বিশেষ মিষ্টি পাওয়া যায় এখানে। শতবর্ষ পার হয়ে গিয়েছে, তবুও
একই রকম জনপ্রিয়তা এই দোকানের এই বিশেষ মিষ্টির। নাম ‘ঘি পোয়া’। প্রতি পিসের দাম
মাত্র ৬টাকা। চেনা শহরের অচেনা এই মিষ্টির খোঁজ দিচ্ছে TV9 বাংলা। চেনা শহর
কল্লোলিনী কলকাতার অচেনা এই মিষ্টি দেখতে হুবহু আলুর চপের মতো। ভাজা হয় খাঁটি গব্য
ঘিয়ে।
বৌবাজার, নতুনবাজার, বেহালা আর উত্তর কলকাতার তামাম বনেদি বাড়িতে এই
মিষ্টি ছাড়া দোল অচল। কলকাতার বনেদি বাড়িগুলিতে দোল গোবিন্দের আরাধনায় ভোগ নিবেদন
হয় ঘি পোয়া দিয়ে। দোল থেকে পঞ্চম দোল ঘি পোয়া ছাড়া প্রসাদ নাকি মুখে রোচে না বনেদি
বাড়ির ননীচোরার। তাই সারা শহরে উত্তর থেকে দক্ষিণ যত প্রাচীন বাঙালি বাড়ি আছে,
তাঁদের কাছে দোলের এক ঐতিহ্যের সমার্থক হয়ে উঠেছে এই ঘি পোয়া। রজত পাইন বৌবাজারে
থাকেন। তিনিই বলছিলেন ঘি পোয়ার এই ট্রাডিশানাল ক্রেজের কথা। দেবমাল্য শীল প্রতিবছর
এই মিষ্টির টানে ফিরে-ফিরে আসেন এই দোকানে। দোলের চাঁচড়ের পুজোয় সঞ্জীবকুমার
মল্লিকের বাড়িতে পুজো হয়। তার জন্য দু’দিন আগেই তিনি এসে বায়না করে গিয়েছেন ১৫০
পিস ঘি পোয়া, জানালেন শ্রীহরি সুইটসের মালিক কৃষ্ণ গুপ্তা। দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে
তিনি অনবরত গাওয়া ঘিয়ে ভেজে চলেছেন এই ঘি পোয়া। হালুইকরদেরও ফুরসত নেই। জানালেন
তিন প্রজন্ম ধরে চলে-আসা এই ঘি পোয়ার রেসিপি। চালের গুঁড়ো, সুজি, গুড় আর ঘি দিয়ে
মেখে মণ্ড তৈরি করা হয়। তারপর হাতের তালুর চাপে চ্যাপ্টা করে গরম ঘিয়ে ভাজা হয় সেই
মণ্ডের পোয়া।
কলকাতার বাঙালি বনেদি বাড়িতে
দোলে গোপাল সেবায় মাস্ট এই মিষ্টি। আর লাগে মালপোয়া। শ্রীহরি সুইটসের পাশের দোকান
রাধারানী সুইটসের নরেশ গুপ্তা বলছিলেন ঘি পোয়ার যোগ নাকি ওড়িশায়। শ্রীক্ষেত্র
জগন্নাথধামে ছাপান্ন ভোগের এক ভোগ এই ঘি পোয়া। জগন্নাথের উৎকল থেকে এই খাদ্য
সংস্কৃতির আগমন এই বাংলায়। তা-ও শতাব্দীকাল আগে।
পূর্ণিমায় দোল গোবিন্দর ভোগের জন্যই এই মিষ্টির চাহিদা এখন তুঙ্গে।
আপনিও যদি চান, চেখে দেখতে চলে আসুন বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রীটের বৌবাজার
মার্কেটের সামনের এই দোকান দু’টোয়। গরমাগরম ঘি পোয়া প্রতি পিস মাত্র ৬ টাকা। মুখে
দিয়েই বৃন্দাবনের বিলাস। তবে সাবধান, এটা খাবার পর ঠাণ্ডা পানীয় খাবেন না। গরম চা
কফি চলতে পারে। খাঁটি ঘিয়ে তৈরি তো, তাই ঠাণ্ডা খেলে বিপত্তি ঘটতেই পারে!
