Wednesday, May 9, 2018

মিছে কোলাহল - ২৫ শে বৈশাখ

Whatsapp এ একটা ছবি পেলাম। ছবিটা দেখে বমি বমি ভাব মানে বিবমিষা লাগছিলো। একজন মানুষ যাঁর কাজ বহু মানুষ কে আলোর পথ দেখিয়েছে তাঁর ব্যক্তি সত্ত্বার প্রতি আমাদের কিছু মানুষের অন্ধতা যেমন হতাশাব্যাঞ্জক তেমনই  কুরুচিকর ও হতাশাব্যাঞ্জক এই ফটোশপ। একটা বাজে লেখার শুরু করছি।
ছবি: ইন্টারনেট 


রবি ঠাকুর আপনার প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, সম্মান নেই আমাদের। যদিও আজ আপনার দিন, আজ আপনাকে নিয়ে গদগদ ভাবাবেশ। তবু আজই বোধহয় সত্যি কথাটা কনফেস করা প্রয়োজন। বাঙালির কাছে আপনার সবচেয়ে বড় পরিচয় আপনার সঙ্গীত। আপনার প্রবন্ধ গদ্য ছোটগল্পের ভাঁড়ার নিয়ে পশ্চিম বাংলার আম বাঙালির তেমন ইন্টারেস্ট নেই। আপনি বলতে সাধারণ বাঙালি যা বোঝে সেই সঙ্গীতের জনগণতান্ত্রীকতার জন্য বরাদ্দ এখন ট্রাফিক বাতির লাউড স্পিকার। যেখানে কাঠফাটা রোদে মিসম্যাচ আপনার একা জ্যোৎস্না রাতে ঘরে না থাকার আকুতি। ছুটন্ত শহর সময়ের পিছনে তাড়া করছে যখন, তখন আপনার সুর, কথা, কোথায় কী ?!! সেকেন্ড বদলাতে থাকা ইলেকট্রনিক মনিটরে তখন সব চোখ।
মাফ করবেন রবিন ঠাকুর!!! আজ আমরা আপনার ঐতিহ্য সম ব্যক্তিত্যের গায়ে পড়া আলোর প্রতিফলন টুকু নেওয়ার জন্য উন্মাদ। আপনার জন্মদিনে আপনার সৃষ্টি আপনার পৌত্তলিকতার কাছে হার মেনেছে। আপনি যতই দাবি করুন না কেন "মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক আমি তোমাদেরই লোক। " আমরা সযত্নে আপনাকে দামি, সুদৃশ্য, অ্যান্টিক শো পিসের মত সাজিয়ে গুজিয়ে আপনাকে দেবত্ব প্রদান করেছি। আপনার পুজোর বাহ্যিক আড়ম্বরে মৃত আপনার সৃষ্টি, আপনার মূল্যবোধ, আপনার অন্তরাত্মা। আর সেই ঠাকুর আপনির নৈবেদ্যর তলায় অবিশ্বাসের পচন, স্বার্থপরতার দুর্গন্ধ, হানাহানির শঙ্কা, আর ধর্মীয় মোহের অন্ধতা। আর ওপরে জেগে থাকে বাটিকের শৌখিন পাঞ্জাবি শাড়ি , বিদেশী পারফিউম আর রজনীগন্ধার বাহার।
সত্যি বলছি, একশো ভাগ খাঁটি, খুব রাগ হয়। আপনার অসহায়তা দেখে! আপনার ছবির বুক ঢেকে যাচ্ছে ফুলে, মালায়। অন্তরের নৈবেদ্য নেই, নেই আপনার কাজের চর্চা, আছে শুধু চোখ জ্বালা করা ধুপের ধোঁয়া, দীপের আলোর ধাপ্পাবাজি। কাগজে, পাথরে, কাপড়ে, সিল্কে, সুতিতে, টেরাকোটায়, তামায়, পিতলে, ব্রোঞ্জে, ফাইবার গ্লাসে আপনার মূর্তি বানানো। "প্রাণের ঠাকুর", "আলোর দিশারী", "জীবন কাণ্ডারী" নানান বিশেষণে আজ আপনি সবিশেষ। কিন্তু সত্যিটা ভাঙা রেকর্ডের মতই দূরে কোথাও একলা অবহেলায় বাজছে- "তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না করে শুধু মিছে কোলাহল, সুধা সাগরের তীরেতে বসিয়া পান করে শুধু হলাহল।" আপনি বাঙালির এস্ট্যাবলিশমেন্ট শট, গোটা জাতটার ব্র্যান্ড এম্বাসাডার, আইকনিক ফিগার। কিন্তু আপনার পর আপনাকে, আপনার চেতনার পথকে অনুসরণ করতে আমরা কী করেছি? বৎসরান্তে দুর্গাপুজোর মত পাড়ায় পাড়ায় মাচা ঠুকে ২৫শে বৈশাখ পালন, দু এক পিস সিডি রেকর্ড করা, ইউটিউব সিংগলস্ করা, বিজ্ঞাপনে আপনাার সৃষ্টির বিকৃতি করা, বিদগ্ধ মানুষজনের বৈবাহিক ডিভিডিতে আপনার গান এডিট করে লাগিয়ে দেওয়া।এই ভাবেই বাঙালি চর্বিত চর্বণ করছে ,করে চলেছে আপনাকে। আর মাল্টিপ্লেক্সের সিনেমার শুরুতে আপনার গানের ভ্যাঙানি ভার্সন - "জ্যান জ্ঞান ম্যান ইয়াধি ন্যাঈয়াক জ্যায় হে। হে হে রাভিন্দরনাথ!!বোধহয় এভাবে শুনতে ভাল লাগছে না, জানি কিন্তু কী করব বলুন! সত্য তো ভালতেও সত্য, মন্দতেও সত্য। আর ভাল লাগছে না বলেই লিখছি। আনুষ্ঠানিক উপাচারের বাইরে আজ কোথায় আপনি?  আমাদের দৈনন্দিন জীবন চর্চা, আমাদের দৈনন্দিন বিনোদন, আমাদের সৃষ্টি, কৃষ্টি, সংস্কৃতি আজ আপনাকে ছাড়াই সাবলম্বী। টেলিভিশন এর ভীষণ ভাষণ বা আধাখেঁচড়া বাংলা শুনে বড় হচ্ছে যে প্রজন্ম তাদের কথা তো বাদই দিন। যাদের হাতে টেলিভিশনাচারের গুরু দায়িত্ব তাদের আলমারিতে আপনি থাকলেও মননে - ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই । কিংবা সংবাদ পত্রে যাঁরা উদ্বেগ জনক খবরকে গুরুত্ব দেন যাঁরা, ধর্ষকাম কে ধিক্কার দিয়ে মনের মত বন্ধু বান্ধবী বা মাসাজ পার্লারের বিজ্ঞাপন আবার তাঁরাই ছাপেন। তাঁরাই আবার প্রান্তিকে বাড়ি করেন আপনার ছত্রছায়ায় থাকবেন বলে। আপনার নামে ট্রেন, বাস, হোটেল, ট্যুরিজম কোম্পানি, চায়ের দোকান, মনিহারী, চাউমিন ব্রান্ড। ঠাকুর, কিতনে আদমি হ্যায়!!! ও ঠাকুর হাট হাট। হাট বসেছে। আর সেই হাটে একমাত্র পণ্য আপনি। বিশ্বে বাংলার ব্রান্ড ভ্যালু আপনি। বাংলার ইউ এস পি, আপনি। অথচ আজ ভয়ঙ্কর ভাবে অনুপস্থিত আপনার অস্তিত্ত্ব। এ পোড়া জাতটাকে একবার বেঁচে উঠতে বলুন আপনার অন্তরাত্মাকে অনুসরণ করে। পৌত্তলিকতা , আপনার ভজনা আপনাকে আক্ষরিক অর্থে ঠাকুর বানিয়ে ফেলা বোবা বাঙালিকে বোকা বাঙালির বোধোদয় এর প্রার্থনা করুন আপনিও, রবীন্দ্রনাথ।
ছবি : ইন্টারনেট 

