এটা একটা ২ বছরের পুরনো লেখা
পুরনো চাল নাকি ভাতে বাড়ে!
বড় বড় জুঁইফুলসাদা ভাত রুপোর কাঠি
হলুদ জাফরানরঙা ভাত সোনার কাঠি
এক বীরন্ন রূপকথা
বাতাস বিরিয়ানভি
পথেই হবে যে পাত চেনা
চলতে চলতে মানুষ চালাক হয় কি না জানা নেই, কিন্তু চালক হয় আর চালু হয়। চালের দানা আর চুলোর আগুন খুঁজতে খুঁজতে চালু হয়। চালু মানে ইজি, চালু মানে জীবনে বা হোয়াটসঅ্যাপের স্ট্যাটাসে “অ্যাভেলেবেল” হয়। চুলোয় জ্বলতে থাকা আগুনেরও তো চাই চালের দানা। তাই চালু পথ গন্তব্য বেঁধে দেয়। পাতের যোগানে পথেই নামে যে রোজ, তার জীবন আর সেই পথের বাঁকেই অজান্তে কোথাও হয়ে যায় পাত চেনা। প্যারডিতে সলিল গেয়ে ওঠেন “পথে এবার নামো সাথি পথেই হবে যে পাত চেনা”। আমার শহর
কলকাতায় তো আসলে লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য কোল পাতা। যারা সকালে উঠে এ শহরে আসেন আর রাত্রে বহুদূর মফস্বলের বাড়িতে ফেরেন। রোজকার লোকাল ট্রেনের অ্যাম্বার আলোমাখা কালো জানলা, শেষরাতে কুকুর জাগা পাড়া আর ফাঁকা প্ল্যাটফর্মের শূন্যতা। তাঁরা যেন নিজভুমে পরবাসী। এ শহরেও তাঁরা কি বহিরাগত? এ তত্ব, এ শব্দ খাটে না এই মলিন ম্যাড়ম্যাড়ে শহরটার ক্ষেত্রে। এ শহর যেন ক্ষয়িষ্ণু রক্তাল্পতায় ভোগা এক একাকীনি মা। যিনি পাত পেড়ে ভাত বেড়ে তার সন্তানদের জন্য বসে আছেন। হাতের হলুদ মোছা আঁচলে মুখ মুছে। মুখে হাসি নিয়ে। আর তার সন্তানরা? তাদের কথা তো জানা। তাঁরা আছেন তাই এ শহর বাঁচে।
এ শহর অন্নপূর্ণা। প্রতিদিন নবান্নের প্রত্যাশায় আগুন জ্বলে এই শহরের উনোনে উনোনে। কখনও পলান্ন, কখনও ‘বীরান্ন’ বেড়ে বসে আছে তার নিত্যদিনের জীবন সংগ্রামে কখনও জিতে বা কখনও হেরে যাওয়া সংগ্রামী সন্তানদের জন্য। জীবনের বীর আমজনতার জন্য। আজ সেই বীরান্নের গল্প। যার কৌলীন্য ম্লান হয়ে গেলেও প্রলোভন প্রশ্নাতীত। পড়ে যাওয়া জমিদার বাড়ির মতই যার দম্ভ। ইত্তিহাসের মতই গৌরবান্বিত যার অতীত। শহর কি মফস্বলে একটা মাংসের দোকানের আশেপাশেই তার মন্দির, ঠেক,আড়ত বা যা খুশি বলতে পারেন। দূর থেকে লাল শালু বাঁধা হাঁড়ি যেন গ্ল্যাডিয়েটর অ্যারিনার যোদ্ধার হাতের লাল কাপড় আর আমার আপনার উন্মত্ত ক্ষুধা যেন ক্ষ্যাপা ষাঁড়। ফুঁসছে কখন বেরিয়ে এসে ‘আক্রমণ’ বলে হামলে পড়বে ওই একটা থালা ভরা সেদ্ধ চাল,আলু,ডিম আর মাংসের পারাবারে। পার পাবে না কেউ! এমন মিঠা আতর, কেওড়া জল মেশানো ঘ্রান আসছে। এক এক বার করে বিশাল ঢাকনা হাঁড়ির মুখ থেকে সরছে আর ভক ভক করে বাতাসে মিশে যাচ্ছে সেই ঘ্রান।
