" ব্যাক টু ব্যাক দো টি২০ ম্যাচ, হ্যাণ্ড হেল্ড ক্যামেরা পজিশন। দাদা আপ সে হো পায়েগা না?" ফোনে বলেছিলেন রমেশ সিনহা। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে আমাকে বুক করবার সময়ে। টানা ৪০ দিন সেবার কেটেছিল ৩৬টা ক্যামেরা ইউনিটের মাঝে। ডিরেক্টর অস্ট্রেলীয় টিম ফিনলে (Tim Finley)। পকেটে তাঁর অনেকগুলো ওয়ার্ল্ড কাপ আর প্রায় সব কটা আইপিএল ডিরেক্ট করবার অভিজ্ঞতা। ডিওপি সাউথ আফ্রিকার মরিস ফরি (Marius Fourie)। সঙ্গে ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা, কানাডা আর জার্মানির একঝাঁক অভিজ্ঞ ক্রু মেম্বার। "দাদা আপ সে হ পায়েগা"র দোলাচল ভুলে টুর্নামেন্টের ২য় ম্যাচে মানে প্রথম দিনেই ওয়েল ডান বলে গেলেন রমেশ স্যার। ঢাকা, চট্টগ্রাম , সিলেট টৈ টৈ করে কেটে যাওয়া ৪০টা দিন আজও জীবনের অন্যতম সেরা অ্যাসাইনমেন্ট হয়ে থাকবে।
রোজ ভোর ৬টায় ঘুম থেকে উঠে সাতটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট সেরে ক্রু বাসের জন্য অপেক্ষা করা। আর সেই বাসটার দরজা খুলে গেলে প্রতিদিন বাসটায় ওঠার সময়ে রোমাঞ্চ জাগত। যেকোনও প্রফেসনাল ক্যামেরাম্যানের স্বপ্নে থাকে ওরকম একটা বাসে সওয়ার হওয়ার। বাসটা স্টেডিয়ামে থামলেই যে যার কাজে লেগে যাবে। স্ট্যাম্প ক্যাম আর হক আই প্রথমে সেট হবে তারপর স্পাইডার ক্যাম। তারপর ড্রোন। ততক্ষণে একটা কফি নিয়ে ম্যানড ক্যামেরার অপারেটরদের সঙ্গে একটা মিটিং করবেন টিম আর মরিস। সেটা মিটিং কম মজাই বেশি। টিম মানুষটা বেশ মজার। বিশেষ করে ওনার জন্যই ক্রিকেট ব্রডকাস্টের প্রাথমিক জড়তাটা কেটেছিল। বয়স ষাট পেরিয়েছে। প্রথম জীবনে ছিলেন ক্যামেরাম্যান। প্রথম মিটিংয়েই বলেছিলেন। পর পর দুটো ম্যাচ এই কথাটা মাথায় ঢুকিও না। হ্যাব ফান। এণ্ড এনজয় দ্যা গেম। আর আমদের উদ্দেশ্যে মানে আমি আর টিটু র উদ্দেশ্যে বলেছিলেন হ্যাণ্ড হেল্ড ক্যামেরা অকারনে কাঁধে রাখলে আমি মাঠে গিয়ে হাঁটু ভেঙে দিয়ে আসব। রিল্যাক্স করবে, যতটা সম্ভব। বিশ্বাস করুন সব জড়তা কেটে গিয়েছিল। মিটিংয়ের পর মাঠে যে যার পজিশনে চলে যাবে। শুরু হবে ফ্যাক্টস চেক। অডিও, সুপার স্লো মোশান , আলট্রা স্লো মোশান, অ্যাগুমেণ্টেড আর ভার্চুয়াল রিয়েলিটি গ্রাফিক্স। আর তার দু ঘণ্টা পর ম্যাচ শুরু। ২টো ম্যাচের শেষে শুরু হবে "ডি রিগ"। ক্যামেরা ডিসমেন্টাল করে বক্সে প্যাক করে প্রায় কয়েক কিলোমিটার কেবল গুটিয়ে তারপর সব জিনিসপত্র আসত স্টেডিয়ামের নির্দিষ্ট একটা জায়গায়। নিজেদের কাজ শেষ করবার পর কাজ শুরু হত আমাদের। আমি অয়ন সৌমেন দা আর মরিস। সব ইউনিট আর কেবল মার্কিং করে তা লিপিবদ্ধ করে তবে আমাদের ছুটি হত।
