একটা উজ্জ্বল কমলা রঙা পাঞ্জাবি পরে বসে ছিলেন লালা মিঞা। বড় একটা ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন সূর্যদা। সঞ্জীব খান আর আমি ক্যামেরা ট্রাইপডে ফেলে গোগ্রাসে গল্প শুনেছিলাম বুগু'র মুখ থেকে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে যখন রাত বাড়ল সুগন্ধী দিয়ে ধোয়া ঘরটা থেকে বেরিয়েছিলাম আমরা। 'মাধুকরী', 'কোজাগর', 'কোয়েলের কাছে', 'রুআহা', 'সোপর্দ', 'চান ঘরের গান', 'ওয়াইকিকি' আর 'ঋজুদা'র স্রষ্টা তখন তাঁর আতিথেয়তার ষোলকলা সম্পাদন করেছেন। বেশ কয়েকটা এপিসোড ধরে "তারাদের বেড়ানো" দেখিয়েছিলাম আমরা।
তার অনেকদিন পর। বন বিভাগের একটা ভিডিওর কাজ করছিলাম। রাস্তার বুলেভার্ডে গাছ লাগাচ্ছিল বন দপ্তরের আরবান ফরেস্ট্রি বিভাগ। ওই বিভাগের মৈত্রেয়ি দি গুহ স্যার বলতে অজ্ঞান। সব শুট সেরে একটা দিন রাখলাম "গুহ স্যারের" জন্য। ওয়াটারলু স্ট্রীটের অফিসে সময় দিলেন তথাগত। বুদ্ধ মানে তো তথাগতই! একটা সবুজ রঙের পাঞ্জাবী পরে পান জবজবে মুখে পরিচিত হাসি মাখিয়ে বসে আছেন তিনি। আমাদের স্ক্রিপ্টে ওনার জন্য ছিল বাংলা টপ্পা, আর দুলাইন কনজারভেশনের বার্তা। গান শেষ হতে জলখাবার আর চা এল। তারপর পান। তখন পুজো আর কিছুদিন বাকি। বাইরে উজ্জ্বল বর্ষা শেষের আলো। আর পুরনো ফাইলের মধ্যে বসে তাঁর দ্যুতি ছড়াচ্ছিলেন বুদ্ধদেব গুহ।
ময়দানের ইস্টবেঙ্গল কর্তা কল্যাণ মজুমদার রাশভারী মানুষ। কিন্ত লালাদার প্রসঙ্গ উঠলে আবেগে, সম্ভ্রমে গলে জল প্রাক্তন বিমান কর্তা ও সাহিত্যিক কল্যাণ মজুমদার। বুদ্ধদেব গুহ'র স্ত্রী ঋতু গুহ যখন প্রয়াত হলেন প্রায়ই কথা হয়েছে কল্যাণবাবুর সঙ্গে। প্রসঙ্গ বুদ্ধদেব গুহ। ভাঙছিলেন একদা শিকারি পরবর্তী জীবনে সংরক্ষণকামী মানুষটা। তারই মধ্যে একবার দেখা হল ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের অনুষ্ঠানে। প্রণাম করতে গেলাম, প্রতিবারের মত বললেন, "প্রণাম করো না, প্রণম্য মানুষ আর একশৃঙ্গ গণ্ডার দুটিই বিরল"। হাসিমুখটা আজ বড্ড মনে পড়ছে।
শেষ কথা। টিভি নাইন বাংলার সঙ্গে যুক্ত হবার পর, আমাদের দপ্তরে ঠিক হল বুদ্ধদেব গুহ'র ওপর একটা কাজ হবে। কবি রাহুল পুরকায়স্থ, বস কম, মেন্টর বেশি। রাহুল দার ফোন থেকেই কথা হল। ওপারে তিনি। সবে করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন। "কয়েকটা দিন যাক, তারপরে প্ল্যান করো"। আর হল না প্ল্যানটা। আজীবন লিখে এসেছেন মানুষ একলা বাঘের মত বাঁচবে। ভালবাসার প্রয়োজনে কাছে আসবে। জীবনকে সম্পূর্ণ অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শিখিয়েছেন যে শিক্ষক তাঁর নাম বুদ্ধদেব গুহ।
ভাবতে অবাক লাগে তাঁর অজস্র সৃষ্টি। বহু সৃষ্টি মারাত্মক সিনেম্যাটিক অথচ তাঁর জীবদ্দশায় কোনও প্রোডাকশন হাউজ এগিয়ে এল না তাঁর সাহিত্যকে সেলুলয়েডে রূপান্তরিত করতে। মাধুকরীর প্রেক্ষাপট বিশাল কিন্ত 'খেলা যখন', 'হলুদ বসন্ত' বা নিদেন পক্ষে ছোট গল্প 'টাটা' নিয়েও কি করা যেত না কোনও ছবি।
ছেলেবেলায়, নাদানির দিনে যখন পাড়ার লাইব্রেরীতে কার্ড করিয়ে নিয়মিত বই পড়তাম তখন আমরা একটা খেলা খেলতাম। মাধুকরীর কাস্টিং ডিরেক্টর হবার খেলা। আমাদের সেই সময়ে পৃথু ঘোষের চরিত্রে দুটি নাম আসত এক লেখক স্বয়ং আর দুই কমল হাসান, রুষা রুপা গাঙ্গুলি, কুর্চি শাবানা আজমি। সেই সব খেলার সময় আজ অতীত যেমন অতীত স্রষ্টা স্বয়ং। ভালো থাকুন অমৃতলোকে বুদ্ধদেব গুহ। এক অভয়ারণ্য সবুজ শ্রদ্ধা।
No comments:
Post a Comment