আমাদের লড়াইয়ের ঘাম অশ্রু, দূষণ ডিজেল, গ্রিন হাউজ বাতাসে ভারি সুন্দর লাগছে আউধি পাখওয়ানের খসবু। বাতাস ভারী হচ্ছে। বাতাস বিরিয়ানভি হচ্ছে। মেহফিল জমছে। আমাদের হেরে যাওয়া, লড়াই করা, ঘেয়ো কুকুরসম জীবনে যেন এক লহমায় টপাটপ মোমের বাতি জাগছে। জীবনের ঝাড়বাতিটা ঝাড়পোঁছ হচ্ছে রসনার আলো জ্বলবে বলে।
এ শহর খালি পেটে ফেরায় না কাউকে। পকেটের মাপ অনুযায়ী থালা ভরে ভাত বেড়ে দেয়। ক্ষ্যাপা পরশ পাথর খোঁজে ট্রামের লাইনে আর বিড়বিড় করে বলে “দানে দানে পে লিকখা রহতা খানেবালওঁ কা নাম।“ আর আমার আপনার মত কিছু মানুষের রস ও রসনায় ভর করছেন নবাব ওয়াজেদ আলি শাহর রহেমত। আমার আপনার খেটে খাওয়া শহর, লড়তে লড়তে হার না মানা শহর, ঘাম মুখ ধুয়ে রুমালে গাল মুছে প্যাকেটের আবরণ সরাচ্ছে। টালিগঞ্জ পাড়ার সহকারী টেকনিসিয়ানটি আজ টিফিন আনে নি, লাঞ্চে প্রোডাকসান বিরিয়ানি খাওয়াবে বলে। যদিও সহ অভিনেত্রিটি আগামিদিনে লিড রোল পাওয়া ও রোগা হবার বাসনায় শুকনো শসাতেই লাঞ্চ মেটাবেন। শপিং মলের সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করা মহিলা, যার হাতের শাঁখা পলা আর তার সঙ্গের শার্ট প্যান্টটা বড় বেমানান কিংবা ছোট অফিসের আরও ছোট ক্ষয়িষ্ণু কর্মী, যার তিন দিন অফিস ঢুকতে লেট হলে একদিনের পারিশ্রমিক মালিক কাটবেই আর তাতেই তার মুখ কালো। সেসব মুখে হঠাৎ হাজার ভোল্টের আলোর ঝিলিক। হলুদ, সাদা চালের আস্তরণ সরছে, যেন সোনার কাঠি আর রুপোর কাঠির ছোঁয়া লেগে চকমকি হচ্ছে। প্রকাশিত হচ্ছে সেই ‘পট মিল’ যার প্রতিশ্রুতিতে অনেক মানুষকে অপহরণের টোপও তৈরি করা যায়। বিরিয়ানি! ঝটপট সাবাড় সমস্তটা ।