ঘুম-ON
এই ত্রয়ীর অন্তিম
লেখা ওয়ার্ল্ড স্লিপ ডে বা বিশ্ব নিদ্রা দিবস নিয়ে। যাঁদের ঘুম নিয়ে সমস্যা তাঁদের
কাজে লাগতে পারে এই লেখাটা। কৃতজ্ঞতা জানাই
সেলিমপুরের সোমনস স্লিপ ক্লিনিকের ডাঃ সৌরভ দাসকে আর অরেঞ্জ স্লিপ অ্যাপনিয়া ক্লিনিকের
ডাঃ উত্তম আগরওয়ালকে।
প্রকাশিত লেখার লিঙ্ক
https://tv9bangla.com/health/important-facts-about-sleep-you-need-to-know-529981.html
আজ বিশ্ব ঘুম দিবস। ঘুম হেলাফেলার বিষয় নয়। সারা দুনিয়া জুড়ে চিকিৎসকরা
বলছেন ঘুম সম্বন্ধে সচেতন হতে। আর সেই কারণেই ওয়ার্ল্ড স্লিপ সোসাইটি বলছে ঘুমের গুণগত
মান ভাল হলে মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটে যা তৈরি করে একটা সুন্দর পৃথিবী। আমাদের প্রতিদিনের
কাজে আমরা সম্মুখীন হই বহু ঘটনার। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলি রয়ে যায় স্মৃতিতে।
এই স্মৃতিশক্তি তৈরিতে ঘুমের ভূমিকা অপরিহার্য। সুস্থ ভাবে বাঁচার জন্য সুন্দর ভাবে
ঘুমনোটা জরুরী। কিন্তু কেমন ভাবে আসবে সুখের সেই সুস্থ ঘুম? কিন্তু কেমন ভাবে আসবে
সুখের সেই সুস্থ ঘুম?
কলকাতার দুজন চিকিৎসক ডাঃ সৌরভ
দাস এবং ডাঃ উত্তম আগরওয়াল আমাদের জানালেন কী কী করলে আসবে SOUND SLEEP
শোওয়ার ঘরটিকে করুন যতটা সম্ভব নিঃশব্দ ও অন্ধকার ঘুমোতে যাওয়ার আগে
ফোন সাইলেন্ট বা এয়ারপ্লেন মোডে রাখুন বিছানার চাদরটাকে টানটান ও পরিষ্কার করে নিন
ঘুমের আগে অল্প উষ্ণ গরম জলে স্নান করলে ভাল ঘুম আসে সন্ধ্যের পর চা, কফি বা নরম
পানীয় খাবেন না, ধূমপান একদমই নয়। এই নিয়ম মানতে পারলে ভাল ঘুম আসবেই । পরের দিনের
করণীয় কাজের তালিকা কাগজে লিখে রাখুন আর সেই দিন কী করলেন তাও লিখুন ঘুমোতে যাওয়ার
আগে। দেখবেন চিন্তা মুক্ত ঘুম আসবে । রাত্রের দিকে কম জল খাওয়া অভ্যাস করুন। দিনে
বেশি জল খান। ডিনারের পর অল্প অল্প সিপ করে জল খান ঘুমোতে যাওয়ার আগে টয়লেট করে
শুলে রাত্রে অযথা ঘুম ভাঙবে না বেডরুমে ঘড়ি এমন ভাবে রাখুন যাতে বিছানায় শুয়ে ঘড়ি
দেখা যাবে না। তাই ঘড়ি দেখে ঘুম না আসার অস্থিরতাও থাকবে না। এতে করে ঘুমের ব্যাঘাত
ঘটবে না।
চিকিৎসকরা বলছেন অনিদ্রা বা অতিনিদ্রা দুটোই শরীর খারাপ হওয়ার কারণ
হতে পারে।
তাই জেনে নিন কতটা ঘুমনো উচিত একজন সুস্থ মানুষের। কমপক্ষে কতটা ঘুম
দরকার কোন বয়সের মানুষের –
সদ্যজাতদের জন্য- ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা প্রাইমারি ক্লাসে পড়ুয়াদের জন্য –
১০ থেকে ১২ ঘণ্টা সেকেন্ডারি ক্লাসের পড়ুয়াদের জন্য – ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা প্রাপ্ত
বয়স্কদের ৭-৯ ঘণ্টা
অনেকে ভোরে ট্রেন বা ফ্লাইট ধবার চিন্তায় সারারাত ঘুমোতে পারেন না।
সেক্ষেত্রে কীভাবে অ্যালার্ম দিলে ভাল ঘুম হয় ?
ডাক্তারবাবুরা বলছেন এক্ষেত্রে যদি ভোর ৫ টায় উঠতে হয় তাহলে অ্যালার্ম
দিন আগের দিন বিকেল ৫ টায়। আর তারপর সব কাজ রাত ৮টার মধ্যে মিটিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে
যান ।
যারা রাতের শিফটে কাজ করেন তাঁদের ঘুমোতে হবে সকালে। আর সেই ঘুমটাকেও
দিতে সমান গুরুত্ব। ভারি পর্দা ঝুলিয়ে রেখে ঘরটাকে অন্ধকার রাখতে হবে । ঘুমোতে
যাবার এক ঘণ্টা আগে থেকে চলবে না সেলফোন বা অন্য কোনও ডিভাইজ ব্যবহার করা।
বাঙালি নাকি ঘুমকাতুরে! তার নাকের ডাকে নাকি কাক চিল বসে না বাড়িতে।
সারা বাংলা জুড়ে একটা সমীক্ষা চালিয়ে ডাঃ সৌরভ দাস জানাচ্ছেন সামগ্রিকভাবে বাঙালির
ঘুমের মান কেমন? আর সেই সমীক্ষার ফল হতাশ হবার জন্য যথেষ্ট। ডাঃ দাস বলছেন
সামগ্রিক ভাবে বাঙালির ঘুমের মান খুবই খারাপ। আর ষাটোর্ধদের ক্ষেত্রে সেটা আরও
খারাপ হয়ে সংকটজনক অবস্থায় এখন।
এই মুহুতের পৃথিবীতে ৮০ টিরও বেশি স্লিপ ডিজঅর্ডারের খোঁজ দিয়েছে
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান। যার মধ্যে সংগীত শিল্পী বাপ্পি লাহিড়ী র অকাল প্রয়াণের
কারণে সচেতনতা এসেছে স্লিপ অ্যাপনিয়ার ক্ষেত্রে । বাপ্পির মৃত্যুর পর থেকে ভিড়
বাড়ছে শহরের স্লিপ ক্লিনিক গুলোয়। কোথাও হয়ত দেরিতে হলেও হয়ত আসছে সচেতনতা । আর এই
সচেতনতাটা সারা বছর জারি রাখতেই আজকের এই বিশ্ব নিদ্রা দিবস । তাই কোনও কারণে ঘুমে
ব্যাঘাত ঘটলেই ডাক্তারবাবুর কাছে যান। গুরুত্ব দিন ঘুমকে । শুধু আজ নয় আজীবন।
Disclaimer: এই প্রতিবেদনটি শুধুমাত্র তথ্যের জন্য, কোনও ওষুধ বা
চিকিৎসা সংক্রান্ত নয়। বিস্তারিত তথ্যের জন্য আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
এবার দেখুন ভিডিও যেটা প্রকাশিত হয়েছে টিভি নাইন বাংলা ডিজিট্যালে
আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসের সকালে কোয়েল একটা ফেসবুক পোস্ট দেখাল। এক বৃদ্ধা নবান্নের কাছেই কংক্রিটের ওপরে পথের ধুলোয় পড়ে রয়েছেন। ছবিটা দেখে মনে হল এটা নিউজ মেটিরিয়াল। এক অশক্ত বৃদ্ধা। চোখ গুলো কেমন করুন। অফিসে যাবার জন্য বাইক স্টার্ট দেওয়ার আগে রক্তিমকে জানালাম বিষয়টা।
- এটা করে তবে অফিস এসো। কী বিষয় পুরোটা দেখো। এটাই স্টোরি।
দেখা শুরু হল আমার।
তার পরবর্তী গল্প সবার জানা। সে গল্পের অবতারনা এখানে নয়।
আমাদের কাছে সেই খবর পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়। পথ ভোলা পথিক নাকি সন্তান পরিত্যক্তা? প্রশ্ন উঠেছিল হাওড়ার শিবপুর, মন্দিরতলা এবং নবান্ন অঞ্চল জুড়ে মানুষের মধ্যে। মঙ্গলবার রাত্রেই মন্দিরতলার একজন বললেন- পুলিশ নিয়ে গেছেন ওই বৃদ্ধাকে।
বুধবার সকাল সকাল ফোন করলাম হাওড়া সিটি পুলিশের শিবপুর থানার ওসি অরূপ বাবুকে। তিনি জানালেন সুরক্ষিত আছেন ওই বৃদ্ধা। এখন ভর্তি রয়েছেন হাওড়া জেলা সদর হাসপাতালে।
