মশা মারতে কামান দাগা
তো শুনেছেন, তা বলে বিড়াল বাঁচাতে কবাডি খেলা!
সরস্বতী পুজো কেমন
কাটল সবার? এই ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই পাখা চালাতে হচ্ছে। এখনই আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে
গরমটা কেমন পড়তে চলেছে এই বছর! সেদিন একটা অনুষ্ঠানে অভিনেতা জিতু কামালের সঙ্গে কথা
হচ্ছিল জিতু বলছিলেন আজকাল আমাদের এখানে শীত পড়ে না। সারা বছর গরম, বর্ষা আর অল্প গরম
পড়ে। প্রসঙ্গ থেকে সরে যাচ্ছি। সরস্বতী পুজোতেও অন্য উৎসবের মতোই শব্দ দানবের তাণ্ডব
চলল। হাওড়ার উলুবেড়িয়ার ভিডিও দেখে আতঙ্ক হচ্ছিল। তারস্বরে ডিজে চালিয়ে হাজার হাজার
মানুষ নেচে চলেছে। এ কোন আমদানি করা সংস্কৃতি বুঝতে পারছি না। আমি যে পাড়ায় থাকি সেখানেও
উদ্দাম ভয়াবহ সব গান চলল। গান পয়েন্টে ঘুমের দফারফা হল রাত আড়াইটে অবধি। বুঝি না প্রশাসন,
পুলিশ কী করেন? সামনেই মাধ্যমিক পরীক্ষা। ছাত্রদের জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা। মাইক আর
লাউড স্পিকারে নিয়ন্ত্রণ আনলে কি ভোট ব্যাঙ্কে চাপ পড়ত? বা ছাপ পড়ত? তাই কুম্ভকর্ণের
মতো ঘুমিয়ে গেলেন তাঁরা যাদের পাহারা দেওয়াটাই দস্তুর! উলুবেড়িয়ার উদ্দাম নাচের ছবি
যখন ভাইরাল হচ্ছে তখনই সম্রাট, সায়ন, চিত্রক, কল্যাণী দিরা তুলে ধরলেন এক অন্য ছবি।
উলুবেড়িয়া থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে ঘটল এমন এক ঘটনা যা ওই উদ্দাম, অর্থহীন, মগজহীনতার
মুখে সজোরে একটা থাপ্পড় মারল।
পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র
পর্ষদ, হাওড়া জেলা বন বিভাগ, জেলা পরিষদ, বিধায়ক আর হাওড়া জেলা যৌথ পরিবেশ মঞ্চ আমতার
গাজীপুর পঞ্চানন সংঘে আয়োজন করল এক কবাডি প্রতিযোগিতা। না প্রো কবাড্ডি লিগের ম্যাচ
না। ছিল না ততটা জৌলুসও। কিন্তু এই কবাডির গুরুত্ব অপরিসীম। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপ্রাণী
মেছো বিড়ালের সম্পর্কে সচেতনতা প্রসারে মেয়েদের এই কবাডি টুর্নামেন্ট।
পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র
পর্ষদের সিনিয়র অফিসার সৌমেন্দ্রনাথ ঘোষ , হাওড়া জেলা মুখ্য বন আধিকারিক দীপক কুমার
মন্ডল,উলুবেড়িয়া রেঞ্জ অফিসার রাজেশ মুখার্জী , হাওড়া জেলা পরিষদের বন ও ভূমি কর্মাধ্যক্ষ
মানস কুমার বসু, আমতা বিধানসভা কেন্দ্রের প্রাক্তন বিধায়ক অসিত মিত্র ,আমতা কেন্দ্রের
বর্তমান বিধায়ক সুকান্ত পাল, হাওড়া জেলা যৌথ পরিবেশ মঞ্চ এর সভাপতি সৌরেন্দ্র শেখর
বিশ্বাস ,সম্পাদিকা কল্যানী পালুই , কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেছোবিড়াল গবেষক সম্রাট
চক্রবর্তী, সংসদ প্রতিনিধি তাপস বাকুলী, গাজীপুর গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান চন্দনা চোঙ্গদার
ও আমতা থানার আধিকারিক সমাপ্তি রায় হাজির থেকে কবাডি খেলোয়াড়দের উৎসাহ দিলেন।
এখন আপনার মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে কী এই রাজ্য প্রাণী, মেছো বিড়াল? কেন এই বিড়াল রাজ্য প্রাণী? চলুন আজ আমরা জেনে নিই এই বিড়াল সম্বন্ধে। আমরা জানি বিড়াল সাধারণত জলকে ভয় পায়। কিন্তু জলই এই বিড়ালের বেঁচে থাকার অন্যতম শর্ত। বলা ভাল প্রধান শর্ত। এরা জলাভূমির বাস্তুতন্ত্রের শীর্ষ শিকারি। মেছো বিড়াল জলে ডুব দিয়ে তলা থেকে বড় বড় মাছ শিকার করে। দেড় বা দু কেজির মাছ তুলে আনা এদের কাছে নস্যি। এরা বিশ্বের একমাত্র বিড়াল প্রজাতি যারা জলের মধ্যে এভাবে শিকার করে। জলাজমি এদের বিচরণ ক্ষেত্র। জলা জমিতে শিল্প, জলা ভরাট বা জলাজমি নষ্ট হওয়ায় এরাও হয়ে পড়ছে বিপন্ন। এরা মাছ ছাড়াও কীট পতঙ্গ, ব্যাঙ ও সাপ খেয়ে পরোক্ষে চাষির উপকারই করে।
