Wednesday, August 21, 2024

মশাও পৃথিবীর মঙ্গলের কাজে লাগে

কলকাতার চিকিৎসাশাস্ত্রের ইতিহাসে ২০শে অগস্ট দিনটি বিশেষ। ১৮৯৭ এর ২০শে অগাস্ট স্যার রোনাল্ড রস স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশার পৌষ্টিকতন্ত্রে ম্যালেরিয়ার জীবাণু আবিস্কার করেন। প্রথমবার প্রমাণিত হয় মানুষের ম্যালেরিয়া রোগের বাহক মশা। এই আবিস্কার চিকিৎসা  বিজ্ঞানে যুগান্তকারী। 
তৎকালীন প্রেসিডেন্সি জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক হিসাবে রোনাল্ড রস তখন কলকাতায়। এখানেই তিনি কাজ করেন ম্যালেরিয়া সম্পর্কে তাঁর যুগান্তকারী আবিস্কার নিয়ে। বর্তমানে সেই হাসপাতালকে আমরা এসএসকেএম হাসপাতাল নামে চিনি। 
পরিসংখ্যান বলছে প্রতি বছর প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এই কারণে মশা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাণঘাতী প্রাণী। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জি়কা'র মতো মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত পৃথিবীর প্রায় ১০০টি দেশ। 
বিজ্ঞানিরা বলেন প্রাণীদেহ থেকে নির্গত কার্বনডাই অক্সাইড,গন্ধ ও তাপমাত্রা মশাকে মানুষের প্রতি আকৃষ্ট করে। কেবল স্ত্রী মশাই প্রাণীদেহ থেকে রক্ত খেয়ে থাকে। আর এই রক্ত মশার বংশবিস্তারের জন্য ডিম তৈরিতে প্রোটিনের উৎস হিসেবে কাজে লাগে। পুরুষ মশারা মানুষকে কামড়ায় না,তারা উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে রস সংগ্রহ করে। 
আচ্ছা কখনও ভেবে দেখেছেন যে মশার কারণে আমাদের এত রোগভোগ এই পৃথিবীতে যদি সেই মশাই না থাকত তাহলে কেমন হত? কখনও  ভেবে দেখেছেন মশার কি কোনও উপকারিতা আছে? আসলে প্রকৃতির কোনও সৃষ্টিই হেলাফেলার নয়। প্রত্যেকের নিজস্ব কাজ আছে। মশার ও নির্দিষ্ট কাজ রয়েছে।
পৃথিবীতে ৩৫০০টি প্রজাতির মশা আছে তাদের মধ্যে প্রায় ৩৪০০ প্রজাতির মশা কোনো ক্ষতি করে না। মাত্র ৯০টির থেকে একটু বেশি সংখ্যক প্রজাতির মশা মানুষের জন্য বিপজ্জনক। বাকিরা কোনও অনিষ্ট করে না।

বরং তারা পৃথিবীর খাদ্য-শৃঙ্খলে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।  কিছু মাকড়সা, টিকটিকি, গিরগিটি, ব্যাঙের মুখ্য খাদ্য মশা। এছাড়া মশার ডিম মাছের খাবার। তাই মাছের খাদ্য চাহিদা মেটাতেও বিশেষ ভূমিকা রাখে মশা। যখন মশা উড়ন্ত অবস্থায় থাকে তখন ফড়িং,ছোট ছোট পাখি ও কীটপতঙ্গ মশা খেয়ে জীবনধারণ করে।
মশা একটি ইনডিকেটর স্পেসিজ। একটি বাস্তুতন্ত্রে মশা থাকা মানে সেখানকার পরিবেশের মাপকাঠিগুলি যেমন তাপমাত্রা,আর্দ্রতা ও জলের মান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়              
ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণায় জানা গেছে 'পুরুষ মশা ফুলের মধু খায়, যা পরাগ মিলনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। পৃথিবী থেকে যদি মশা  বিলুপ্ত হয়,তাহলে বহু খাদ্য-শৃঙ্খলের উপর তার সরাসরি প্রভাব পড়বে।’ আর একদল গবেষক বলছেন,মশার যায়গায় অন্য পতঙ্গ পরাগ মিলন করলেও   মশার প্রতিস্থাপক পতঙ্গটি মশার চেয়েও ভয়ঙ্কর এবং দ্রুতগতিতে রোগ বিস্তার করবে।’
মশা না থাকলে পাখির সংখ্যা ব্যাপক হারে কমবে। অনেক কীট-তাত্ত্বিকদের মতে, মশার কারণে গ্রীষ্মমন্ডলীয় জঙ্গল এলাকায় মানুষ বসবাস করতে পারে না। সেসব অঞ্চলে মশা না থাকলে মানুষ আরও অনেক বেশি গাছপালা কেটে বন উজাড় করে বসতি স্থাপন করত। অনেক বেশি পরিমাণ মশার বসবাস উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে। প্রতি বছর যে পরিমাণ পরিযায়ী পাখিরা এখানে আসে তাদের মূল খাদ্য হচ্ছে মশা। তাই যদি মশা-ই না থাকে, তাহলে প্রায় ৫০ শতাংশ পরিযায়ী পাখি আর দুই মেরুতে আসবে না। ফলে সেখানকার পরিবেশ বদলাতে শুরু করবে। তাছাড়া ভিনদেশ থেকেও বছরের নানা সময় লক্ষাধিক তৃণভোজী পশু এই অংশে মাইগ্রেট হয়ে থাকে। মশার কামড় থেকে বাঁচতে যে জায়গায় মশার ঝাঁক বেশি থাকে, সে জায়গা এড়িয়ে অন্য পথ বেছে নেয় এই তৃণভোজী প্রাণীরা। হঠাৎ যদি কোনো বছর এই মশার ঝাঁক না থাকে, তাহলে কোন দিকে যেতে হবে, তা তারা বুঝতে পারবে না। ফলে রাস্তা হারিয়ে গণহারে সবাই মারা যাবে। আর এরা এত সংখ্যায় তৃণভোজী মারা গেলে অন্যান্য মাংসাশী প্রাণীদের খাদ্য সংকট    হবে। তাছাড়াও এদের মলে থাকা বীজের কারণে যে গাছ জন্মায় তাও বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে।

এই বিষয়ের ওপরে আমার তৈরি একটি ভিডিও দেখুন। লিঙ্ক দিচ্ছি।

https://youtu.be/kWudaJV9_i4?si=RIuc1UDJuFAe4b_O


Tuesday, August 6, 2024

পরিচারিকা থেকে কলকাতার 'রাতের রাণী- মিস শেফালি' হয়ে ওঠার অবিশ্বাস্য কাহিনী



রাতের কলকাতা। এক রহস্যময়, আলো আঁধারে ঘেরা। আজ আপনাদের সামনে অতীত কলকাতার প্রথম ক্যাবারে কুইনের গল্প। অনেক প্রশ্ন আর রহস্যের মাঝে শেষ রাতের শিউলি ফুলের মতো ফুটে ছিলেন সেই নিশি সম্রাজ্ঞী। আজ মিস শেফালির গল্প। 

তখনও দেশভাগ হয়নি। বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে কলকাতার আহিরিটোলায় এসেছিলেন দাস পরিবার। সেই পরিবারের তৃতীয় সন্তান একটি মেয়ে। নাম আরতি দাস। বাবা অসুস্থ। কাজ করতে পারেন না। এদেশে আসবার সময়ে সামান্য যা কিছু সঞ্চয় ছিল তাও নিঃশেষিত হয়েছে। পরিবারের মুখে অন্নের যোগান তুলে দিতে আরতির মা গার্হস্থ সহায়কের কাজ নিলেন। বাড়িতে অনেকগুলো মুখ। রোজগার নিতান্তই কম! তাই কিশোরী আরতি বাধ্য হয়ে এক রকম জোর করেই চৌরঙ্গীর এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারে কাজের মেয়ে হিসাবে নিযুক্ত হল। আর সেখান থেকেই মোড় ঘুরে গেল আরতির। আরতি থেকে মিস শেফালি। কলকাতার প্রথম ক্যাবারে কুইন হয়ে ওঠার সেই উপাখ্যান আজ। 



মিস শেফালি একবার একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক অনির্বাণ চৌধুরীকে তাঁর উত্থানের গল্প বলেছিলেন। কী বলেছিলেন সেদিন ক্যাবারে কুইন? 

মিস শেফালি তাঁর জীবদ্দশায় সেই সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- 

'অনেক নদী, নালা, কাদা পেরিয়ে হিমালয় দেখেছি। বাবার কষ্ট, ভাইয়ের কান্না, দেখেছি। ১০ সাড়ে দশ বছর বয়সে আহিরিটোলার বানী নামের এক মহিলাকে জোরাজুরি করতাম কাজ দাও কাজ দাও। সে একটা কাজ দিল। মায়ের অনুমতি নিয়ে বাণী আমাকে এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বাড়িতে নিয়ে যায়। প্লেট ধোয়ার কাজ। সেখানে রোজ বিকেলে খানাপিনা ও নাচের আসর বসত।' 



দেখে দেখে সেই নাচের ঘোর লেগে যায় আরতির চোখে আরতির মনে। লুকিয়ে লুকিয়ে সে সব নাচ তুলতে থাকেন আরতি। তখন সে নিতান্তই বালিকা। ওই আসরে গান গাইতে আসতেন ভিভিয়েন হ্যানসাম। তখনকার কলকাতার পানশালার ডাকসাইটে গায়ক। আরতি ভিভিয়েনকে ধরেন একটা কোনও কাজের জন্য। ভিভিয়েন প্রশ্ন করেন নাচতে পার? আরতি তাঁর গোপনে দেখে নকল করা নাচ দেখান। পানশালায় নর্তকীর কাজ জুটিয়ে দেন ভিভিয়েন। 

ভিভিয়েন আরতিকে প্রথমে নিয়ে যান গ্র্যান্ড হোটেলে। তারপর গ্র্যান্ড থেকে বার করে ভিভিয়েন আরতিকে নিয়ে যান ফিরপোজে। আরতির নাচ পছন্দ হয় ফিরপোজের ম্যানেজারের। কিন্তু ম্যানেজার বলেন এই নাম চলবে না। ভিভিয়েন বলেন আজ থেকে তোমার নাম আরতি দাস নয় । আজ থেকে তোমার নাম শেফালি। তোমার বেতন ৭০০ টাকা। আরতি জিজ্ঞেস করেন 'আবার বলুন কত বেতন!' নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না উদ্বাস্তু পরিবারের সেই অভাবী মেয়েটা। 

তবে প্রথম দিনের পরিধেয় পোশাক দেখে কেঁদে ফেলেন সদ্য আরতি থেকে মিস শেফালী হওয়া সেই কিশোরী। সেই পোশাকে যে শরীরের অনেকটাই হয়ে পড়ছিল উন্মুক্ত। বেআব্রু। তবে বল রুমে প্রথম নাচের আসরেই মাতিয়ে দেন তিনি। প্রশংসা আর হাততালিতে ফেটে পড়ে নিশি আসর। 

ফিরপোজও যেন চাইছিল ক্যাবারের নতুন রানীকে গড়ে পিঠে তৈরি করে নিতে। তারাই আরতিকে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় কথাবলা শেখায়। নাচের বিভিন্ন রকমের তালিম দেয়। সেই সময়কার পার্ক স্ট্রীট অন্যরকম। ব্রিটিশরা তখনও শহরে। আরতি সেই সাক্ষাৎকারেই বলেন "লুকিয়ে চুরিয়ে স্ট্রিপটিজ হতো পার্ক স্ট্রিটের পানশালা আর নিশিনিলয়গুলিতে"। যদিও তাঁর কাছে এমন প্রস্তাব কখনও আসেনি। তখন তিনি খ্যাতির শিখরে উঠছেন। তাঁর এক ঝলক পেতে শহরের সন্ধ্যাগুলো উদ্বেল। 'তোমাকে ভালবাসি , তোমাকে ছাড়া বাঁচব না, তোমাকে বিয়ে করতে চাই'। এমন প্রস্তাব আসত অহরহ। তিনি জানতেন এসব যৌবনের ঘোর। এ ঘোর চিরস্থায়ী নয়। তাই ওসব খুব একটা পাত্তা দিতেন না। 



সেই সময়ে কিছুদিন ধরে কেউ একটা ফোন করছিল। শেফালি ভেবেছিলেন তাঁর বহু অনুরাগীর মধ্যে কেউ বুঝি ফোন করছেন। শেষমেশ বাধ্য হয়েই একদিন ফোন ধরলেন শেফালি। ফোনটা ধরতে ফোনের ওপার থেকে শোনা গেল, "তুমি হয়ত আমার নাম শুনলেও শুনতে পার আমি সত্যজিৎ রায় বলছি। আমার তোমাকে চাই"। ২০ সার্কাস অ্যাভেনিউ থেকে গেলেন বিশপ লেফ্রয় রোড। সত্যজিৎ বলেছিলেন তোমার ব্লাউজ খুলতে অসুবিধে আছে? তুমি কি সিগারেট খাও? এক সাক্ষাৎকারে শেফালি শোনান প্রতিদ্বন্দ্বী ছবির শুটের সেই অভিজ্ঞতা-  

"আমি তো আগে কখনও করিনি। ডায়লগ বলতে গেছি। অমনি শুনলাম 'কাট'। স্ক্রিপ্টটা ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। আমি তো ভয় পেয়ে গেছি। সত্যজিৎ তখন বলেন তোমার স্ক্রিপ্ট আমি এখানেই করে নেব"। 

বাঙালির ম্যাটিনি আইডল উত্তম কুমারকেও নাচিয়ে ছেড়েছিলেন মিস শেফালি। একবার উত্তম কুমার তাঁর নাচ দেখতে এসেছিলেন। এপ্রসঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে মিস শেফালি বলেন। 'সুযোগ পেলাম। উত্তম কুমারের সঙ্গে নাচার সুযোগ। মনে মনে বললাম তুমি উত্তম কুমার, আমিও মিস শেফালি। তোমাকে আমি আজ নাচাচ্ছি।' উত্তমকুমারকে দাদার মতো ভালবাসতেন মিস শেফালি। সুচিত্রা সেনের অভিনয়ের দারুণ ভক্ত ছিলেন কলকাতার ক্যাবারে কুইন। সুচিত্রা মিস শেফালির নাটক 'সম্রাট সুন্দরী' দেখতে আসেন একবার।    



আজীবন মুম্বইয়ের হেলেনকে নিজের গুরু মানতেন। একলব্য যেমন গুরু দ্রোণকে গুরু মানতেন তেমনি। তাই হেলেনের সঙ্গে শো করতে চাননি কখনও। 

কখনও সখনও মনে হয়েছে মিস থেকে মিসেস হয়ে যেতে। কিন্তু সেই মনে হওয়া সেই ইচ্ছেকে কখনও আমল দেননি। কারন তিনি জানতেন আজ যে পুরুষ তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে সে একদিন ছেড়ে চলে যাবেই। বরং তিনি শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছেন আরতি দাসের হাতটাই। যে আজীবন তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ছায়া হয়ে থেকেছিল।

কোনোদিন শিল্পীর সম্মান জোটেনি মিস শেফালিদের। মুখ থেকে লাইমলাইট থেকে সরে যাওয়ার পর  আর পাঁচটা সাদামাটা

মহিলার মতো জীবন কাটাতেন। হতাশ আরতি দাস মনে করতেন, ক্যাবারে ডান্সারদের শিল্পসত্ত্বা নিয়ে কেউ কোনও দিন কথা বলেননি। কাজ না থাকায় শেষ জীবনে আর্থিক সমস্যারও সম্মুখীন হয়েছেন । অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার জন্যেও অর্থাভাব হয়। দীর্ঘদিন কিডনির অসুখে ভুগে। অবশেষে ২০২০সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মিস শেফালি পাড়ি দেন তারাদের দেশে। তাঁর আত্মজীবনী 'সন্ধ্যা রাতের শেফালি’ পাঠক মহলে যথেষ্ট সাড়া ফেলে। এই পার্ক স্ট্রিট থেকে উত্থান আর এক সিঙ্গারের। তিনি পদ্মভূষণ প্রাপক ঊষা উত্থুপ। অথচ আরতি দাস ওরফে মিস শেফালিরা থেকে যান ক্যাবারে কুইনের মতো এক প্রশ্ন সূচক তকমা নিয়েই। আপনাদের কী মত এই প্রসঙ্গে? কমেন্টে জানান। আর এই বিষয়ের ওপরে আমার  তৈরি একটি ভিডিও দেখুন নিচের লিঙ্কে ক্লিক করে।