Monday, August 30, 2021

আমাকে বাঘা বোলো না !



তকাল দেরি করে বাড়ি ফিরেছি অফিস থেকে। বাইকটা তখনও থামে নি। ঘনঘন ফোন আসছিল। মোটর সাইকেল চালালে সাধারণত ফোন ধরি না। তাই বাড়ি পৌঁছে পকেট থেকে ফোনটা বার করলাম। দেখলাম গ্রামীণ হাওড়ার একজন নেচার অ্যাক্টিভিস্টের ৩টে মিসড কল। আমাকে না পেয়ে তিনি মেসেজ করেছেন, "ডোমজুড়ের করলায় বাঘের আতঙ্ক ছড়িয়েছে" মেসেজের নীচে একটা ভিডিও ক্লিপ। আবার তার নীচে আর একটা মেসেজ সহ ভিডিও "পাঁচলা বেলডুবিতেও আতঙ্ক ছড়িয়েছে"। আতঙ্ক মানুষজনের এমন অবস্থা তাঁরা ভয়ে পিটিয়েও মারতে পারেন প্রাণীটিকে। সেই অ্যাক্টিভিস্টকে ফোন করলাম। ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আমাদের রাজ্য প্রাণী ফিশিং ক্যাট (State Animal of West Bengal Fishing Cat )বা বাঘরোল। বন্ধুটিও সহমত। কিন্তু গ্রামবাসীদের বোঝায় কার সাধ্য! আগ বাড়িয়ে তাঁকে বললাম "আমাকে ওনাদের নম্বর দাও, কথা বলব"। আমার পাঁচ বছরের কন্যা সারাদিন পর বাবার দেখা পেয়ে তিড়িং বিড়িং করছে ফড়িং এর মত। তাকে বললাম, "মা একটা গুল্লু বাঘরোলকে দেখে সবাই বাঘ বলে ভয় পেয়েছে! ওঁদের সঙ্গে কথা বলে তোমার সঙ্গে খেলব। নইলে সোনাবাবাটাকে ওঁরা ভয় পেয়ে মেরে ফেলবে"। ও বলল, "কেন মারবে? ওরা তো ভাল"! 

সময় নষ্ট না করে প্রথম ফোন করলাম সমীর মল্লিককে। ওনার বাড়ির দাওয়ায় ঘুরেফিরে বেড়িয়েছে পূর্ণ বয়স্ক ফিশিং ক্যাট, রাতের অন্ধকারে। সিসিটিভি ক্যামেরায় পরিষ্কার ছবি এসেছে। উনি নিশ্চিত ওটা 'বাঘ' জাতীয় কিছু। মাথা ঠাণ্ডা রেখে বোঝাতে লাগলাম। ওই এলাকায় কোনও মতেই বাঘ আসতে পারে না। মাথার ভিতরে চলছিল -আজ থেকে ২০০ বছর আগে পার্ক স্ট্রিটেও বাঘ ডাকতো,আমরা এতই বুভুক্ষু যে সব খেয়ে ফেলেছি, উন্নয়ন আর নগরায়নের জোড়া চোয়াল দিয়ে চেবাতে চেবাতে এখন জিভটুকুই অবশিষ্ট পড়ে আছে। সমীর বাবুর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলে বাঘরোল নিয়ে করা আমার ভিডিও প্রতিবেদনের লিঙ্ক পাঠালাম। বললাম খেয়াল রাখুন প্রাণীটার। ওরা নিরীহ, মৎস্যভুক, লাজুক প্রকৃতির প্রাণী। সাধারণতঃ নিশাচর। উপায় না পেয়ে, বাসস্থান আর খাবারের সংকট দেখা দিলেই তবে লোকালয়ে আসে। ওটাকে মারবেন না। ও যে আমাদের রাজ্যপ্রাণী! পৃথিবীতে রোজ কমছে ওদের সংখ্যা। 

এরপর ফোনে ধরলাম আর এক আতঙ্কিত মানুষ লেনিন বসুকে। তাঁকেও বোঝালাম বললাম। তিনি আজও ফোন করেছিলেন। তাঁদের গ্রামে বন দপ্তর থেকে বন কর্মীরা এসে খাঁচা পেতে দিয়ে গেছেন। ওখানে গতকাল একটা পুকুর পাড়ে মাছের আশায় এসেছিল বাঘরোল। গ্রামের মানুষরা স্বস্তি পেয়েছেন। 
বাঘরোল সম্পর্কে ২টি কথা 