কলকাতার বিরিয়ানি পাক্কি বা পাক্কা বিরিয়ানি। ঢাকায় কাচ্চি বাঁ কাসসির চলটাই বেশি। বিরিয়ানি বিশেষজ্ঞ বা খাবার বিশারদরা যদিও বলেন বিরিয়ানি হয় গরুর মাংসেই। বাকিসব মাংস মিশ্রিত ভাতই নাকি পোলাও! বাংলাদেশে মোরগ পোলাও আসলে আমাদের চিকেন বিরিয়ানিরই নামান্তর। কোনও চিনা যেমন কলকাতার পথ চলতি সার্বজনীন চাইনিজ খেয়ে চিনতে পারবেন না ওটার চিন দেশে জন্ম, তেমন কলকাতার বিরিয়ানিও সময়ের প্রয়োজনে, চাহিদার যোগানে নিজের রূপ পরিবর্তন করেছে। তাই কলকাতার বিরিয়ানির নিজস্ব স্বাদ যেন স্বতন্ত্র। যেন ভৌগলিক নিশান উড়িয়ে স্বমহিমায় আসীন তার সিংহাসনে। শুধু মাটন, চিকেনেই থেমে নেই এই বিরিয়ানি। ডিম বিরিয়ানি, আলু বিরিয়ানি এমনকি পনির বিরিয়ানি পর্যন্ত পাওয়া যায় বাজারে। আয়তন অনুযায়ীও বিরিয়ানির হেরফের এ শহরের সিগনেচার। মুম্বাইয়ে কাটিং চায়ে পাওয়া যায় বলে যারা নাক সিটকান তাঁদের অবগতির জন্য সবিনয়ে বলি আমার আপনার শহর ‘হাফ প্লেট’ বিরিয়ানিও অফার করে। পুরানো দিল্লীর দরিয়াগঞ্জের যে মসজিদটি আছে তার আশেপাশে ওজন করে পাওয়া যায় কাবাব ও বিরিয়ানি। সেই সংস্কৃতিও এখন ধীরেধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে কলকাতায়। বিরিয়ানির চালের ব্যবহারেও এসেছে এক উল্লেখযোগ্য বদল। খুব একটা জনপ্রিয় না হলেও বাসমতীর জায়গায় গোবিন্দভোগ চালের বিরিয়ানি পাওয়া যাচ্ছে শহরের বেশ কটি ছোট বড় রেস্তোরাঁয়।
আসলে খিদে যে বড় বালাই। যে বুঝেছে সেই সম্মান করে পাতকে। সেই পাত পেড়ে ভাত বাড়ে। ক্ষুন্নিবৃত্তির চেয়ে বড় সভ্যতা বোধহয় আর কিছু নেই। সিরাজ, আমিনিয়া, আরসালান, জিশানের সম্ভ্রান্ত অন্দরমহলে ঢুকতে যাদের পিছনে টেনে ধরে ফুটো পকেট আর জীবনের হাজারো কষ্টকর আর্থিক প্রতিবন্ধকতা তাঁদের জন্যই ওই লাল শালু ঢাকনা দেওয়া টং টং ধবনি। কলকাতার নতুন অফিসপাড়া সেক্টর ফাইভে এ লাঞ্চ আওয়ারে গেলে দেখবেন যেন ধর্মতলার ফুটের সেল চলছে। একজন যুবক হাঁকছেন “শুধু ষাট শুধু ষাট” তো তার সহকারী তরুণটি “ষাট শুধু ষাট শুধু”। এক অনাবিল ক্যাকোফোনি ধ্বনিত হচ্ছে। আহ্বানের রোমাঞ্চকর সে কোরাস গীতি যেন হ্যামলিনের বাঁশি! গুটিগুটি পায়ে তথ্য প্রযুক্তি প্রকৌশলীরা আসছেন ঝুপস গুলিতে। পরিষ্কার পরিবেশে এই কোভিডোত্তর কলকাতায় ধোঁয়া ওঠা সেদ্ধ চালের ফাঁকে ফাঁকে দেখা দিচ্ছে চিকেনের লেগ পিস , মাটনের সিনা, পাঁজরা, পিছলি রানের অংশ বিশেষ। মুখেই মিলিয়ে যায় এমন চন্দ্রমুখি আলু এক চামচে ক্ষতবিক্ষত। আহ জীবন! তুমি এত কিছু রেখেছ এখনও আমার জন্য!
