Thursday, May 20, 2021

করোনা যুদ্ধের জন্য কতটা ক্ষতিকর কাকলি ফার্নিচার মিম

করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গে "আসলি হিরো"র নাম কিন্তু ফেসবুক (এবং হোয়াটসঅ্যাপ যা কিনা আদতে ফেসবুকেরই ভগ্নী সংস্থা)। লক ডাউনে সব যখন স্তব্ধ তখন অক্সিজেন, আরটিপিসিআর টেস্ট, অ্যাম্বুলেন্স, খাবার সংক্রান্ত নানান সুলুক সন্ধান (পড়ুন 'লিড') আসছে সোশ্যাল মাধ্যম থেকে। কোথায় সহজে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায়। কোথায় সেফ হোম কোথায় কে নেগেটিভ রিপোর্ট দেখলেই খাবারের থালা নিয়ে হাজির হবে। তার সমস্ত খোঁজ এখানেই। 

দিকে দিকে বহু মানুষ লড়ছেন। লড়ছেন স্বার্থহীন ভাবে। লড়ছেন অপরের জন্য। এটাই বোধহয় একটা অতিমারি বা কঠিন সময় দিতে পারে আমাদের। অন্যের জন্য প্রাণপাত করছে মানুষ। ফেলো ফিলিংস আজ আশা দেখাচ্ছে আমাদের, এই অস্থির সময়টা পার করবার জন্য ভরসা যোগাচ্ছে। তারই মাঝে এল কাকলি ফার্ণিচার। টাইমলাইনে সুনামী বয়ে গেল। হরি দা পাঁচ দা থেকে নামিদামী কেষ্ট বিষ্টু সবাই উদ্বেলিত সেই ফার্নিচারের বোকা বোকা মিমে। আর এখানেই একটু পিছিয়ে গেলেন ওই কোভিড যোদ্ধারা। 

কেন বলছি? আপনি হয়ত ভাববেন চারিদিকে মৃত্যু আর আতঙ্কের বিভীষিকা তার মধ্যে দু'দণ্ডের হালকা ছলে মনোরঞ্জন খারাপ কি!  মাথা ঠাণ্ডা করে, আপনার সব বিষয়ে (ভিখিরির চাদর থেকে রাতের আদর) পাণ্ডিত্যের গুগলনামা সরিয়ে শুনুন তাহলে।  

ফেসবুক বা ইউটিউব জাতীয় সোশ্যাল সাইট গুলো চলে একটা অ্যালগরিদম মেনে। কেমন সেই অ্যালগরিদম? তার কয়েটা ফর্মূলা আছে। 
এক) আপনি যা দেখেন মানে যে ধরনের কন্টেন্ট দেখেন(ছবি,পোস্ট বা ভিডিও ) সেই ধরণের কন্টেন্টই আসবে আপনার নিউজ ফিডে। 
দুই) আপনার বন্ধুরা যে ধরণের কন্টেন্ট দেখে তারও কিছুটা প্রতিফলিত হয়। 
তিন) আপনি যাঁদের ফলো করেন তাঁরা যে ধরনের কন্টেন্ট দেখে। 
আর
চার) যে সব কন্টেন্ট ব্যাবসায়িক ভাবে প্রোমোটেড হয় ।

এবার প্রথম তিনটে পয়েন্টের মধ্যে যে কোনটা নিয়ে যদি কথা বলা যায়, ধরুন আপনার নিউজ ফিডে কমিউনিটি হেল্প সংক্রান্ত পোস্ট আসছিল। আপনার মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ছিল অনেকের মধ্যে যাঁরা এগুলো জানতেন না, বা জানতে চান, সাহায্য করতে চান। একটা জনজাগরন তৈরি হচ্ছিল। এর মাঝে হঠাৎ 'কাকলি ফার্নিচার' এসে সেই কমিউনিটি হেল্পের চেইনটাকে নষ্ট করে দিল। খেয়াল করে দেখুন সাম্প্রতিক কালে রেড ভলান্টিয়ার, অ্যাক্টিভ ইউথ, নিউটাউন ফোরাম এণ্ড নিউজ, স্বপ্ন দেখার উজান গাঙ, কেডিস কিচেন বা আনাড়ি কিচেন দের পোস্ট আপনি কম দেখতে পাচ্ছেন। বেশী পাচ্ছেন কাকলি ফার্নিচার। 
অ্যালগরিদম ফারাক বোঝে না। আপনার ক্লিক বোঝে আপনি কী দেখছেন সেটা বোঝে। পারবেন কি এই দায়টা এড়াতে।

Monday, May 17, 2021

প্রকৃতির প্রতিশোধ

২০-০৫-২০ থেকে ঠিক ৩৬২ দিন পর আজ আবার একটা জাতীয় বিপর্যয়ের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দেশ। গুজরাতে তাণ্ডব চালাতে চলেছে ঘূর্ণিঝড় তাউট। আমফানের স্মৃতি এখনও টাটকা তাই আশঙ্কায় বুক দুরুদুরু। ইতিমধ্যে প্রিমাথ শুরু হয়ে গেছে কেরল, মহারাষ্ট্র আর কর্ণাটকে। 

এখনও মনে আছে ২০ মে ২০২০র সন্ধ্যে আর তার আগে ও পরের দিন গুলো। একটা আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেলের জন্য কাজ করছিলাম তখন। খুব সামনে থেকে দেখেছি তাণ্ডবনৃত্য ও তার দরুণ হয়ে যাওয়া ক্ষয়ক্ষতি। মহামারী পরিস্থিতি একে চালাচ্ছে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি তার মধ্যে প্রাকৃতিক তাণ্ডব। আমি অবশ্য তাণ্ডব না বলে প্রতিশোধই বলব। আমাদের দৈনন্দিন জীবন যত সময় যাচ্ছে প্রকৃতি বিমুখ হয়ে পড়ছে আর তারই প্রতিশোধ তুলছে প্রকৃতি। শুধু বাক্স বাক্স বাড়ি ঘরদোর। প্রকৃতিকে প্রায়োরিটি লিস্টে রাখে না কেউই। না জনগন না সরকার। তাই উন্নয়নের নামে সারা দেশ জুড়ে যথেচ্ছাচারটাই এখন দস্তুর। 

সবাই সহ্য করে প্রকৃতি সহ্য করে না। সে ঠিক তার নিজের ভারসাম্য বজায় রাখে। আর তাই এই প্রাকৃতিক রোষ!  মানুষ এই পৃথিবীটাকে নিজের করায়ত্ব করে ফেলেছে বলে যত আস্ফালন দেখাবে ততই বাড়বে এই ধরনের তাণ্ডব। নীরব দর্শক হয়ে ক্ষয় ক্ষতির হিসেব গোনা ছাড়া আর কিছুই করবার নেই এখন। অতএব এখন শুধু প্রতীক্ষা ডেথ টোল কত হয়, হাওয়ার বেগ কত হয়, কত দ্রুত উপকূলবর্তী মানুষদের নিরাপদ আস্তানায় নিয়ে যাওয়া যায়। 

মন থেকে চাই আর যেন মৃত্যুর নতুন রাজত্ব কায়েম না হয়। মানুষ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন। যদিও জানি ১১০ কিলোমিটার বেগে হাওয়ায় কী হতে পারে। তাউট নাকি ১৮৫ প্রতি কিলোমিটার বেগে আছড়ে পড়বে। তাই আশঙ্কাটা বাড়ছেই। 

Tuesday, May 4, 2021

"আমি অনেকদিন খেলতে যাই না"



প্রায় একটা বছরের বেশি হয়ে গেল আমরা ঘেঁটে গেছি। ভাইরাসের ভিমরুলে ভিরমি খেয়ে দিশাহারা হয়ে গেছি। মেলামেশা বন্ধ। আদানপ্রদান বন্ধ। মুখ নাক খুলে শ্বাস নেওয়া বন্ধ। সবচেয়ে বেশি কষ্ট ছোটদের। ওরা ওদের সামান্য প্রাপ্য, দাবী, আবদার গুলো কীভাবে স্যক্রিফাইস করছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আমার কন্যা সবে সাড়ে চার। সে এখনই বুঝতে শিখে গেছে বাবা দরজার বাইরে বেরিয়ে ফিরে এলে স্যানিটাইটাইজড না হলে কাছে আসতে নেই। নিজেকে বাঁধতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। 
তো তার ক্লাস হয় অনলাইনে। সেলফোন মনিটারে চোখ রেখে মাঝেমাঝে সহপাঠীদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। রোজ আমার স্ত্রীই ওকে নিয়ে বসেন অনলাইন স্কুলে। একদিন আমি বসলাম। মেয়ে আমার সেদিন খুব খুশি। সর্পের পঞ্চপদ দর্শন হয়েছে তার। ক্লাসে মন নেই। ম্যাডাম যা যা ইন্সট্রাকশন দিচ্ছেন কিচ্ছু শুনছে না। আমি তো গলদঘর্ম। অডিও অফ করে বকুনি দিলাম, "বী অ্যাটেনটিভ"! এরপর শুরু হল নতুন এক ঘটনা। আয়নার যেমনটা দেখা যায় তেমন লিখতে লাগল সে ইংরেজি বর্ণমালা। মানে মিরর ইমেজে B, C, D, J, K ইত্যাদি। আমার রাগ আরও বেড়ে গেল। চুপ থাকলাম। ক্লাসের শেষে ফোন বন্ধ করে তাকে খুব কড়া করে বকলাম। 
-আজ থেকে একদম কার্টুন দেখবে না
-টিভি চালানো বন্ধ, আর একদম খেলাও বন্ধ, কোথাও খেলতে যাবে না। 
- সে চুপ। মাথা নিচু করে চলে গেল। 
পাঁচ ছয় পা গিয়ে ঘুরে আমার দিকে হনহন করে এগিয়ে এসে চিৎকার করে বলল
-আমি অনেকদিন হয়ে গেল কোথাও যাই না, কারও সঙ্গে খেলতে যাই না। আমার কোনও বন্ধু নেই। 