আইএউসিএন লাল তালিকায় সংরক্ষণের নিরিখে অতি সংবেদনশীল আমাদের রাজ্যপ্রাণী- বাঘরোল বা ফিশিং ক্যাট। ফেব্রুয়ারি মাস আন্তর্জাতিক ভাবে ফিশিং ক্যাট ফেব্রুয়ারি হিসাবে ঘোষিত হয়েছে। বাঘরোল, একমাত্র বৃহৎ মার্জার প্রাণী যা জলে ডুবে তার শিকার ধরে। বেড়াল জাতীয় প্রাণী সাধারণত জল এড়িয়ে চলে। অথচ এই বেড়ালের বেঁচে থাকার জন্য জলই হল অন্যতম শর্ত। এদের গায়ে লোমের দুটি পরত এবং অন্য বিড়ালদের তুলনায় দুটি চোখ কাছাকাছি হওয়ায় এদের শরীরের গঠনতন্ত্র আন্ডারওয়াটার হান্টিং এর জন্য অনুকূল। 

২ 
একদিকে উন্নয়ন, কৃষি আর নিবিড় মৎস্যচাষের জন্য রোজই ধ্বংস হচ্ছে প্রাকৃতিক জলাজমি। ফল স্বরূপ বাসস্থান আর খাদ্যের সংকটে পড়ছে বাঘরোল। প্রতি বছর ৩০% হারে হু হু করে কমছে ওদের সংখ্যা।  ওদের আবাসের ৯০% ই লোকালয় সংলগ্ন। আর অন্যদিকে ওদের সম্পর্কে নেই সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা। তাই ওদের বাঁচাতে গেলে মানুষের সাথে বাঘরোলের সহাবস্থান অত্যন্ত জরুরী।  পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া, হুগলি, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, আর উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে পাওয়া যায় ওদের। জলাভুমির বাস্তুতন্ত্রের শীর্ষ শিকারি। সে বাঁচলে তবেই ভারসাম্য রক্ষা হবে একটা বড়সড় ইকো সিস্টেমের।  তাই বাঘরোল সংরক্ষণের বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে স্থানীয় যারা নেচার অ্যাক্টিভিস্ট তাঁরা তাঁদের সীমিত সামর্থে যতাটা পারছেন অ্যাওয়ারনেস ক্যাম্পেইন চালাচ্ছেন। কিন্তু সরকারী দণ্ডমুণ্ডের কর্তা যাঁরা, মানে বন মন্ত্রকের তরফে সচেতনতা কোথায়? কোথায় হোর্ডিং-এ, ব্যানারে, কাগজে, টেলিভিশনে মানুষকে সচেতন করা অ্যাড ? যেসব জায়গায় বাঘরোলের বাসস্থান সেখানে কি  বন মন্ত্রক থেকে যথেষ্ট পরিমাণে সচেতনতা ছড়ানো হয়ে থাকে? মন্ত্রকের বরাদ্দ খাতের অর্থগুলো তাহলে ব্যবহৃত হয় কোন খাতে? এ প্রশ্নটা তো উঠবেই। স্থানীয় মানুষ বাঘ আর বাঘরোলের তফাৎ করতে পারছেন না মানে বন মন্ত্রকের তরফ এ কোনরকম উদ্যোগই নেই কি এলাকাগুলোয়? প্রশ্নটা তো উঠবেই। আর উত্তর কোনও কিছু আসবে না তাও জানা। তবুও প্রশ্নগুলো তোলা রইল। কেবলমাত্র ফিশিং ক্যাট ফেব্রুয়ারিতে পোস্টার ছাপিয়ে "সেভ ফিশিং ক্যাট" বললাম; আর বাকি সময়ে কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আর খুব কম সুবিধাপ্রাপ্ত বন বিভাগের কাঁধে দায় ঝেড়ে ফেলে দিলাম। এ কোন পথে হাঁটছে আমাদের রাজ্যের রাজ্যপ্রানীটির সংরক্ষণের চালচিত্র? কারণ সংরক্ষণ একটি লাগাতার প্রক্রিয়া আর তাতে হাল ছেড়ে দিলেই বিপদ! শুধু প্রাণীটিরই নয় মানুষেরও।  


বাঘরোল সম্পর্কে আরও জানতে ক্লিক করুন নীচের লিঙ্কে



No comments: