প্রায় একটা বছরের বেশি হয়ে গেল আমরা ঘেঁটে গেছি। ভাইরাসের ভিমরুলে ভিরমি খেয়ে দিশাহারা হয়ে গেছি। মেলামেশা বন্ধ। আদানপ্রদান বন্ধ। মুখ নাক খুলে শ্বাস নেওয়া বন্ধ। সবচেয়ে বেশি কষ্ট ছোটদের। ওরা ওদের সামান্য প্রাপ্য, দাবী, আবদার গুলো কীভাবে স্যক্রিফাইস করছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আমার কন্যা সবে সাড়ে চার। সে এখনই বুঝতে শিখে গেছে বাবা দরজার বাইরে বেরিয়ে ফিরে এলে স্যানিটাইটাইজড না হলে কাছে আসতে নেই। নিজেকে বাঁধতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
তো তার ক্লাস হয় অনলাইনে। সেলফোন মনিটারে চোখ রেখে মাঝেমাঝে সহপাঠীদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। রোজ আমার স্ত্রীই ওকে নিয়ে বসেন অনলাইন স্কুলে। একদিন আমি বসলাম। মেয়ে আমার সেদিন খুব খুশি। সর্পের পঞ্চপদ দর্শন হয়েছে তার। ক্লাসে মন নেই। ম্যাডাম যা যা ইন্সট্রাকশন দিচ্ছেন কিচ্ছু শুনছে না। আমি তো গলদঘর্ম। অডিও অফ করে বকুনি দিলাম, "বী অ্যাটেনটিভ"! এরপর শুরু হল নতুন এক ঘটনা। আয়নার যেমনটা দেখা যায় তেমন লিখতে লাগল সে ইংরেজি বর্ণমালা। মানে মিরর ইমেজে B, C, D, J, K ইত্যাদি। আমার রাগ আরও বেড়ে গেল। চুপ থাকলাম। ক্লাসের শেষে ফোন বন্ধ করে তাকে খুব কড়া করে বকলাম।
-আজ থেকে একদম কার্টুন দেখবে না
-টিভি চালানো বন্ধ, আর একদম খেলাও বন্ধ, কোথাও খেলতে যাবে না।
- সে চুপ। মাথা নিচু করে চলে গেল।
পাঁচ ছয় পা গিয়ে ঘুরে আমার দিকে হনহন করে এগিয়ে এসে চিৎকার করে বলল
-আমি অনেকদিন হয়ে গেল কোথাও যাই না, কারও সঙ্গে খেলতে যাই না। আমার কোনও বন্ধু নেই।
আমার মাথাটা নিচু হয়ে গেল। সত্যিই তো ও তো আর খেলতে যায় না। কেন এরকম বললাম? এরপর শুরু হল ভয়। মেয়েটা আমার ডিসলেক্সিয়া আক্রান্ত হয়েছে নাকি? উল্টো লিখছে কেন? সারাদিন মাথায় ঘুরতে লাগল - আমি অনেকদিন হয়ে গেল কোথাও যাই না, কারও সঙ্গে খেলতে যাই না। আমার কোনও বন্ধু নেই।
সন্ধ্যেয় বাড়ি ফিরে আমার স্ত্রীকে বললাম। সে বলল কোনও ডিসলেক্সিয়া নয় ওটা দুষ্টুমি। মেয়েকে ডাকলাম, "মাম্মাম চলো আমরা ছবি আঁকব " A দিয়ে একটা তীর, B দিয়ে বল, C দিয়ে বেড়াল। D টা ইচ্ছে করে ওকে লিখতে দিলাম। ও আবার উল্টো ক্যাপিট্যাল D লিখল। আমি এবার না রেগে, হেসে বললাম,
- এটা তো ভুল হয়ে গেল। এটা কি ডি হল?
- বাবা এটাও ঠিক। এটা আসলে স্মল ডি। আমি ওপরের স্ট্যাণ্ডিং লাইনটাতো দিই নি।
বলে উল্টোনো ডিএর ওপর একটা দাগ টেনে তাকে স্মল ডি করে দিল।
আসলে ওরা যারা আমার মেয়ের সমবয়স্ক তারা সবচেয়ে বেশি মানসিক চাপের মধ্যে আছে। যে বয়সটায় ওদের চারপাশটা এক্সপ্লোর করবার সময়, সেই বয়সে ওরা বাধ্য হচ্ছে ঘরে বাঁধা হয়ে থাকতে। অথচ ওদের এই অসুবিধাটা বলে বোঝাবার মত শব্দ ওদের কাছে নেই। তাই ওদের এই কনফাইনমেন্ট, অ্যাগ্রেশন হয়ে বের হচ্ছে। কেউ চিৎকার করছে, কেউ ঘ্যানঘ্যান করছে কেউ বদমায়েসি করছে। মোদ্দা কথা ওরা ভাল নেই। আর কেউ চিন্তিতও নন ওদের নিয়ে।
এশিয়ার বেশ কয়েকটা দেশে প্রিস্কুলার বাচ্চারা যাতে ভাল থাকতে পারে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল করোনার প্রথম তরঙ্গের সময়ে। তরঙ্গ কিছুটা স্তিমিত হলে খোলা হয়েছিল স্কুলও। খুব সম্ভবত মালয়েশিয়ার একটা স্কুলের ছবিও দেখেছিলাম খবরে। শারিরীক দূরত্ববিধি মেনে প্রতিটি শিশুর চারিদিকে স্বচ্ছ দেওয়ালের ঘেরাটোপ দিয়ে ক্লাস চলছে। ওরা তার মধ্যে দিয়ে বন্ধুদের দেখছে, কমিউনিকেট করছে, হাসছে খেলছে, আর সবচেয়ে বড় যে বিষয়টা "আমি একলা নই" এই অনুভূতিটা পাচ্ছে।
আমাদের দেশে। এরকম যদি কোনও স্কুল করতে চায়, পরীক্ষামূলক ভাবেও। তাহলে। অবস্থাটা কল্পনা করুন একবার।
অতএব বিরাট কোহলিরা কেন খেলতে পারছে না আইপিএল তা নিয়ে না হয় আলোচনা হোক। তর্ক হোক। চায়ের কাপে, হোয়াটসঅ্যাপে মারামারি, মারকাটারি হোক । আর আমার আপনার ছোট্ট কচিকাঁচা গুলো তাদের বন্ধুদের দেখতে না পেয়ে, বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে না পারার কষ্টে গুমরে গুমরে মরুক ঘরের কোনে। তাতে কি আর এমন এল গেল?
Disclaimer : এই লেখাটি শিশুমনের অত্যন্ত অন্তরীণ একটি বিষয় নিয়ে। এই লেখার উদ্দেশ্য কখনই করোনাবিধি ভঙ্গ করা না। করোনার তৃতীয় তরঙ্গ শিশুদের জন্য মারাত্মক। শিশুর সুরক্ষা সম্বন্ধে অবহিত থাকুন। সুরক্ষা বিধি মেনে চলুন। বাড়ির মানুষদের সঙ্গে বেশি করে সময় কাটান। কে বলতে পারে আজ আছি কাল হয়ত নেই।