পরিশেষে আর একটি সোশাল সাইটে বহুল প্রচারিত ছড়া দিলাম ছড়িয়ে।

তোমার নামে সদন যেথায়,
সেথায় আমরা প্রেম করি ;
তিনটে স্টেশন তোমার নামে,
রোজ সকালে ট্রেfন ধরি !
ভর দুপুরে ট্রাফিক জ্যামে
রোদ্দুরেতে কাঠ ফাটে,
লাউড- স্পিকারে তোমারি গান –
“পায়ের চিহ্ন এই বাটে”
আজকে তোমার হচ্ছে পুজো
ঝাড়ছি ধুলো, জ্বালছি ধূপ
বেবিডল আজ কৃষ্ণকলি
তোমার ফটোয় ফুলের স্তূপ।
কাল-ই কিন্তু স্টোর রুমেতে তে
পাঠিয়ে দেব তোমায় ঠিক,
প্রাণ জুড়োবে গান শুনিয়ে
রেডিও মির্চি রাবীন্দ্রিক !
আজকে তোমার মুর্তি ধুয়ে
করছি আমরা পরিপাটি
কাল থেকে ফের তোমার মাথায়
কাক পক্ষী করবে পটি....
আমরা পড়ব ব্যস্ত হয়ে,
আই পি এল এই সব দিনই
দাড়িবুড়ো তোমার জন্যে
বরাদ্দ বস একদিন-ই.....
ফ্যান তো হেথায় ভালোই জোটায়
অরিজিত আর হানি সিং
তোমার ফ্যানের কাউন্ট জানো?
ছদ্মবেশী ভানুসিং?
তোমার নামে পেজ রয়েছে
ফেসবুকে আজ খান শয়েক....
স্বর্গ থেকেই লাইক ঠুকে দাও
পেজ গুলোতে খান কয়েক ....
দেখবে কেমন ভরে যাবে
তোমার এফ বি নিউজ ফিড...
দেড়শ বছর পরেও তুমি
ইকুয়ালি সুপারহিট .....
আধুনিকের সংগা তুমি
তুমি গুরু তুলনাহীন
তুমি বিনা আমরা যেন
ফুচকাটা টক জল বিহীন ....
আগামী মাস টা বিয়ের সিজিন
ব্যাস্ত থাকবো প্রায় দিনই
কবিগুরু তোমার জন্য
বরাদ্দ বস এক দিনই.....

অসম্ভব একটা খারাপ লাগা থেকে উৎপন্ন হওয়া হতাশা থেকে এই লেখাটা লিখলাম। কারো খারাপ লাগলে হয় পাগলের প্রলাপ বলে ভুলে যাবেন। নয়ত নিজ গুনে ক্ষমা করবেন। 


No comments: