তারকেশ্বরে শিবের পুজোর নামে চরম ব্যাভিচার!!! পূজারীর জেল, ফাঁসি!!!
শ্রাবণ মাস
দেবাদিদেব মহাদেবের মাস। ভক্তরা দলে দলে জলের বাঁক কাঁধে ছোটেন তারকেশ্বরে। হুগলী জেলার
এই শৈব তীর্থে মনস্কামনা পূরণের জন্য স্বয়ম্ভু শিব শম্ভুর মাথায় জল ঢালেন পূণ্যার্থীরা।
তারকেশ্বর মন্দিরের লাগোয়া এক বিরাট পুকুর, নাম, দুধ পুকুর। দুধ পুকুরে স্নান সেরে মন্দিরে পুজো দেওয়াটাই দস্তুর
এখানে। মন্দির, দোকানপাট পার করে কিছুটা গেলেই চোখে পড়বে এক বিশাল প্রাসাদ। তারকেশ্বর মন্দিরের শ্রাবণী
মেলা এই প্রাসাদের সামনেই বসে। জানেন কি এই বিশাল প্রাসাদের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তারকেশ্বরের
ইতিহাসের সবচেয়ে কালো অধ্যায়টা? বর্তমান তারকেশ্বর মন্দির পরিচলন সমিতির জনকল্যাণ মূলক
কাজ হুগলী জেলার এই অঞ্চলের উন্নয়নের কাণ্ডারী। কিন্তু আমি যে সময়ের কথা বলছি তখনকার সময়ে এই প্রাসাদের ভুমিকা এখনকার পাশাপাশি রাখলে কল্পনাও করতে পারবেন না কতটা ভয়ঙ্কর কতটা ক্রূর ছিল এই বিশাল
প্রাসাদের অতীত। সেই ঘটনাই শুনুন এখন।
সেটা উনবিংশ শতকের বাংলা। তখন একটা খুনের মামলা এতটাই আলোড়ন ফেলে যে মানুষজন সেই মামলার শুনানি দেখতে টিকিট কেটে আদালতে যায়! শুধু তাই নয় একজন খুনিকে বীরের সম্মান দেওয়া হয়েছিল তখন। এলোকেশী হত্যা মামলা, বাংলার একটি বিরলতম খুনের মামলা। স্বামী নবীন চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বটি দিয়ে স্ত্রী এলোকেশীকে হত্যা করে ব্রিটিশ চৌকিদারের কাছে গিয়ে আত্মসমর্পণ করে।
ঠিক কী হয়েছিল জানব। তবে মূল ঘটনায় যাওয়ার আগে একটু দেখে নেব সেই সময়কার তারকেশ্বর মন্দিরের অবস্থাটা কেমন ছিল? তারকেশ্বর মন্দিরের পরিচলনের ভার ন্যস্ত থাকে গদির ওপরে। গদির কর্তারাই মন্দিরের পরিচালনা, পুজা ও নিয়ম শৃঙ্খলা রক্ষা করেন। তখন গিরিমোহন্তদের হাতে ছিল মন্দিরের গদির নিয়ন্ত্রণ। এক একজন মোহন্ত ছিলেন প্রবল প্রতাপ ও ধন সম্পদের অধিকারী। তাদের লেঠেল বাহিনী, দারোয়ান
এমনকি হাতি পর্যন্ত ছিল। সেই সময়ে একমাত্র সন্ন্যাসীরা হিমালয় পার করে তিব্বত পর্যন্ত যেতে পারতেন। আর এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বাণিজ্য করতেন গিরি মোহন্তরা। তারা ভুটান হয়ে ওল্ড সিল্ক রুট দিয়ে তিব্বত যেতেন ব্যবসা, বাণিজ্য করতে। স্বভাবতই শাসক ব্রিটিশদের সঙ্গে এই মোহন্তদের খাতির ও দহরম মহরম ছিল। তাই এরা হয়ে
উঠেছিলেন এক একজন জমিদার। মন্দিরের সম্পত্তির পাশাপাশি অনেকেরই ছিল বিপুল ব্যক্তিগত
সম্পত্তি। এরফলে মন্দিরের বেশ কিছু মোহন্তের বিরুদ্ধে অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগ উঠতে
থাকে। ১৮২৪এর ১৩ই মার্চ মোহন্ত শ্রীমন্ত গিরি এক বেশ্যার উপপতিকে খুনের দায়ে ফাঁসির
সাজা প্রাপ্ত হন। তবে এসবকিছুকে বোধহয় অতিক্রম করে ছিল এলোকেশী হত্যা মামলা। ১৮৭৩ সালের এলোকেশী হত্যা মামলাকে আজও তারকেশ্বরের ইতিহাসের একটা কালো অধ্যায় হিসাবেই ধরা হয়।
কালিঘাট পটচিত্র- মোহন্তের কাছে প্রতিদিন আসতে বাধ্য ছিল এলোকেশী
তারকেশ্বরের কাছেই কুমরুল নামের এক ছোট্ট গ্রামের ব্রাহ্মণ নীলকমল মুখোপাধ্যায়ের ছিল তিন কন্যা। বড় মেয়ে প্রসন্নময়ী,মেজ মেয়ে এলোকেশী, আর ছোট মেয়ে মুক্তকেশী। মেজ মেয়ে এলোকেশী ছিল রূপে অসামান্যা সুন্দরী। এলোকেশীর বিয়ে হয় কলকাতার বাবুনবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের
সঙ্গে।এদিকে নীলকমল মুখোপাধ্যায়ের প্রথম স্ত্রী বিয়োগের পর তিনি বিবাহ করেন মন্দাকিনী নামের এক মহিলাকে। মন্দাকিনীর সঙ্গে তারকেশ্বরের গিরি মোহন্তদের যোগাযোগ ছিল।
কালিঘাট পটচিত্র-মোহন্ত ও এলোকেশী
নবীনচন্দ্রের সঙ্গে এলোকেশীর বিয়ের পর নবীনের পরিবারেকেউ না থাকায় এলোকেশী থাকত তার বাপের বাড়ি কুমরুলে। আর নবীন চাকরিসুত্রে বসবাস করত কলকাতায়। এদিকে বিয়ের পরেও এলোকেশীর সন্তান না হওয়ায় সৎ মা মন্দাকিনী এলোকেশীকে নিয়ে যান তাঁর পূর্ব পরিচিত মোহন্ত মাধব গিরির কাছে। মোহন্ত সন্ন্যাসী হলেও শিবের আরাধনার আড়ালে ছিলেন মারাত্মক ব্যাভিচারি। মোহন্ত মাধব গিরি এলোকেশীকে কোনও নেশার ওষুধ খাইয়ে অচৈতন্য করে তার সতীত্ব নষ্ট করে। শুধু তাই নয় এলোকেশীর বাবা নীলকমলকে প্রচুর টাকাপয়সা পাঠায় মোহন্ত। একই সঙ্গে মোহন্ত জানত মন্দাকিনীর আছে সোনার গয়নার প্রতি অদম্য লোভ। সে মন্দাকিনীকে দেয় প্রচুর স্বর্ণালংকার। এভাবে প্রতিদিন একপ্রকার বাধ্য করে এলোকেশীকে তারকেশ্বরের মোহন্তের প্রাসাদে আসতে। রোজ বিকেলে কুমরুল থেকে প্রাসাদে এসে পরদিন সকালে বাড়ি ফিরত ১৩-১৪ বছরের এলোকেশী। একা নয়। তাকে নিয়ে আসত নীলকমলের বাড়ির লোকজন। কখনও প্রসন্নময়ী, কখনও মন্দাকিনী আবার কখনও বা কাজের ঝি তেলি বউ থাক। মোহন্ত মাধব গিরি আর এলোকেশীর অবৈধ প্রণয়ের এই ঘটনা নিয়ে চরম হাসাহাসি হয়, ক্রমে তা স্থানীয় মানুষজনের কাছে মুখরোচক চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে।
কালিঘাট পটচিত্র- নবীন আঁশ বটির কোপে হত্যা করে এলোকেশীকে
নবীন কলকাতায় থাকায় এসব কিছুই জানত না। কুমরুলে একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে সে এই ঘটনা জানতে পারে। একপ্রস্থ বাগবিতণ্ডা হয় নবীন-এলোকেশীর মধ্যে। এলোকেশী বলে এই অবৈধ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চায় সে, কিন্তু তা করতে চাইলে মাধব গিরি তাকে মেরে ফেলবে। নবীন হ্নতদন্ত হয়ে ছুটে যায় মোহন্তের প্রসাদে। মোহন্তকে একপ্রকার শাসিয়ে আসে সে। সে চায় এলোকেশীকে কলকাতা নিয়ে গিয়ে নতুন করে সংসার করবে। সেইমতো পালকি ভাড়া করে নবীন। কিন্তু মোহন্ত তার লেঠেল বাহিনী দিয়ে গোটা তারকেশ্বর ঘিরে ফেলেন। পালকি নীলকমলের বাড়ি পর্যন্ত আসতেই পারে না। এলোকেশীর কলকাতা যাওয়া আর হয়ে ওঠে
না। এমন অবস্থায় নবীন একটি আঁশবটি দিয়ে স্ত্রীর গলায় কোপ দিয়ে তাকে হত্যা করে। আর নিজে
পুলিশের কাছে গিয়ে আত্মসমর্পণ করে। কোর্টে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নিজের দোষ স্বীকার
করলেও নবীন জানায় এই পরিস্থিতির জন্য প্রকৃতপক্ষে দায়ি মোহন্ত মাধব গিরি। নবীনের হয়ে মামলা লড়েন উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। কোর্টে এই
মামলা চলাকালীন মামলার শুনানি সংবাদ পত্রের শিরোনাম হয়। লোকমুখে তা এত জনপ্রিয়তা পায় যে টিকিট কেটে
মানুষজন শুনানি দেখতে আসে।
পরবর্তীকালে
এই ঘটনায় মোহন্ত ও নবীন দুজনেই দোষী সাব্যস্ত হলেও কিছু বছর সাজা খেটে তারা জেল থেকে
মুক্ত হয়। নবীনকে বীরের সম্মান দিয়ে বাড়ি ফেরায় মানুষ। কিন্তু এই ঘটনা তারকেশ্বর সত্যাগ্রহ
ও অত্যাচারি গিরি মোহন্তদের হাত থেকে তারকেশ্বর মন্দিরকে মুক্ত করার ঘটনাক্রমে অনুঘটকের
কাজ করে। এলোকেশীর ঘটনার পর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু তারকেশ্বরে
আসেন। বহু পালা, যাত্রা, প্রহসন তৈরি হতে থাকে। কালিঘাট পটের বিষয় হয়ে ওঠে এলোকেশী মামলা। স্টার থিয়েটারে চলতে থাকে 'মোহন্তের একি কাণ্ড' পালা। মাইকেল মধুসুদন দত্তের নাটকের চেয়েও বেশি বিক্রি হত সেই সময়ে মোহন্ত মাধব গিরির ব্যাভিচারের নাটক। এলোকেশী হত্যা মামলা স্টার থিয়েটারকে খ্যাতির চূড়ায় তুলে আনে। তবে যতই কালো হোক না কেন এলোকেশীর ঘটনা। এই ঘটনায় যে জন জাগরণ হয়েছিল তাতে একজোট হয়েছিল বহু শুভ শক্তির যা তারকেশ্বরের অন্ধকার ও ব্যাভিচারের ইতিহাসকে শেষ করে।
এই ব্লগটির তথ্যসুত্র প্রজ্ঞা পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত শ্রী মানব মণ্ডলের বই - প্রসঙ্গ তারকেশ্বর। এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে দেখুন Wonder World Bangla য় প্রকাশিত এই বিস্তারিত ভিডিওটি।
ব্লগের লেখাটি আপনাদের কেমন লাগল, জানান আমাকে। নিচের কমেন্ট বক্সে আপনি কমেন্ট করতে পারেন। আপনার সুচিন্তিত মতামত, ভালো বা খারাপ যাই হোক না কেন, আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। আর কী ধরনের ব্লগ পড়তে চান? জানান সেটাও। আজ এই পর্যন্ত।
No comments:
Post a Comment