হোটেলে ফিরে ডিনার পেটে পড়লেই ঘুম আসত। ছুটির দিনে সকালটা কাটত টিভি দেখে। বেশিরভাগ "গান বাংলা"ই দেখতাম। ওদের কর্ণধার তাপস মাঠে আসতেন। দেখা হত রোজই। নিজেও দারুণ মিউজিশিয়ান। তাছাড়াও দেখতাম খবরের সব চ্যানেল গুলো। অদ্ভুত এক সহাবস্থান বাংলাদেশের নিউজ মিডিয়াগুলোর। আমাদের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের সম্প্রচার সত্ত্ব বাংলাদেশে ছিল মাছরাঙা টেলিভিশনের আর গ্লোবাল রাইট ছিল ডি স্পোর্টসের। ম্যাচের প্রতিদিনের হাইলাইটস যখন অন্য চ্যানেল দেখাত তখন তারা স্পস্ট লিখত "সৌজন্য মাছরাঙা টিভি"। আমাদের এই বাংলায় দুটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা বিরল। তাছাড়াও দেখতাম একটি চ্যানেলে অন্য চ্যানেলের অস্তিত্ব স্বীকার করবার রেওয়াজ। বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে যাবার ফলে একাধিকবার দেখেছি বৈশাখী টিভির জন্মদিনে একাত্তর টিভি ফুলের বোকে পাঠাচ্ছে এবং সেটা খবর হিসাবে প্রচারিত হচ্ছে! ভাবুন বিষয়টা।আর আমাদের এখানে পরিবেশটা এমন যেন এবিপি আনন্দ ভাবে ২৪ ঘন্টা মঙ্গল গ্রহের বাসিন্দা। ২৪ ঘণ্টা মনে করে কলকাতা টিভি এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিতে থাকে, কলকাতা টিভির কাছে দূর কোনও নক্ষত্রের বাসিন্দা টিভি ১৮। অন্তত চ্যানেল গুলো দেখলে যেন তাই মনে হয়। তখন হোটেলের একাঘরে বসে বসে বারবার মনে হত কেন এমন আমাদের বাংলায়, পশ্চিমবঙ্গে, হয় না।
দুই বাংলাতেই মিডিয়াকর্মীরা প্রতিদিন একসাথে কর্মক্ষেত্রে থাকে। ওপার বাংলায় ওরা একসাথে রবার বুলেট আর পেট্রল বোমা বা ককটেল বোমা একসাথেই খেয়েছে । আর এখানেও আমরা লাঠি, টিয়ার গ্যাস বা স্প্রিন্টার একসাথেই খাই। বন্ধুতা না থাকলে সেটা হয়? এই কিছুদিন আগে ধাপায় গিয়েছিলাম একটা স্টোরি কভার করতে। ধাপার শ্মশান। ওখানে গিয়েই মনে পড়ল আজকালের ফটোগ্রাফার রনি দার কথা। রনি দার নশ্বর দেহটা ওই চুল্লি থেকেই ধোঁয়া হয়ে বাতাসে মিশে গিয়েছিল। বন্ধুত্ব না থাকলে সেটা হয়? শুধুই কি ব্র্যাণ্ডিং। খুব অল্প দিনের সাক্ষাত তবু আজও মিডিয়া সিটির ৩ নম্বর লিফটটায় উঠলেই মনে পড়ে অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখটা। বড় অল্প দিনের মেহেমানরা সব আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
আজ এই পয়লা আগস্ট সেই খেদ একটু হলেও মিটল একটা ছোট্ট ছবিতে। এই ছবিটা ঐতিহাসিক একটা দলিল হয়ে থাকল পশ্চিমবাংলার বেসরকারি মিডিয়া ইণ্ডাস্ট্রিতে। দেখুন ব্রেকিং, এক্সক্লুসিভ, সবার আগে খবর ধরানোর লড়াইটা তো থাকবেই। সুস্থ প্রতিযোগিতা উৎকর্ষতা আনেই। তা বলে বন্ধুতা রাখতে দোষ কোথায়? আর বন্ধুতা থাকলে সেই বন্ধুতা স্বীকার করতেও দোষ কোথায়? সেলিব্রেশনের দিন আজ। কি তাই না? তবে দুঃখ একটাই সেটা স্বীকার করতে এতটা দেরি হল। আর আনন্দ একটাই অবশেষে বন্ধুত্বের জয় হল।
1 comment:
খুব ভালো লিখেছ। রনিদার মনে করালে। 'সে যেন আমার পাশে আজও বসে আছে।'
Post a Comment