একটা গাছ ,তিনটে ইঁদুর ,সাতটা ঘড়ি , বাউল গানের আসর ,একটা হাতি এই ছবি গুলো শৈশব আর কৈশোর মনের কল্পনা। একটু অন্য রকম একটু সাধারণ চিন্তা ভাবনার চেয়ে সরে বাইরে গিয়ে। এগুলো এঁকেছে আদিত্য গাঙ্গুলি , উজ্জীবন রায় , অভিষেক সরকার , বর্ষা দেব , ঈশান গুহ , শুভ্রনীল দাস রা। শুভ্রনীলের কথা আমার আগের Blog এ বলেছি এরাও শুভ্রনীলের মত অনেক পাহাড় প্রমান অসুবিধে নিয়ে বাঁচে। আমাদের সাধারণ করে দেওয়া অভ্যাস , জেনারালাইজ করার জন্যে আমরা বলে থাকি ' প্রতিবন্ধকতা ' । কিন্ত ওদের একনিষ্ঠ প্রয়াস আজ হার মানিয়েছে ওই সাধারণ করে দেওয়া শব্দটাকে। সব বাধা , কষ্ট , নিজেকে ব্যক্ত করতে না পারার যন্ত্রনা , অনবরত মাথার ভেতর জ্বলে ওঠা হাজার ঝাড়বাতির আলোকে সামলে ওরা হয়ে উঠেছে অ-সাধারণ। প্রতিবন্ধকতা নামক অপমানটাকে নিজেদের গা থেকে ঝেড়ে ফেলে ওরা হয়ে উঠেছে একেকটা নয়নতারা।
অভিষেক কোন এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে পারে না। আনন্দের উচ্ছাসে বারবার কুঁচকে যাই অভিষেক সরকারের মুখ। মাথা নুয়ে এসে গলার সাথে লেগে যায়। সামাজিক জমায়েতে গুটিয়ে যায় অভিষেক সরকার কিন্ত ওর ছবি বলে অন্য কথা। যেন অন্য এক মানুষ বসত করে অভিষেকের মনের ঘরে যে একমনে ছবি আঁকে। যে ছবি ক্যানভাসের দ্বিমাত্রিকতা ছাড়িয়ে কখন যেন বহুমাত্রিকতায় পৌঁছে যায়।
অভিষেক সরকার |
অভিষেকের ছবি |
বর্ষার ছবির পরিমিতি বা শিল্পগুণ ছাড়াও কতটা নিখুঁত সেটা পরীক্ষা করতে হলে উপরের ছবি তা দেখুন। বাউলদের গলায় হারের পুঁতির সংখ্যা প্রায় সব ক্ষেত্রেই ১৭ , কয়েকটায় ১৮। ভাবতে অবাক লাগে এত ধৈর্য ও পায় কোথায়। আসলে ওটাই ওর অসুবিধে , অস্বস্তি। রিপিটেটিভ বিহেবিয়ার। ওদের কষ্ট, ওদের জিন ও পরিবেশ গত অসুবিধের কথা না হয় পরে দেখব পরে ভাবব এখন বর্ষার ছবি দেখি।
বর্ষা দেব |
পুনরাবৃত্তি বর্ষার ছবির বৈশিষ্ঠ কিন্ত শিশু শিল্পী মনের পরিস্ফুটনে সেই পুনরাবৃত্তি কখনোই একঘেঁয়েমি আনে না। বরং একটা বিস্তারকে দেখায়। এই বুঝি খেলনাঝুড়ি উপুড় হবে বেরিয়ে আসবে বর্ষার সিস্টার্স ইন ল , জুস ড্রিঙ্কার্স , বাউল এন্ড হিস্ ওয়াইফ, দেবীদের রূপসব বা অন্য চরিত্ররা। ওরা যেন সব পুতুল। যেন গুগাবাবার ড্রয়িং খাতার স্কেচ সব। মুখ গম্ভীর একই রকম কিন্ত কোথাও যেন সবাই মিলে জগতের আনন্দযজ্ঞে নিমন্ত্রণ জানাচ্ছে।
ছোট্ট ঈশানকে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করবে। অথচ ওর মনের গভীরে গেলে আপনার চরাচর মাখামাখি হয়ে যাবে নিদারুন এক বিষাদে। আপাতদৃষ্টিতে হাইপারঅ্যাক্টিভ বা চঞ্চল। কিন্ত ভাবতেও পারবেন না কী পরিমান উদ্বেগ বাসা বেঁধেছে ওই ক্ষুদেমনে!!! ঈশানের সব ইমোশনকে কন্ট্রোল করে মৃত্যুচিন্তা। ওকে পড়তে হবে পরীক্ষায় ভাল করার জন্যে , তবে ভাল চাকরি পাবে , চাকরি পেলে বিয়ে করে সংসার পাতবে , তবেই ওর সন্তানাদি হবে সেই সন্তান প্রতিষ্টিত হলে ও বৃদ্ধ হবে , দাদু হবে , তারপর অমোঘ সত্য- ওর তুঁহ মম শ্যাম সমান মরণ আসবে।মা চমকে ওঠেন। মা কে প্রশ্ন করে ঈশান তারপর আমার আত্মা আবার পুনর্জন্ম নেবে তো তুমিই আমার মা হবে তো।
"জন্মেছি আমি আগেও অনেক মরেছি তোমারই কোলে
মুক্তি পাইনি শুধু তোমাকেই আবার দেখব বলে "