সময়ের সাথে সাথে বাংলায় বিরিয়ানি ক্রমে ক্রমে তার কৌলিন্য হারিয়েছে। একটা সময় যখন সারা শহরে বিরিয়ানি বলতে পার্ক সার্কাস বা আমিনিয়া, সিরাজই বুঝত বাঙালি তখন বিয়েবাড়ির ভোজসভায় শো স্টপারের ভুমিকায় অবতীর্ণ হত বিরিয়ানি। বিরিয়ানি কাটার মিস্ত্রী মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সিরাজ বা আমিনিয়া থেকে আসত বিয়েবাড়িতে। সে মিস্ত্রী শুধু কেটেই খালাশ। রান্নার দায় তার থাকত না। আজ সেই কুলীন খাদ্য তার অবস্থান থেকে অনেকটা নেমে এসেছে। সে পতন খুব একটা কম নয়। একেবারে সটান পথেই নেমেছে সে। পথে নেমে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে।
তাই তো এনআরসি (NRC)ও সিএএ(CAA) র প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক যখন অবরুদ্ধ হয় তখন সংবাদ শিরোনামে ছবি আসে – পথ জুড়ে তোড়জোড় হচ্ছে বিরিয়ানি রান্নার। প্রতিবাদের ভাষার সাথে কোথাও বিরিয়ানি মিলে মিশে একাকার। অবরোধকারিদের তুলতে এসে পুলিশও পুরো থ। এ কেমন প্রতিবাদ? একদিকে শয়ে শয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি অন্যদিকে অবরোধকারিরা রীতিমত আলু কেটে, পিঁয়াজ কেটে, চাল সেদ্ধ করে বিরিয়ানি রান্নার তোড়জোড় করছে! কোথাও রাজ সিংহাসন থেকে নেমে এসে মানুষের সাথে মিলেমিশে গেছে এই জনগণমন তান্ত্রিক খাবার।
তীব্র মহামারিতে যখন দিশাহীন মানুষ। জীবন গিয়েছে থেমে, চলে গেছে জীবিকা, আর্থিক নিরাপত্তাও বিপন্ন। তখনও মানুষের পাশে এসে তার জীবনের লড়াইয়ে হাতটা ধরেছে বিরিয়ানিই। ঘটনাস্থল মুম্বই। গত আট বছর ধরে মুম্বইয়ের বেশ কটি পাঁচতারা হোটেলে সেফ হিসেবে কাজ করেছেন অক্ষয় পার্কার। কোভিড আবহে কাজ হারিয়ে দিশেহারা অক্ষয় হেরে যান নি, দমেন নি। দাদরের শিবাজি মন্দির এলাকায় রাস্তার পাশে খুলেছেন ‘পার্কার বিরিয়ানি হাউজ’। পাঁচতারা হোটেলের স্বাদ ছড়িয়ে দিয়েছেন অলিতে গলিতে। খুলে গেছে সিমসিম! অক্ষয় ভেজ, আণ্ডা আর চিকেন বিরিয়ানির থালা সাজিয়ে দিচ্ছেন শহরবাসীদের। আধ প্লেট ৬৫ টাকা আর পুরো থালা ১৪০ টাকা দিয়ে চেটেপুটে খাচ্ছে 'আখখা মুম্বই'। অক্ষয় অর্ডার পাচ্ছেন পার্টি অর্ডারও। ভেজ বিরিয়ানি প্রতি কেজি ৮০০ টাকা আর নন ভেজ প্রতি কেজি ৯০০ টাকা। বাড়ির একমাত্র উপার্জনকারী অক্ষয় বিরিয়ানির হাত ধরে পায়ের তলায় মাটি পেলেন।
রাস্তার বাজে বিরিয়ানিরা