বুধবার বেলা ১১টা- হাওড়া জেলা সদর হাসপাতালে নবান্নের ফুটপাথে পড়ে থাকা মাকে। একটা বিছানা জুটেছে তাঁর। আর পথ নয়। ঘুমোচ্ছেন অনেকটা স্বস্তিতে। বৃদ্ধা এখনও নিজের পরিচয় ঠিকঠাক জানাতে পারছেন না চিকিৎসক ও চিকিৎসা কর্মীদের। ফিমেল মেডিক্যাল ওয়ার্ডের খাতায় উনি ‘আন নেমড’। আপাতত পরিচয় একটাই - বেড নম্বর এক্স ৬৫।
চরম ব্যস্ততা ডাক্তার বাবুদের। একজন পেসেন্ট ঢুকেছেন। পয়জনড কেস। তাঁর স্টম্যাক ওয়াশ পর্ব চলছে। তার মধ্যেই একজন চিকিৎসক জানালেন কেউ একজন এসেছিলেন যিনি ওনাকে নিজের মা বলে দাবি করেছেন। ওয়ার্ড থেকে বলা হয়েছে ওই ব্যাক্তিকে নিজের পরিচয় পত্র এবং প্রমাণাদি এনে যোগাযোগ করতে। হাসপাতাল সুপার ডাঃ নারায়ণ চট্টোপাধ্যায় এর সঙ্গে কথা বললাম। অনুরোধ করলাম যদি কেউ আসেন একবার যেন আমায় জানানো হয়। আর একবার গেলাম বেড নম্বর এক্স ৬৫ র কাছে। তখন তিনি ডাল, সয়াবিনের তরকারী আর মাছের ঝোল দিয়ে পরম তৃপ্তিতে ভাত মেখে খাচ্ছেন।
শিবপুর থানায় গেলাম। তারপর ওই নীল সাদা থাম। নবান্নের কাছে। যে স্তম্ভগুলির নীচে হতভম্বের মত বসে ছিলেন ওই বৃদ্ধা।
বিকেল গড়াতে না গড়াতেই ফোন ঢুকল ডাঃ নারায়ণ চট্টোপাধ্যায় এর। বেড নম্বর এক্স ৬৫ র বাড়ির লোক এসেছেন। জানালাম আমি আসছি ওঁদের একটু অপেক্ষা করতে বলুন।
তারপর এল বৃদ্ধার ছেলের ফোন। ওনারা আমি গেলে আমার সঙ্গে কথা বলে তবেই মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন।
সন্ধ্যা নেমেছে হাওড়া সদর হাসপাতাল চত্বরে। জানা গেল পরিচয়। দুই ছেলে এসেছেন মা কে নিয়ে যেতে। ৭ মার্চ থেকে মা নিখোঁজ। বড় ছেলে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করেন। ৭ তারিখ সকালে একটু দেরিতে ফিরেছেন। ছোট ছেলের রঙিন মাছের ছোট্ট ব্যবসা। কাজের জন্য তাঁকেও বেরোতে হয়েছে। বড় ভাই বাড়ি ফেরার আগেই বেরিয়ে যান ছোট ভাই। দুই ভাই আর মায়ের সংসার। তাই ওই সময়ে মা একলাই ছিলেন। মানসিক অবস্থা বয়সের কারণে একটু বিঘ্নিত। কানে কম শোনেন।
বাড়ি খালি দেখে মা বেরিয়ে পড়েন বাড়ি থেকে। নিরুদ্দিষ্টের গন্তব্যে। তারপর হন্যে হয়ে দুই ভাই মা কে খুঁজেছেন। ব্যাটরা থানায় মিসিং ডায়েরিও করেছেন। খুঁজে পান নি মাকে।
তারপর আমদের ওই প্রতিবেদন। তা দেখে বৃদ্ধার ছোট ছেলেকে জানান তাঁর এক বন্ধু - মা রয়েছেন নবান্নের ফুটপাথে।
ছেলে আসেন নবান্নের সামনের পুলিশ আউটপোস্টে। সেখান থেকে শিবপুর থানা হয়ে সদর হাসপাতালে।
খুঁজে পান মাকে। পুরো প্রক্রিয়াটায় আমরা রয়ে গেলাম একটা ছোট্ট যোগসূত্র হয়ে। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিলেন ছেলেরা। জানতে চাইলাম বৃদ্ধার পরিচয়। ওঁদের বাবা প্রয়াত সুভাষ চন্দ্র বোস। আর মা?
বেড নম্বর এক্স ৬৫ নয়। অনিলা। অনিলা বোস।
ওঁরা তিন জন ধীরে ধীরে হেঁটে বেরিয়ে আসছেন। ছোট ছেলে সুশান্তকে জিজ্ঞাসা করলাম
- কিসে নিয়ে যাবেন মাকে? টোটো ডেকে দেব?
-না দাদা বাসেই যাব। টোটো আশি টাকা চাইছে। অত টাকা কোথায়! বাসে যাব, একটু তো পথ। পৌঁছে যাব।
তিনজন, অ্যাম্বার রঙের পথে মৃদু হেঁটে যাচ্ছেন, নীল রঙের আলোয় লেখা হাওড়া জেলা হাসপাতালের গ্লোসাইনটা জ্বলজ্বল করছে। বাড়ি ফিরছেন যিনি, উনি অনিলা।