আমার মাথাটা নিচু হয়ে গেল। সত্যিই তো ও তো আর খেলতে যায় না। কেন এরকম বললাম? এরপর শুরু হল ভয়। মেয়েটা আমার ডিসলেক্সিয়া আক্রান্ত হয়েছে নাকি? উল্টো লিখছে কেন? সারাদিন মাথায় ঘুরতে লাগল - আমি অনেকদিন হয়ে গেল কোথাও যাই না, কারও সঙ্গে খেলতে যাই না। আমার কোনও বন্ধু নেই। 
সন্ধ্যেয় বাড়ি ফিরে আমার স্ত্রীকে বললাম। সে বলল কোনও ডিসলেক্সিয়া নয় ওটা দুষ্টুমি। মেয়েকে ডাকলাম, "মাম্মাম চলো আমরা ছবি আঁকব " A  দিয়ে একটা তীর, B দিয়ে বল, C দিয়ে বেড়াল। D টা ইচ্ছে করে ওকে লিখতে দিলাম। ও আবার উল্টো ক্যাপিট্যাল D লিখল। আমি এবার না রেগে, হেসে বললাম, 
- এটা তো ভুল হয়ে গেল। এটা কি ডি হল? 
- বাবা এটাও ঠিক। এটা আসলে স্মল ডি। আমি ওপরের স্ট্যাণ্ডিং লাইনটাতো দিই নি। 
বলে উল্টোনো ডিএর ওপর একটা দাগ টেনে তাকে স্মল ডি করে দিল। 

আসলে ওরা যারা আমার মেয়ের সমবয়স্ক তারা সবচেয়ে বেশি মানসিক চাপের মধ্যে আছে। যে বয়সটায় ওদের চারপাশটা এক্সপ্লোর করবার সময়, সেই বয়সে ওরা বাধ্য হচ্ছে ঘরে বাঁধা হয়ে থাকতে। অথচ ওদের এই অসুবিধাটা বলে বোঝাবার মত শব্দ ওদের কাছে নেই। তাই ওদের এই কনফাইনমেন্ট, অ্যাগ্রেশন হয়ে বের হচ্ছে। কেউ চিৎকার করছে, কেউ ঘ্যানঘ্যান করছে কেউ বদমায়েসি করছে। মোদ্দা কথা ওরা ভাল নেই। আর কেউ চিন্তিতও নন ওদের নিয়ে। 

এশিয়ার বেশ কয়েকটা দেশে প্রিস্কুলার বাচ্চারা যাতে ভাল থাকতে পারে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল করোনার প্রথম তরঙ্গের সময়ে। তরঙ্গ কিছুটা স্তিমিত হলে খোলা হয়েছিল স্কুলও। খুব সম্ভবত মালয়েশিয়ার একটা স্কুলের ছবিও দেখেছিলাম খবরে। শারিরীক দূরত্ববিধি মেনে প্রতিটি শিশুর চারিদিকে স্বচ্ছ দেওয়ালের ঘেরাটোপ দিয়ে ক্লাস চলছে। ওরা তার মধ্যে দিয়ে বন্ধুদের দেখছে, কমিউনিকেট করছে, হাসছে খেলছে, আর সবচেয়ে বড় যে বিষয়টা "আমি একলা নই" এই অনুভূতিটা পাচ্ছে। 
আমাদের দেশে। এরকম যদি কোনও স্কুল করতে চায়, পরীক্ষামূলক ভাবেও। তাহলে। অবস্থাটা কল্পনা করুন একবার।

অতএব বিরাট কোহলিরা কেন খেলতে পারছে না আইপিএল তা নিয়ে না হয় আলোচনা হোক। তর্ক হোক। চায়ের কাপে, হোয়াটসঅ্যাপে মারামারি, মারকাটারি হোক । আর আমার আপনার ছোট্ট কচিকাঁচা গুলো তাদের বন্ধুদের দেখতে না পেয়ে, বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে না পারার কষ্টে গুমরে গুমরে মরুক ঘরের কোনে। তাতে কি আর এমন এল গেল? 

Disclaimer : এই লেখাটি শিশুমনের অত্যন্ত অন্তরীণ একটি বিষয় নিয়ে। এই লেখার উদ্দেশ্য কখনই করোনাবিধি ভঙ্গ করা না। করোনার তৃতীয় তরঙ্গ শিশুদের জন্য মারাত্মক। শিশুর সুরক্ষা সম্বন্ধে অবহিত থাকুন। সুরক্ষা বিধি মেনে চলুন। বাড়ির মানুষদের সঙ্গে বেশি করে সময় কাটান। কে বলতে পারে আজ আছি কাল হয়ত নেই।