রাস্তার ভাল বিরিয়ানি অনেক রয়েছে। তবে যাদের জন্য বদনাম হয় পথের বিরিয়ানি তাদের হেঁশেলের উপকরণের খোঁজ একটু নেওয়া যাক এবার। চাল আধ সেদ্ধ করে রাখা হয়। তারপর মাংস হলুদ জলে সেদ্ধ করে রাখা হয়। এরপর পামোলিন তেলে মাংস কিছুটা রান্না করে বেরেস্তা (আগে থেকে ঝুরো ঝুরো করে কাটা পেঁয়াজ ভাজা), বিরিয়ানি মশলা আর ঘি ছড়িয়ে চাপা দেওয়া হয়। রাস্তার বিরিয়ানির সবচেয়ে বড় সমস্যা বা হেলথ হ্যাজার্ড হল পামোলিন তেল আর হলুদ কামধেনু রঙ। কেশরের বদলে এই ইণ্ডাস্ট্রিয়াল রঙ ব্যবহারের ফলেই রিস্ক বাড়ে ক্যান্সার সহ বহু জটিল স্নায়বিক রোগের আর পথের বিরিয়ানিও আমজনতার কাছে হয়ে ওঠে ভিলেন।
কেন বিরিয়ানি এত জনপ্রিয়
কলা আর কাঁঠাল এর মধ্যে কলা কেন জনপ্রিয় এ কথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। কলা খাওয়ায় কোনও ঝামেলা নেই। চটপট খোলো আর ঝটপট খাও। একই কথা বিরিয়ানির ক্ষেত্রেও হয়ত খাটে। একটি নির্ঝঞ্ঝাট সম্পূর্ণ খাবার। ঝোল পড়ে যাওয়ার সমস্যা নেই, কাঁটা বাছার অসুবিধা নেই। হাতটা টিস্যুতে মুছে অল্প জলে ধুয়ে নিলেই হ’ল। কোথাও যেতে যেতে গাড়িতেও খাওয়া যায়। সাথে সাইড ডিস কিছু না হলেও দিব্যি চলে। তাই তো পাতুরির চেয়ে বিরিয়ানি এত জনপ্রিয়। তাছাড়াও ডাব চিংড়ি কিংবা ইলিশ ভাপার একটা মিল এর তুলনায় একটা বিরিয়ানি দামেও সস্তা। এটাও বিরিয়ানির জনপ্রিয় হওয়ার একটা বড় কারন। একই পরিমাণ প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট আর ফ্যাট একসাথে বাজারের অন্য খাবারের তুলনায় অপেক্ষাকৃত সস্তায় পাওয়া যায় বিরিয়ানিতেই। তার ওপর এতটুকু সম্ভ্রম না কমিয়ে অপেক্ষাকৃত সস্তায় নবাবী খাবার বলতে তো বিরিয়ানিই আছে। কাজের মাঝে বা কাজ করতে করতে বিরিয়ানি খাওয়া যায় অনায়েসেই। তাই এককালের কুলীন পাখওয়ান তার কৌলীন্য হারিয়ে হয়ে জনতার দরবারে হয়ে উঠেছে জনপ্রিয় ফাস্ট ফুড।
কলকাতা বা তার আসেপাশে ফুটের বিরিয়ানির এপিসেন্টার বা হটস্পট
ডালহৌসি, স্টক এক্সচেঞ্জ এলাকার অফিস পাড়ার বিরিয়ানি। কেন্দ্র, রাজ্য সরকারি কেরানি থেকে বড়বাবু সবাই নিয়ম করে খদ্দের। বাদ যান না বেসরকারি চাকুরে কিংবা চাকরি প্রার্থীরাও।
মেটিয়াব্রুজ এলাকায় লাইন দিয়ে বিরিয়ানি খাওয়া একটা দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। মেটিয়াব্রুজের রাস্তার বিফ বিরিয়ানি যেকোনোও কুলীন বিরিয়ানিকে টেক্কা দেবে।
মমিনপুর, খিদিরপুর ওয়াজেদ আলি শাহের এলাকা অতএব এখানকার বিরিয়ানি তো প্রণম্য।
পার্কসার্কাসের সাত মাথার মোড় আর বিরিয়ানির সংযোগ যেন সাত পাকে বাঁধা। কুলীন আরসালান, আমিনিয়া, জিসানের পাশাপাশি হাজারো হাজি সাহেব পথ আলো করে, গন্ধ মম করে বসে আছে। পার্কসার্কাসে পথে ঘাটে কারনে অকারনে বিরিয়ানি বানানো যেন অর্ডার অফ দ্যা ডে।
এই অঞ্চলে ভাল গোস্ত বিরিয়ানি বা গরু বিরিয়ানি পেতে লাল মসজিদের পাশে আর উল্টো দিকের ইটিং হাউজ গুলোয় ঢুঁ মারুন।
বিফ বিরিয়ানি ভাল পাওয়া যায় রাজাবাজার এলাকায়। আর মেটিয়াব্রুজ অঞ্চলেও।
সেক্টর ৫ কলকাতার নতুন অফিস পাড়া। ওয়েবেল মোড় আর এসডিএফ এলাকার দর্মার ঝুপড়ি দোকান। প্রচলিত নাম ‘ঝুপ’। সেখানকার কেজিএন বিরিয়ানি ভাল বিরিয়ানির নতুন ঠিকানা।
নিউটাউন ফুড জোনে ঝুপসের বিরিয়ানি অ্যাপের মাধ্যমে অর্ডার পায়। বিক্রিও হয় হুহু করে। এখানকার আজহার বিরিয়ানি বেশ জনপ্রিয়।
ফুলবাগানের রাজ বিরিয়ানিও বেশ স্বোয়াদিষ্ট।
ওয়েলেসলি এলাকার হাণ্ডি বিরিয়ানি জিভে জল আনে।
টিপু সুলতান মসজিদের নীচে মঞ্জিলাত এর বিরিয়ানির মেজাজটাই আলাদা ।
রাসবিহারী অ্যাভিন্যুয়ে সমর দার বিরিয়ানি। সমর কয়াল রোজ ১৫০ থেকে ২০০ হাফ এবং ফুল প্লেট বিরিয়ানি তৈরি করেন। প্রিয়া সিনেমার উল্টো দিকের ফুটপাথে বসছেন ২০ বছরের বেশি সময় ধরে। শুধু বিরিয়ানিই বিক্রি করেন। চিকেন, মটন এবং আলু বিরিয়ানি।
লেক গার্ডেনসের অন্নপূর্ণা বিরিয়ানির বেশ নামডাক। অর্ডার দিয়ে প্যাকেট হাতে পেতে বেশ সময় লাগে।
বারুইপুরের আসমা বিরিয়ানি একটা সময় ফুট থেকে শুরু করে আজ ব্র্যাণ্ড। চিকেন, মটন আর বিফ বিরিয়ানি পাওয়া যায়।
যেমন ব্র্যাণ্ড হয়েছে ব্যারাকপুরের দাদা বৌদির বিরিয়ানি। ৫ মিনিটে ১০০ প্যাকেট বিরিয়ানি বিক্রির রেকর্ড এই দোকানের। দিনের যে কোনও সময় গেলে অর্ডার দেওয়ার জন্য লাইন দিতেই হবে আপনাকে।
ব্যারাকপুরে একটু বাইরেই আছে ডি বাপির বিরিয়ানি। এলাকায় বেশ নামডাক এনারও।
ব্যারাকপুরের ঢাকা বিরিয়ানির প্রলোভন এড়ানো অসম্ভব।
জগদ্দলের বহু দোকানের ফুটের বিরিয়ানিরও আশেপাশে বেশ নামডাক।
কল্যাণী এলাকায় সম্রাট বিরিয়ানি, সোনালী বিরিয়ানি, ঘোষ দার বিরিয়ানি বিখ্যাত।
বোম্বে রোডের অঙ্কুরহাটি এলাকায় জাতীয় সড়কের দুপাশে পরপর রয়েছে বেশ কিছু রাস্তার বিরিয়ানি স্টল।
দ্বিতীয় হুগলী সেতু থেকে নেমে আন্দুল রোড ধরে আলমপুর পর্যন্ত গেলে দুপাশে বেশ কয়েকটি রাস্তার বিরিয়ানি। তারমধ্যে মুসকানের বিরিয়ানি গভীর রাত অবধি জেগে থাকে।
কাউয়া বিরিয়ানি আসলে কী কাকের মাংস?
কাউয়া বিরিয়ানি আসলে ‘কাউয়া’ বা কাকের মাংস দিয়েই বানানো কিনা তা প্রমাণ সাপেক্ষ। তবে কম দামে মুরগীর জোগান দেয় বিভিন্ন পোলট্রি ফার্ম। সে ক্ষেত্রে কোনও রোগ বা মড়কে মুরগী মারা পড়লে বা স্বাভাবিক ভাবে মরা, মৃত মুরগী দিয়ে বানানো হয় সস্তার বিরিয়ানি। জলের দরে কিনে তা দিয়ে লাভের কড়ি ভালই কামান কাউয়া বিরিয়ানি ওয়ালারা।
ভাগাড় কাণ্ড ও বিরিয়ানি
২০১৮ র এপ্রিল মাসের শেষ দিকে এক ভোরবেলা বজবজের একটি ভাগাড়ের কাছে একটি গাড়ির চাকা কাদায় আটকে যায়, স্থানীয় বাসিন্দারা দেখেন গাড়িটি থেকে বেশ কিছু প্যাকেট নামানো হচ্ছে। পচা মাংসের কটু গন্ধ পেয়ে স্থানীয় মানুষজন গাড়িটিকে আটকে রেখে পুলিশকে খবর দেন। পুলিশি জেরায় ধৃতরা স্বীকার করে শুধু বজবজেই নয় কলকাতার বেশ কিছু ভাগাড় থেকে মৃত পশু ও পাখিদের দেহাবশেষ ও মাংস কেটে নিয়ে তার সাথে রাসায়নিক মিশিয়ে হিমায়িত করে তারপর সেসব মাংস তারা চালান করত কলকাতার বহু নামি ও বেনামী হোটেল, রেস্তরাঁতে। স্বভাবতই সেই মাংসর বিশাল একটা অংশ আসত রাস্তার পাশের বহু বিরিয়ানির দোকানে। এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই রোজই সংবাদের শিরোনামে উঠে আসে খাদ্য দপ্তরের রেইডের ঘটনা। সাথে মিডিয়ার কভারেজ দিনের আলোর মত পরিষ্কার করে দেয় শহরের খাবারের হাল ও চালচিত্রটা। একের পর এক নামজাদা রেস্তোরাঁতেও অভিযান চালায় রাজ্য খাদ্য দফতর। সংবাদপত্র আর টেলিভিশন চ্যানেল গুলোতে হেড লাইন নেয় পচা গলা পশু ও পাখির মাংসের ছবি। কলকাতার একটি কোল্ড স্টোরেজ থেকে উদ্ধার হয় দুই মেট্রিক টন হিমায়িত পচা মাংস।
তবুও আমজনতা বা শহরবাসীর রাস্তার বিরিয়ানি খাওয়ার অভ্যাসকে বন্ধ করতে পারেনি ভাগাড় কাণ্ডের আতঙ্ক। সাময়িক মন্দার পর আবার গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে লাল শালু বিরিয়ানি সাম্রাজ্য। আসলে সস্তা খাবারের যোগান আর আকাশ জোড়া অভাব যখন পাশাপাশি বাস করে তখন আতঙ্কের বাতাবরণকে যখন তখন উপেক্ষা করা যায়। ভাগাড়ের ইতিহাস বোধহয় তা ই শিখিয়েছে এই আদ্দিকালের শহরকে।
খাবারের পাতে ধর্মের ছদ্মবেশে রাজনীতির আস্ফালন ও বিরিয়ানি
২০১৯ জুন মাসের প্রথম দিকে এই শহর দেখল অদ্ভুত এক ঘটনা। যা ইতিপূর্বে এই বাংলা দেখে নি কখনও। চারপাশে ঘটে চলা অসহিষ্ণুতার প্রেক্ষিতে এই ঘটনা মারাত্মক ইঙ্গিতবাহী। একটি ব্যাক্তিগত উদ্যোগে কিছু মানুষজন কলকাতায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জনজাতির খাবার নিয়ে আয়োজন করে একটি খাদ্য উৎসবের। গরু, ছাগল, শুয়োর ও মাছের বিভিন্ন পদ দিয়ে সাজানো ওই উৎসবের নাম রাখা হয় ‘বিফ ফেস্টিভ্যাল’। উদ্দেশ্য পাকস্থলির উৎসব যাপনের মাধ্যমে সামাজিক সম্প্রীতির উদযাপন। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই খবর প্রচারিত হতেই জামার আস্তিন গুটিয়ে মারমুখি হয়ে ওঠে তীব্র ধর্মীয় ভাবে গোঁড়া কিছু সংগঠন। অনুষ্ঠানটির আয়োজকদের উদ্দেশ্য করে কটূক্তিতে ভরে যায় সামাজিক মাধ্যম। ঘটনার তীব্রতা এমন হয়ে পড়ে যে ‘বিফ ফেস্টিভ্যালে’র নাম বদলে ‘বিপ ফেস্টিভ্যাল’ করতে বাধ্য হয় আয়োজকরা। তাতেও ক্ষান্ত হয় না ধর্মান্ধ সমাজ রক্ষকরা।
অনুষ্ঠানের আয়োজকদের কাছে আসে প্রায় ৩০০টিরও বেশি হুমকি ফোন। আয়োজকদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অনুষ্ঠানটি বাতিল করবার। এই বিপ ফেস্টিভ্যালের বন্ধ হয়ে যাওয়া এ শহরের খাদ্য সংস্কৃতিতে ধর্মীয় সংগঠনের রক্তচক্ষু ও প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক অনুপ্রবেশের নিরিখে নিঃসন্দেহে একটিযুগান্তকারী ঘটনা। ভবিষ্যৎই বলবে কোন যুগের সূচনা করল এই ঘটনা।
সার্বজনীন খাবার, এ শহর কাউকেই খালি পেটে ফেরায় না
বাংলায় খাবারের পাতে মাংসের জাত কোনও দিনই ধর্মের নিক্তিতে মাপা হয় নি। এ শহর খাবারের স্বাদ, গুণগত মান এবং দামকেই গুরুত্ব দিয়ে রসনা বিলাসে মেতেছে। অপেক্ষাকৃত কম রেস্তওয়ালা, গরীব গুর্বো মানুষ জন কেও এ শহর বিমুখ করে নি। রাজপথ থেকে রাজ দরবার সর্বত্রই বিরিয়ানির অবাধ পদচারনা। ব্রিগ্রেড কাঁপানো রাজনীতির অলিন্দেই হোক কি ইডেনে শীতের রোদে উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকা স্কোর বোর্ডকে একধারে রেখে বিরিয়ানির মোড়ক খুললেই বাঙালির আর থাকে 'না লাজ লজ্জা, ঘোচে সাজসজ্জা' এক অমোঘ টানে বিরিয়ানির ঘ্রাণে সে মন্ত্র মুগ্ধের মত আবিষ্ট হয়ে পড়ে।
এ শহরে সব চাওয়া পাওয়া মেটে না সবার। কারও কারও দিনের শেষে ম্লান মুখ কাকেশ্বর কুচকুচের মতই অন্ধকার হাতে ধরা শুধই পেন্সিল। তবুও সেই রোজকার জীবনের সংগ্রামে বীর মানুষগুলোর জন্যই তো সাদা হলুদ ভাতের ফাঁকে আলু, ডিম, আর মাংসের আহ্বান। তবুও তো আর পাঁচটা দিনের সাদামাটা ভাতডালতরকারী জীবনে বীর বেশে বিরিয়ানির পদার্পণ সাদাকালো জীবনটাকে এক লহমায় রঙিন করে তোলে। এ হেন অন্ন তো বীর অন্নই বটে। আমরা যদি বিরিয়ানিকে তাই আদর করে “বীর অন্ন” বলে ডাকি তা কি খুব ভুল হবে?
No comments:
Post a Comment