Wednesday, August 21, 2024
মশাও পৃথিবীর মঙ্গলের কাজে লাগে
Tuesday, August 6, 2024
পরিচারিকা থেকে কলকাতার 'রাতের রাণী- মিস শেফালি' হয়ে ওঠার অবিশ্বাস্য কাহিনী
রাতের কলকাতা। এক রহস্যময়, আলো আঁধারে ঘেরা। আজ আপনাদের সামনে অতীত কলকাতার প্রথম ক্যাবারে কুইনের গল্প। অনেক প্রশ্ন আর রহস্যের মাঝে শেষ রাতের শিউলি ফুলের মতো ফুটে ছিলেন সেই নিশি সম্রাজ্ঞী। আজ মিস শেফালির গল্প।
তখনও দেশভাগ হয়নি। বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে কলকাতার আহিরিটোলায় এসেছিলেন দাস পরিবার। সেই পরিবারের তৃতীয় সন্তান একটি মেয়ে। নাম আরতি দাস। বাবা অসুস্থ। কাজ করতে পারেন না। এদেশে আসবার সময়ে সামান্য যা কিছু সঞ্চয় ছিল তাও নিঃশেষিত হয়েছে। পরিবারের মুখে অন্নের যোগান তুলে দিতে আরতির মা গার্হস্থ সহায়কের কাজ নিলেন। বাড়িতে অনেকগুলো মুখ। রোজগার নিতান্তই কম! তাই কিশোরী আরতি বাধ্য হয়ে এক রকম জোর করেই চৌরঙ্গীর এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারে কাজের মেয়ে হিসাবে নিযুক্ত হল। আর সেখান থেকেই মোড় ঘুরে গেল আরতির। আরতি থেকে মিস শেফালি। কলকাতার প্রথম ক্যাবারে কুইন হয়ে ওঠার সেই উপাখ্যান আজ।
মিস শেফালি একবার একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক অনির্বাণ চৌধুরীকে তাঁর উত্থানের গল্প বলেছিলেন। কী বলেছিলেন সেদিন ক্যাবারে কুইন?
মিস শেফালি তাঁর জীবদ্দশায় সেই সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন-
'অনেক নদী, নালা, কাদা পেরিয়ে হিমালয় দেখেছি। বাবার কষ্ট, ভাইয়ের কান্না, দেখেছি। ১০ সাড়ে দশ বছর বয়সে আহিরিটোলার বানী নামের এক মহিলাকে জোরাজুরি করতাম কাজ দাও কাজ দাও। সে একটা কাজ দিল। মায়ের অনুমতি নিয়ে বাণী আমাকে এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বাড়িতে নিয়ে যায়। প্লেট ধোয়ার কাজ। সেখানে রোজ বিকেলে খানাপিনা ও নাচের আসর বসত।'
দেখে দেখে সেই নাচের ঘোর লেগে যায় আরতির চোখে আরতির মনে। লুকিয়ে লুকিয়ে সে সব নাচ তুলতে থাকেন আরতি। তখন সে নিতান্তই বালিকা। ওই আসরে গান গাইতে আসতেন ভিভিয়েন হ্যানসাম। তখনকার কলকাতার পানশালার ডাকসাইটে গায়ক। আরতি ভিভিয়েনকে ধরেন একটা কোনও কাজের জন্য। ভিভিয়েন প্রশ্ন করেন নাচতে পার? আরতি তাঁর গোপনে দেখে নকল করা নাচ দেখান। পানশালায় নর্তকীর কাজ জুটিয়ে দেন ভিভিয়েন।
ভিভিয়েন আরতিকে প্রথমে নিয়ে যান গ্র্যান্ড হোটেলে। তারপর গ্র্যান্ড থেকে বার করে ভিভিয়েন আরতিকে নিয়ে যান ফিরপোজে। আরতির নাচ পছন্দ হয় ফিরপোজের ম্যানেজারের। কিন্তু ম্যানেজার বলেন এই নাম চলবে না। ভিভিয়েন বলেন আজ থেকে তোমার নাম আরতি দাস নয় । আজ থেকে তোমার নাম শেফালি। তোমার বেতন ৭০০ টাকা। আরতি জিজ্ঞেস করেন 'আবার বলুন কত বেতন!' নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না উদ্বাস্তু পরিবারের সেই অভাবী মেয়েটা।
তবে প্রথম দিনের পরিধেয় পোশাক দেখে কেঁদে ফেলেন সদ্য আরতি থেকে মিস শেফালী হওয়া সেই কিশোরী। সেই পোশাকে যে শরীরের অনেকটাই হয়ে পড়ছিল উন্মুক্ত। বেআব্রু। তবে বল রুমে প্রথম নাচের আসরেই মাতিয়ে দেন তিনি। প্রশংসা আর হাততালিতে ফেটে পড়ে নিশি আসর।
ফিরপোজও যেন চাইছিল ক্যাবারের নতুন রানীকে গড়ে পিঠে তৈরি করে নিতে। তারাই আরতিকে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় কথাবলা শেখায়। নাচের বিভিন্ন রকমের তালিম দেয়। সেই সময়কার পার্ক স্ট্রীট অন্যরকম। ব্রিটিশরা তখনও শহরে। আরতি সেই সাক্ষাৎকারেই বলেন "লুকিয়ে চুরিয়ে স্ট্রিপটিজ হতো পার্ক স্ট্রিটের পানশালা আর নিশিনিলয়গুলিতে"। যদিও তাঁর কাছে এমন প্রস্তাব কখনও আসেনি। তখন তিনি খ্যাতির শিখরে উঠছেন। তাঁর এক ঝলক পেতে শহরের সন্ধ্যাগুলো উদ্বেল। 'তোমাকে ভালবাসি , তোমাকে ছাড়া বাঁচব না, তোমাকে বিয়ে করতে চাই'। এমন প্রস্তাব আসত অহরহ। তিনি জানতেন এসব যৌবনের ঘোর। এ ঘোর চিরস্থায়ী নয়। তাই ওসব খুব একটা পাত্তা দিতেন না।
সেই সময়ে কিছুদিন ধরে কেউ একটা ফোন করছিল। শেফালি ভেবেছিলেন তাঁর বহু অনুরাগীর মধ্যে কেউ বুঝি ফোন করছেন। শেষমেশ বাধ্য হয়েই একদিন ফোন ধরলেন শেফালি। ফোনটা ধরতে ফোনের ওপার থেকে শোনা গেল, "তুমি হয়ত আমার নাম শুনলেও শুনতে পার আমি সত্যজিৎ রায় বলছি। আমার তোমাকে চাই"। ২০ সার্কাস অ্যাভেনিউ থেকে গেলেন বিশপ লেফ্রয় রোড। সত্যজিৎ বলেছিলেন তোমার ব্লাউজ খুলতে অসুবিধে আছে? তুমি কি সিগারেট খাও? এক সাক্ষাৎকারে শেফালি শোনান প্রতিদ্বন্দ্বী ছবির শুটের সেই অভিজ্ঞতা-
"আমি তো আগে কখনও করিনি। ডায়লগ বলতে গেছি। অমনি শুনলাম 'কাট'। স্ক্রিপ্টটা ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। আমি তো ভয় পেয়ে গেছি। সত্যজিৎ তখন বলেন তোমার স্ক্রিপ্ট আমি এখানেই করে নেব"।
বাঙালির ম্যাটিনি আইডল উত্তম কুমারকেও নাচিয়ে ছেড়েছিলেন মিস শেফালি। একবার উত্তম কুমার তাঁর নাচ দেখতে এসেছিলেন। এপ্রসঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে মিস শেফালি বলেন। 'সুযোগ পেলাম। উত্তম কুমারের সঙ্গে নাচার সুযোগ। মনে মনে বললাম তুমি উত্তম কুমার, আমিও মিস শেফালি। তোমাকে আমি আজ নাচাচ্ছি।' উত্তমকুমারকে দাদার মতো ভালবাসতেন মিস শেফালি। সুচিত্রা সেনের অভিনয়ের দারুণ ভক্ত ছিলেন কলকাতার ক্যাবারে কুইন। সুচিত্রা মিস শেফালির নাটক 'সম্রাট সুন্দরী' দেখতে আসেন একবার।
আজীবন মুম্বইয়ের হেলেনকে নিজের গুরু মানতেন। একলব্য যেমন গুরু দ্রোণকে গুরু মানতেন তেমনি। তাই হেলেনের সঙ্গে শো করতে চাননি কখনও।
কখনও সখনও মনে হয়েছে মিস থেকে মিসেস হয়ে যেতে। কিন্তু সেই মনে হওয়া সেই ইচ্ছেকে কখনও আমল দেননি। কারন তিনি জানতেন আজ যে পুরুষ তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে সে একদিন ছেড়ে চলে যাবেই। বরং তিনি শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছেন আরতি দাসের হাতটাই। যে আজীবন তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ছায়া হয়ে থেকেছিল।
কোনোদিন শিল্পীর সম্মান জোটেনি মিস শেফালিদের। মুখ থেকে লাইমলাইট থেকে সরে যাওয়ার পর আর পাঁচটা সাদামাটা
মহিলার মতো জীবন কাটাতেন। হতাশ আরতি দাস মনে করতেন, ক্যাবারে ডান্সারদের শিল্পসত্ত্বা নিয়ে কেউ কোনও দিন কথা বলেননি। কাজ না থাকায় শেষ জীবনে আর্থিক সমস্যারও সম্মুখীন হয়েছেন । অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার জন্যেও অর্থাভাব হয়। দীর্ঘদিন কিডনির অসুখে ভুগে। অবশেষে ২০২০সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মিস শেফালি পাড়ি দেন তারাদের দেশে। তাঁর আত্মজীবনী 'সন্ধ্যা রাতের শেফালি’ পাঠক মহলে যথেষ্ট সাড়া ফেলে। এই পার্ক স্ট্রিট থেকে উত্থান আর এক সিঙ্গারের। তিনি পদ্মভূষণ প্রাপক ঊষা উত্থুপ। অথচ আরতি দাস ওরফে মিস শেফালিরা থেকে যান ক্যাবারে কুইনের মতো এক প্রশ্ন সূচক তকমা নিয়েই। আপনাদের কী মত এই প্রসঙ্গে? কমেন্টে জানান। আর এই বিষয়ের ওপরে আমার তৈরি একটি ভিডিও দেখুন নিচের লিঙ্কে ক্লিক করে।