আমাদের যুক্তিগ্রাহ্য মন ব্যাখ্যা পায় না কিভাবে শৈশব এমন সৎ ও সত্য ফিলোজফিকে আঁকড়ে ধরতে পারে। আসলে ওরা অমনই। খুব ছোটবেলায় এক মৃত্যু চোখের সামনে দেখে মৃত্যু সম্পর্কে মিথ ,ভয় ,আড়ষ্টতা কেটে মৃত্যুর প্রকৃত অবয়ব পরিষ্কার ঈশানের। তা হল মৃত্যুর চেয়ে বড় সত্য নেই তাই জীবনটাকে বাঁচো। প্রতি পাকে বাঁচো। ঘূর্ণির মত ঘুরছে পেন্সিল কালি কলম। বেরিয়ে আসছে একেকটা ছবি। আনন্দ পাচ্ছে ঈশান।নাক কুঁচকে চশমার তলায় হাসছে দুটো উজ্জ্বল চোখ।
ঈশান গুহ |
শুভ্রনীল দাস সম্বন্ধে আপনারা জেনেছেন। ওর লড়াই সম্পর্কে আমার ব্লগপাঠকরা ওয়াকিবহাল। ওর লেখাটার ক্যাপশনে আমি লিখেছিলাম ও খেলা করে ছায়াপথে। কিছু না জেনেই।ছবিগুলো দেখে মনে হয়েছিল ওটা ছাড়া ক্যাপশন হতেই পারে না। ব্লগটা দেখে শুভ্রনীলের মা চমকিত। কারণ। শুভ্রনীলের একটা ছবির ক্যাপশন Universe is my playground . তারমানে ট্রান্সমিট হচ্ছে। ও যেটা বলতে চাইছে সমাজ সেটা বুঝতে পারছে।ব্যাখ্যা করতে পারছে। তারমানেই আর্ট থেরাপি দিয়ে কেবল ওকে সুস্থতার পথ দেখানোতে থেমে থাকল না ওর আর্ট ওয়ার্ক। সমাজের গ্রহণযোগ্যতায় ফাইন আর্টসের পর্যায়ে উন্নীত হল শুভ্রনীলের কাজ।
গতকাল বিশ্ব অটিজম দিনে গগনেন্দ্র প্রদর্শশালায় ওরা এসেছিল। ওরা মানে আদিত্য,উজ্জীবন,অভিষেক,বর্ষা,ঈশান, শুভ্রনীলরা। ওদের সবারই রয়েছে কমবেশি অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার। সারা জীবনব্যাপী জটিল, মানসিক ও শারীরিক পরিবর্ধনের সমস্যার সম্মুখীন ওরা। ASD বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার কোন রোগ বা মেন্টাল রিটার্ডেশন নয়। সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা , শিক্ষাব্যাবস্থা ও তাদের ঠিকমত অভ্যাস ও অনুসরণ করলে সমাজে অটিস্টিক শিশুরা অর্থপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারে এরাই তার জ্বলন্ত উদহারণ। আরো অনেক উদহারণ পাবেন একটু গুগল করলেই।আলবার্ট আইনস্টাইন , মোৎজার্ট , লিউইস ক্যারোল , চার্লস ডারউইন এনারা সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে নক্ষত্র , এনারা সবাই কিন্তু অটিজমকে মোকাবিলা করেই জীবন যুদ্ধে শুধু জয়ীই নন পৃথিবীকে নতুন পথের দিশা দিয়েছেন ,কারণ তাঁরা অন্য ভাবে ভাবতে পারেন। অটিজম তাঁদের কাছে প্রতিবন্ধকতা নয় অস্ত্র। একটা এজেন্ট যখন আমাদের মস্তিষ্কে দুটো আলো জ্বালে তখন সেই একই এজেন্ট ওদের মাথায় কমপক্ষে ২০টি আলো জ্বালে। অটিজমের খুব সহজ ব্যাখ্যা বোধহয় এটাই। তাই সেই জ্বলে ওঠা ঝাড়বাতিটি যে একটু অন্যরকম আলো দেবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে কি ?
শুভ্রনীল দাস |
শুভ্রনীলের ছবি |
এবার এক নজরে দেখে নিন ২রা এপ্রিলের সন্ধ্যেটা কিভাবে কাটালো পৃথিবী। বুর্জ খলিফা থেকে নায়াগ্রা জলপ্রপাত, হোয়াইট হাউস থেকে কুতুব মিনার , রোমান ক্যাথলিক চার্চ থেকে সিডনি অপেরা হাউস , সারা পৃথিবীর সেরা সব স্থাপত্যগুলো রেঙেছিল অটিজিমের সচেতনতার প্রচারে ঘননীল রঙে। গোটা এপ্রিল মাসটা অটিজমের মাস। জানতে হবে। তবেই ওদের সুস্থ সুন্দর ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হবে। তাই #LightUpBlue হ্যাসট্যাগও জেনারেট হয়েছে।
No comments:
Post a Comment