কর্মজীবনের শুরুটা হয়েছিল তৎকালীন অবিভক্ত মেদিনীপুরে। ফলে সংবাদ মাধ্যমের বেশ কয়েকজন বন্ধু বান্ধব আছেন সেখানে। তাদের মধ্যেই কয়েকজনের জন্য ২০০৬ এর ২১ সেপ্টেম্বর মারাত্মক চিন্তায় কেটেছিল দিনটা। সেদিন মেদিনীপুরের লালগড়ের ঝিটকার জঙ্গলে ঘটেছিল এক ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। বন্ধু সৌম্যেশ্বর,সঞ্জীব এবং আরও কয়েকজন মারাত্মক আহত হন সেই দিন।
জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে একটি বাজেয়াপ্ত করা আইইডি ল্যান্ড মাইন নিস্ক্রিয় করার কথা ছিল সেইদিন। আর সেইমত সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটির কভারেজে গিয়েছিলেন অপু(সঞ্জীব) , সুমন, সোম( সৌম্যেশ্বর), দেবনাথ, অরুন দা রা। সব ঠিকঠাক চলছিল। ল্যাণ্ড মাইন ডিফিউজ করা শুরু হয়েছে। ক্যামেরা রোল করেছে। পুলিশ কর্মী দেখাচ্ছেন কিভাবে কাজটি করেন তাঁরা। হঠাৎ গগন বিদারী আওয়াজ। মারাত্মক আহত সোম আর অপু।
সোম বরাবর দারুণ ফ্রেমের জন্য যা খুশি তাই করত। বিস্ফোরণে ওই বোমার স্প্লিণ্টার ওর মুখে লাগে। একটা চোখ বাঁচিয়ে দিয়েছিল ক্যামেরা টা। অন্য চোখটা কেড়ে নিয়েছিল।
অপুর সারা গায়ে লেগে ছিল বোমার স্প্লিণ্টার। দুমাস শয্যাশায়ী হয়ে ছিল হাসপাতালে। আরও বন্ধুরাও আহত হয়েছিলেন।
আর ওই পুলিশকর্মী যিনি নিস্ক্রিয় করছিলেন আইইডিটি, তিনি মারা গিয়েছিলেন বিস্ফোরণের তীব্র অভিঘাতে।
সে দিন ওই ঘটনার পর যখন ওদের কোনও খবর পাচ্ছি না তখন প্রচণ্ড উৎকণ্ঠায় কাটছিল দিনটা, কলকাতায় আমিও সেদিন অ্যাসাইনমেণ্টে। সারাটা দিন কাজে মন দিতে পারিনি।
বারবার মনে পড়ছিল মেদিনীপুরে থাকাকালীন পঞ্চুর চকের নিত্ত নৈমিত্তিক আড্ডা। যে যার অ্যাসাইনমেণ্ট শেষ করে অলিখিত প্রেস ক্লাব, পঞ্চুর চকে এসে জুটত। কত আড্ডা হত- পেশগত, ব্যক্তিগত, সিরিয়াস, হালকা। সব যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।
কাট টু
বাংলাদেশ গিয়ে আলাপ হয়েছিল জহিরুলের সঙ্গে। ওখানে যতবার কভারেজে গিয়েছি ওর সাথে সখ্যতা বেড়েছে। জহিরুল (জনির) হঠাৎ বেশ কিছুদিন কোনও ফোন নেই, ফেসবুক আপডেট নেই কী খবর? জানা গেল রাবার বুলেট লেগেছে ওর হাতে। উত্তাল জনতার বিক্ষোভ কভার করছিল ও। দুমাস হাসপাতালে। তারপরেও ঢাকায় অন্য একটি বহুল আলোচিত আন্দোলন কভার করতে গিয়ে ভিড় থেকে উড়ে আসে ককটেল বোম,পুলিশকে লক্ষ্য করে। পুলিশের ঠিক পিছনে ক্যামেরায় চোখ রাখা জনির লিভারের একটু ওপরে এসে ফাটে সেই "ককটেল"। সে চোট কাটতেও সময় লাগে বেশ কিছু দিন ।
কাট টু
ছোট আঙারিয়া, গড়বেতা, কেশপুর নিয়ে উত্তাল মেদিনীপুর তখন রোজই সংবাদ শিরোনামে। আমাদের গাড়ির চালক ছিলেন যিনি তাঁর পিতৃদত্ত নামটাই জানতাম না। সবাই ডাকত "হণ্ডা দা" বলে। একদিন অ্যাম্বাসেডরের বনেটে বসে পা এর ওপর পা তুলে সেই প্রবীণ সারথি হণ্ডা দা বলেছিলেন, "দেখো বাবা আমরা খবর করতে এসেছি খবর হ'তে নয়"।
আজকের দিনে আর প্রাসঙ্গিক মনে হয় না ওই কথাগুলো। যখন দেখি বিপন্ন সহকর্মীদের ছবি বিজ্ঞাপন হয়। যখন দেখি কোমর জলে বা গলা জলে দাঁড়িয়ে কাজ করাটা অর্ডার অফ দ্যা ডে হয়।
একটু কি সিনেম্যাটিক হতে পারে না আমাদের মিডিয়ার শট ডিভিশন? গঙ্গায় জল উঠলে বা নামলে একটা বড় টাইমল্যাপস হয়ত ১০ সেকেণ্ডে আট ঘণ্টার গল্প বলতে পারত। যদি একটা স্টেডিয়াম তৈরি বা একটা বীজের অঙ্কুরোদগম দেখানো সম্ভব হতে পারে তাহলে জোয়ার ভাঁটা তো বাচ্চো কা খেল!
কিংবা একটা ড্রোণ উড়ে এসে যদি বিদ্ধস্ত আর্তদের জলমগ্ন স্কুলবাড়ি বা উঁচু দাওয়ায় ধরে তাহলে সেই হোভার শট হাজার শব্দকে থামিয়ে এক জোরালো প্রতিশব্দ রাখতে পারে জীবনের।
অথচ আজও বিপন্ন হতে হয় আমার আমাদের বন্ধু, ভাইবোনদাদাদিদিসম চিত্রগ্রাহকদের, সংবাদকর্মীদের। অথচ একটা সঠিক, একটা সেরা মুহূর্তের খোঁজে আমরা ভিউ ফাইণ্ডারে এক একটা জীবন অতিবাহিত করি। ক্যামেরাকে সন্তান সম আদরে সামলে রাখি। ক্যামেরাকে প্রেয়সীর মত আলিঙ্গন করি। পড়লে ক্যামেরাকে বুকের ওপর নিয়ে পড়ি। উঠলে ক্যামেরা মাথার ওপর নিয়েই উঠি, সব সমস্যা, প্রতিকুলতা, সমালোচনার ঊর্ধ্বে। অথচ...
কাট ইট (কী যাতা করে চলেছ তখন থেকে এসব কেউ দেখে নাকি? লেখে নাকি? শোনে নাকি? বলে নাকি? স্টপ ইট। প্যাক আপ... )
No comments:
Post a Comment