এদের বিজ্ঞান সম্মত
নাম প্রিয়োনাইলুরাস ভাইভারিনাস। বাংলায় এদের অনেক নাম বাঘরোল, মাছবাঘা,
গোবাঘা, মেছো বিড়াল। এদের আকার সাধারণ বিড়ালের থেকে অনেকটাই বড় হওয়ায় এদের অনেকেই বাঘ
বলে ভুল করেন। বাঘরোল নাম জনপ্রিয় হবার কারনেও অনেকে এদের বাঘের সঙ্গে গুলিয়ে আতঙ্কিত
হন। বলতে দ্বিধা নেই চাকরি করার সময়ে দেখেছি মেইন স্ট্রিম মিডিয়ার অনেক বড় বড় অভিজ্ঞ
সাংবাদিকদেরও এদের সম্বন্ধে সম্যক ধারণা নেই। আর তার ফলেই এদের দেখা গেলেই টিভি চ্যানেল
গুলোতে হালচাল পড়ে। হেডলাইন হয়, ব্রেকিং নিউজ হয়- ‘অজানা প্রাণীর আতঙ্ক’। এদের বেঁচে
থাকা আরও বিপদ সংকুল হয়ে পড়ে সৌজন্যে ‘অশিক্ষিত’ গণমাধ্যম! এই ধরনের হেডলাইনের বিরুদ্ধে
আমি আগেও বহুবার সরব হয়েছি। আবারও হলাম। মাননীয় নিউজ প্রোডিউসার আপনি জানেন না যখন
কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপককে ফুটেজ দেখান, তিনিই আইডেন্টিফাই করে
দেবেন প্রাণিটির নাম। নইলে সময় কম থাকলে গুগল লেন্সে ফেলুন। উত্তর পাবেন। আপনার অজ্ঞতা
মানেই কোনও প্রাণী অজানা হতে পারে না।
যাই হোক মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে আসছি, আবেগপ্রবণ হয়ে। ফিরি
ফিশিং ক্যাটের গল্পে। হ্যাঁ গল্পই তো। এদের সংখ্যা যেভাবে কমছে, এদের সম্বন্ধে না জানলে
আগামিদিনে এদের স্থান হবে গল্পের পাতায়। তাই চিনুন এদের। এরা ধৈর্যশীল শিকারি। একটা
মাছ শিকারের জন্য এরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা জলের ধারে বসে থাকে। আর এতেই এরা মানুষের রোষে
পড়ে। অথচ এরা মানুষের প্রতি মোটেই আক্রমণাত্মক নয়। সংরক্ষণের নিরিখে এরা রয়েল বেঙ্গল
টাইগারের সমকক্ষ অর্থাৎ IUCN লাল তালিকাভুক্ত। মানে অতি সংবেদনশীল বিপন্ন প্রজাতির।
আমাদের রাজ্যের রাজ্যপ্রাণী এই বিড়াল। ফেব্রুয়ারি মাস এদের জন্য সচেতনতা প্রসারের উদ্দেশ্যে
বিশ্ব জুড়ে পালিত হয়। কেননা ভারত ও বাংলাদেশ ছাড়াও এদের দেখা যায়, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার
বিস্তৃত জলাভুমিতে। পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, আসাম, অন্ধ্রপ্রদেশে। আর আমাদের রাজ্যে এদের
আবাস হাওড়া, হুগলী, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, পূর্ব মেদিনীপুরের
জলাজমিতে। সম্প্রতি পুরুলিয়াতেও বাঘরোল দেখা গেছে বন বিভাগের ট্র্যাপ ক্যামেরায়। মাছে
ভাতে বাঙালির রাজকীয় রোল মডেল বা রাজ্যপ্রাণী এরা ছাড়া আর কেই বা হতে পারে! এদের চিনুন
এদের সম্বন্ধে সঠিক বিজ্ঞানসম্মত তথ্যই এদের বাঁচাতে পারে। মানুষের সঙ্গেই এরা এদের
বাসস্থান ভাগাভাগি করে নেয় বলে অভয়ারণ্য বা স্যাঙ্কচুয়ারি করে এদের সংরক্ষণ প্রায় অসম্ভব।
কথাটা আমি বলছি না, একসময়ে একটি প্রতিবেদন তৈরির সময়ে এই কথা আমাকে বলেন রাজ্যের প্রধান
মুখ্য বনপাল, ওয়াইল্ড লাইফ, আইএফএস, শ্রী দেবল রায় মহাশয়।
এদের সংখ্যা রোজ কমছে। দ্রুত কমছে। এদের মৃত্যুর কারণ রোড
কিল ও মানুষের সঙ্গে সংঘাত। এই কবাডি প্রতিযোগিতার শেষে হাওড়া বন দফতরের তরফে আশ্বাস
দেওয়া হয় রাস্তায় দেওয়া হবে সাইনেজ। যেসব জায়গা মেছো বিড়ালের পারাপারের করিডোর সেখানে
বন দফতরের পক্ষ থেকে লাগানো হবে রোড সাইন।