Monday, August 30, 2021

বাজা তোরা রাজা যায়




ত্তেজনায় হাত পা কাঁপছিল সূর্যদার কথা শুনে। সূর্যদা আজকালের দপ্তরের কাজ সেরে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের অফিসে আসতেন বিকেল বিকেল। ২০০২ এর সেই বিকেলে এসে স্বভাবসিদ্ধ বড় বড় শ্বাস আর হাঁপানি সহযোগে সূর্যদা বললেন "চল আজ লালাদার বাড়ি যাব"। লালাদা মানে বুদ্ধদেব গুহ'র সানি টাওয়ার্সের বসতবাড়িতে ঢুকে চোখ টেরিয়ে গিয়েছিল। ছাদ থেকে মেঝে অবধি কাচের দেওয়াল। সারা ঘর জুড়ে সাজানো সুদৃশ্য শো-পিস আর বই। শোবার ঘরের খাটে, বিছানার মাঝ বরাবর বইয়ের তাক। বিছানার মাথার দিকেও তাই। লেখার বিশাল একটা টেবিল, যার সামনে রাখা চেয়ারটা গদিতে মোড়ানো। সেই চেয়ারে উঠে বসতে গেলে সিঁড়ির মত দুটো ধাপ বেয়ে উঠতে হয়। তখন মোবাইল ফোন এলেও তাতে ক্যামেরা আসে নি। সেলফি তো দূর অস্ত। 

একটা উজ্জ্বল কমলা রঙা পাঞ্জাবি পরে বসে ছিলেন লালা মিঞা। বড় একটা ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন সূর্যদা। সঞ্জীব খান আর আমি ক্যামেরা ট্রাইপডে ফেলে গোগ্রাসে গল্প শুনেছিলাম বুগু'র মুখ থেকে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে যখন রাত বাড়ল সুগন্ধী দিয়ে ধোয়া ঘরটা থেকে বেরিয়েছিলাম আমরা। 'মাধুকরী', 'কোজাগর', 'কোয়েলের কাছে', 'রুআহা', 'সোপর্দ', 'চান ঘরের গান', 'ওয়াইকিকি' আর 'ঋজুদা'র স্রষ্টা তখন তাঁর আতিথেয়তার ষোলকলা সম্পাদন করেছেন। বেশ কয়েকটা এপিসোড ধরে "তারাদের বেড়ানো" দেখিয়েছিলাম আমরা।

তার অনেকদিন পর। বন বিভাগের একটা ভিডিওর কাজ করছিলাম। রাস্তার বুলেভার্ডে গাছ লাগাচ্ছিল বন দপ্তরের আরবান ফরেস্ট্রি বিভাগ। ওই বিভাগের মৈত্রেয়ি দি গুহ স্যার বলতে অজ্ঞান। সব শুট সেরে একটা দিন রাখলাম "গুহ স্যারের" জন্য। ওয়াটারলু স্ট্রীটের অফিসে সময় দিলেন তথাগত। বুদ্ধ মানে তো তথাগতই! একটা সবুজ রঙের পাঞ্জাবী পরে পান জবজবে মুখে পরিচিত হাসি মাখিয়ে বসে আছেন তিনি। আমাদের স্ক্রিপ্টে ওনার জন্য ছিল বাংলা টপ্পা, আর দুলাইন কনজারভেশনের বার্তা। গান শেষ হতে জলখাবার আর চা এল। তারপর পান। তখন পুজো আর কিছুদিন বাকি। বাইরে উজ্জ্বল বর্ষা শেষের আলো। আর পুরনো ফাইলের মধ্যে বসে তাঁর দ্যুতি ছড়াচ্ছিলেন বুদ্ধদেব গুহ।

ময়দানের ইস্টবেঙ্গল কর্তা কল্যাণ মজুমদার রাশভারী মানুষ। কিন্ত লালাদার প্রসঙ্গ উঠলে আবেগে, সম্ভ্রমে গলে জল প্রাক্তন বিমান কর্তা ও সাহিত্যিক কল্যাণ মজুমদার। বুদ্ধদেব গুহ'র স্ত্রী ঋতু গুহ যখন প্রয়াত হলেন প্রায়ই কথা হয়েছে কল্যাণবাবুর সঙ্গে। প্রসঙ্গ বুদ্ধদেব গুহ। ভাঙছিলেন একদা শিকারি পরবর্তী জীবনে সংরক্ষণকামী মানুষটা। তারই মধ্যে একবার দেখা হল ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের অনুষ্ঠানে। প্রণাম করতে গেলাম, প্রতিবারের মত বললেন, "প্রণাম করো না, প্রণম্য মানুষ আর একশৃঙ্গ গণ্ডার দুটিই বিরল"। হাসিমুখটা আজ বড্ড মনে পড়ছে।

শেষ কথা। টিভি নাইন বাংলার সঙ্গে যুক্ত হবার পর, আমাদের দপ্তরে ঠিক হল বুদ্ধদেব গুহ'র ওপর একটা কাজ হবে। কবি রাহুল পুরকায়স্থ, বস কম, মেন্টর বেশি। রাহুল দার ফোন থেকেই কথা হল। ওপারে তিনি। সবে করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন। "কয়েকটা দিন যাক, তারপরে প্ল্যান করো"। আর হল না প্ল্যানটা। আজীবন লিখে এসেছেন মানুষ একলা বাঘের মত বাঁচবে। ভালবাসার প্রয়োজনে কাছে আসবে। জীবনকে সম্পূর্ণ অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শিখিয়েছেন যে শিক্ষক তাঁর নাম বুদ্ধদেব গুহ।

ভাবতে অবাক লাগে তাঁর অজস্র সৃষ্টি। বহু সৃষ্টি মারাত্মক সিনেম্যাটিক অথচ তাঁর জীবদ্দশায় কোনও প্রোডাকশন হাউজ এগিয়ে এল না তাঁর সাহিত্যকে সেলুলয়েডে রূপান্তরিত করতে। মাধুকরীর প্রেক্ষাপট বিশাল কিন্ত 'খেলা যখন', 'হলুদ বসন্ত' বা নিদেন পক্ষে ছোট গল্প 'টাটা' নিয়েও কি করা যেত না কোনও ছবি।

ছেলেবেলায়, নাদানির দিনে যখন পাড়ার লাইব্রেরীতে কার্ড করিয়ে নিয়মিত বই পড়তাম তখন আমরা একটা খেলা খেলতাম। মাধুকরীর কাস্টিং ডিরেক্টর হবার খেলা। আমাদের সেই সময়ে পৃথু ঘোষের চরিত্রে দুটি নাম আসত এক লেখক স্বয়ং আর দুই কমল হাসান, রুষা  রুপা গাঙ্গুলি, কুর্চি শাবানা আজমি। সেই সব খেলার সময় আজ অতীত যেমন অতীত স্রষ্টা স্বয়ং। ভালো থাকুন অমৃতলোকে বুদ্ধদেব গুহ। এক অভয়ারণ্য সবুজ শ্রদ্ধা। 




আমাকে বাঘা বোলো না !



তকাল দেরি করে বাড়ি ফিরেছি অফিস থেকে। বাইকটা তখনও থামে নি। ঘনঘন ফোন আসছিল। মোটর সাইকেল চালালে সাধারণত ফোন ধরি না। তাই বাড়ি পৌঁছে পকেট থেকে ফোনটা বার করলাম। দেখলাম গ্রামীণ হাওড়ার একজন নেচার অ্যাক্টিভিস্টের ৩টে মিসড কল। আমাকে না পেয়ে তিনি মেসেজ করেছেন, "ডোমজুড়ের করলায় বাঘের আতঙ্ক ছড়িয়েছে" মেসেজের নীচে একটা ভিডিও ক্লিপ। আবার তার নীচে আর একটা মেসেজ সহ ভিডিও "পাঁচলা বেলডুবিতেও আতঙ্ক ছড়িয়েছে"। আতঙ্ক মানুষজনের এমন অবস্থা তাঁরা ভয়ে পিটিয়েও মারতে পারেন প্রাণীটিকে। সেই অ্যাক্টিভিস্টকে ফোন করলাম। ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আমাদের রাজ্য প্রাণী ফিশিং ক্যাট (State Animal of West Bengal Fishing Cat )বা বাঘরোল। বন্ধুটিও সহমত। কিন্তু গ্রামবাসীদের বোঝায় কার সাধ্য! আগ বাড়িয়ে তাঁকে বললাম "আমাকে ওনাদের নম্বর দাও, কথা বলব"। আমার পাঁচ বছরের কন্যা সারাদিন পর বাবার দেখা পেয়ে তিড়িং বিড়িং করছে ফড়িং এর মত। তাকে বললাম, "মা একটা গুল্লু বাঘরোলকে দেখে সবাই বাঘ বলে ভয় পেয়েছে! ওঁদের সঙ্গে কথা বলে তোমার সঙ্গে খেলব। নইলে সোনাবাবাটাকে ওঁরা ভয় পেয়ে মেরে ফেলবে"। ও বলল, "কেন মারবে? ওরা তো ভাল"! 

সময় নষ্ট না করে প্রথম ফোন করলাম সমীর মল্লিককে। ওনার বাড়ির দাওয়ায় ঘুরেফিরে বেড়িয়েছে পূর্ণ বয়স্ক ফিশিং ক্যাট, রাতের অন্ধকারে। সিসিটিভি ক্যামেরায় পরিষ্কার ছবি এসেছে। উনি নিশ্চিত ওটা 'বাঘ' জাতীয় কিছু। মাথা ঠাণ্ডা রেখে বোঝাতে লাগলাম। ওই এলাকায় কোনও মতেই বাঘ আসতে পারে না। মাথার ভিতরে চলছিল -আজ থেকে ২০০ বছর আগে পার্ক স্ট্রিটেও বাঘ ডাকতো,আমরা এতই বুভুক্ষু যে সব খেয়ে ফেলেছি, উন্নয়ন আর নগরায়নের জোড়া চোয়াল দিয়ে চেবাতে চেবাতে এখন জিভটুকুই অবশিষ্ট পড়ে আছে। সমীর বাবুর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলে বাঘরোল নিয়ে করা আমার ভিডিও প্রতিবেদনের লিঙ্ক পাঠালাম। বললাম খেয়াল রাখুন প্রাণীটার। ওরা নিরীহ, মৎস্যভুক, লাজুক প্রকৃতির প্রাণী। সাধারণতঃ নিশাচর। উপায় না পেয়ে, বাসস্থান আর খাবারের সংকট দেখা দিলেই তবে লোকালয়ে আসে। ওটাকে মারবেন না। ও যে আমাদের রাজ্যপ্রাণী! পৃথিবীতে রোজ কমছে ওদের সংখ্যা। 

এরপর ফোনে ধরলাম আর এক আতঙ্কিত মানুষ লেনিন বসুকে। তাঁকেও বোঝালাম বললাম। তিনি আজও ফোন করেছিলেন। তাঁদের গ্রামে বন দপ্তর থেকে বন কর্মীরা এসে খাঁচা পেতে দিয়ে গেছেন। ওখানে গতকাল একটা পুকুর পাড়ে মাছের আশায় এসেছিল বাঘরোল। গ্রামের মানুষরা স্বস্তি পেয়েছেন। 
বাঘরোল সম্পর্কে ২টি কথা 

আইএউসিএন লাল তালিকায় সংরক্ষণের নিরিখে অতি সংবেদনশীল আমাদের রাজ্যপ্রাণী- বাঘরোল বা ফিশিং ক্যাট। ফেব্রুয়ারি মাস আন্তর্জাতিক ভাবে ফিশিং ক্যাট ফেব্রুয়ারি হিসাবে ঘোষিত হয়েছে। বাঘরোল, একমাত্র বৃহৎ মার্জার প্রাণী যা জলে ডুবে তার শিকার ধরে। বেড়াল জাতীয় প্রাণী সাধারণত জল এড়িয়ে চলে। অথচ এই বেড়ালের বেঁচে থাকার জন্য জলই হল অন্যতম শর্ত। এদের গায়ে লোমের দুটি পরত এবং অন্য বিড়ালদের তুলনায় দুটি চোখ কাছাকাছি হওয়ায় এদের শরীরের গঠনতন্ত্র আন্ডারওয়াটার হান্টিং এর জন্য অনুকূল। 

২ 
একদিকে উন্নয়ন, কৃষি আর নিবিড় মৎস্যচাষের জন্য রোজই ধ্বংস হচ্ছে প্রাকৃতিক জলাজমি। ফল স্বরূপ বাসস্থান আর খাদ্যের সংকটে পড়ছে বাঘরোল। প্রতি বছর ৩০% হারে হু হু করে কমছে ওদের সংখ্যা।  ওদের আবাসের ৯০% ই লোকালয় সংলগ্ন। আর অন্যদিকে ওদের সম্পর্কে নেই সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা। তাই ওদের বাঁচাতে গেলে মানুষের সাথে বাঘরোলের সহাবস্থান অত্যন্ত জরুরী।  পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া, হুগলি, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, আর উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে পাওয়া যায় ওদের। জলাভুমির বাস্তুতন্ত্রের শীর্ষ শিকারি। সে বাঁচলে তবেই ভারসাম্য রক্ষা হবে একটা বড়সড় ইকো সিস্টেমের।  তাই বাঘরোল সংরক্ষণের বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে স্থানীয় যারা নেচার অ্যাক্টিভিস্ট তাঁরা তাঁদের সীমিত সামর্থে যতাটা পারছেন অ্যাওয়ারনেস ক্যাম্পেইন চালাচ্ছেন। কিন্তু সরকারী দণ্ডমুণ্ডের কর্তা যাঁরা, মানে বন মন্ত্রকের তরফে সচেতনতা কোথায়? কোথায় হোর্ডিং-এ, ব্যানারে, কাগজে, টেলিভিশনে মানুষকে সচেতন করা অ্যাড ? যেসব জায়গায় বাঘরোলের বাসস্থান সেখানে কি  বন মন্ত্রক থেকে যথেষ্ট পরিমাণে সচেতনতা ছড়ানো হয়ে থাকে? মন্ত্রকের বরাদ্দ খাতের অর্থগুলো তাহলে ব্যবহৃত হয় কোন খাতে? এ প্রশ্নটা তো উঠবেই। স্থানীয় মানুষ বাঘ আর বাঘরোলের তফাৎ করতে পারছেন না মানে বন মন্ত্রকের তরফ এ কোনরকম উদ্যোগই নেই কি এলাকাগুলোয়? প্রশ্নটা তো উঠবেই। আর উত্তর কোনও কিছু আসবে না তাও জানা। তবুও প্রশ্নগুলো তোলা রইল। কেবলমাত্র ফিশিং ক্যাট ফেব্রুয়ারিতে পোস্টার ছাপিয়ে "সেভ ফিশিং ক্যাট" বললাম; আর বাকি সময়ে কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আর খুব কম সুবিধাপ্রাপ্ত বন বিভাগের কাঁধে দায় ঝেড়ে ফেলে দিলাম। এ কোন পথে হাঁটছে আমাদের রাজ্যের রাজ্যপ্রানীটির সংরক্ষণের চালচিত্র? কারণ সংরক্ষণ একটি লাগাতার প্রক্রিয়া আর তাতে হাল ছেড়ে দিলেই বিপদ! শুধু প্রাণীটিরই নয় মানুষেরও।  


বাঘরোল সম্পর্কে আরও জানতে ক্লিক করুন নীচের লিঙ্কে



Sunday, August 15, 2021

অ্যান্থেমঃ শুনলেই কান্না পায়!

স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা। আজ বিভিন্ন জায়গায় বারেবারে বাজল যে গান অর্থাৎ জাতীয় সঙ্গীত বা ন্যাশানাল অ্যান্থেম। তাকে নিয়েই আজকের কথা। জাতীয় ফুটবল এবং রাগবি দলের বেশ কয়েকটা ম্যাচে সুযোগ হয়েছিল খেলোয়ারদের জাতীয় সংগীত গাওয়ার মুহূর্তটা পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে ক্যামেরাবন্দি করবার। সেই সময়ে এবং অন্য সময়ে গ্যালারিতে বসে জাতীয় সংগীত বা কোন অনুষ্ঠানের শেষে ওই গানটা শুনলেই কেন জানিনা দুটো চোখ জলে ভরে যেত, আজও যায়।
মুশকিলটা হল কাজের সময়ে। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি ভারত আর ইরানের ম্যাচ শুরু হবে তার আগে টিম লাইন আপ হয়েছে। এবার শুরু হবে রবি ঠাকুরের গান। পাবলিক অ্যানাউন্সমেন্ট সিস্টেমে ঘোষণা STAND UP FOR NATIONAL ANTHEM OF INDIA. নাক ফোঁসফোঁস আমার শুরু। বুক দুরু দুরু, কাঁধে থাকা ক্যামেরাটা না কেঁপে যায়! কমান্ড আসছে প্যানেল ডিরেক্টরের। ওই সময়ে আমার শট ছাড়াও আরও ৫টা ক্যামেরার শট সুইচ হয়ে একটা মালা গাঁথা হবে। টিম লাইন আপের একপ্রান্ত থেকে শুরু করে মোলায়েম পদক্ষেপে এক একজন খেলোয়াড়কে দেখিয়ে আমি যখন ক্যাপ্টেনের কাছে এসে থামব তখন অবশিষ্ট পড়ে থাকবে জাতীয় সঙ্গীতের "জয় জয় জয় জয় হে"। ব্যাস এটুকুই মাথায়। বুকে টলটলে কান্না। আর মনে আর কিচ্ছু নেই... ব্ল্যাঙ্ক।
আমার ডান চোখটা ঢাকত ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডার আর বাম চোখটা খোলা বন্ধ করবার কারণে কোনওদিন জল বেরোত না। তারপর দুইদলের করমর্দন আর টস। একটা অদ্ভুত ঘোর তৈরি হত ম্যাচ শুরুর ওই মুহুর্তে। এত বিচ্ছিরি একটা ভাল লাগা যে তা বারে বারে কাঁদাত। কিছুটা অ্যড্রিনালিন আর বাকিটাকে কী বলে জানি না, দেশপ্রেম কিনা। তবে ওই একটা কাজের জন্য খেলার ক্যামেরা ওয়ার্কে হ্যান্ডহেল্ড না ব্যাগিক্যাম আজও আমার সেরা পছন্দের পজ়িশন। 

অন্য দেশের জাতীয় সঙ্গীত এর ক্ষেত্রেও একই সমস্যা হত। যেমন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত।  কারণ হয়ত ওই একই। রবীন্দ্রনাথ। "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি" এই গানটার "অঘ্রানে তোর আমের বোলের ঘ্রাণে পাগল করে"কানে ঢুকলেই তারপর থেকে শুরু হতো আমার ভেতরে তোলপাড়। বাংলাদেশের ফুটবলারদের অনেকে সেটা লক্ষ্যও করেছেন।  যদিও বহিঃপ্রকাশ থাকত না আমার।  কিন্তু যখন "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসিইইইইই"  দিয়ে শেষের স্ট্র্যাঞ্জা শেষ হত চোখে কেন জানিনা একফোঁটা জল চলে আসতই। বারেবারে হয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় হয়েছে, বিভিন্ন মাঠে হয়েছে, কারণ জানা নেই। অথচ ওই সময় কী কঠিন ভাবে মনকে সামলাতাম আমি! 

প্রায় এক রকম হত FIFA অ্যান্থেমের প্রথম ৫ সেকেন্ড। ওই গান প্রায় ২০০০ বারের মত শুনেও আজও শুনলে একই রকম দুরুদুরু হয়। 

কোনওদিন একচুলও ভুলচুক হয় নি আমাদের কারও। এটাই স্পোর্টস ব্রডকাস্ট ক্যামেরা ক্রিউতে কাজ করবার একটা শিক্ষা। সিনিয়রদের দেখে একটা পরম্পরাকে ফলো করে বড় হওয়ার অভ্যাস। সারা গ্যালারি যখন অ্যান্থেমের আবহে আবেগে ভাসে। আমরা তখন কনসেনট্রসনের চূড়ান্ত শিখরে। তখন আমরা সেই আবেগের ঘোড়ার লাগাম শক্ত হাতে ধরে তাতে সওয়ার হয়ে ভেসে যাই, হাওয়ার মত, হাসির মত, কুসুমগন্ধরাশির মত। আর আমার মত কিছু নাদান, বাচ্চাকাচ্চা ওই সব দেখে কিছুটা ভয়ে কিছুটা সম্ভ্রমে আর ভাললাগায় কেঁদে ফেলে, এই আর কি। 

Sunday, August 1, 2021

চাইছি তোমার বন্ধুতা- প্রসঙ্গঃ বাংলা বেসরকারি টেলিভিশন

" ব্যাক টু ব্যাক দো টি২০ ম্যাচ, হ্যাণ্ড হেল্ড ক্যামেরা পজিশন। দাদা আপ সে হো পায়েগা না?" ফোনে বলেছিলেন রমেশ সিনহা। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে আমাকে বুক করবার সময়ে। টানা ৪০ দিন সেবার কেটেছিল ৩৬টা ক্যামেরা ইউনিটের মাঝে। ডিরেক্টর অস্ট্রেলীয় টিম ফিনলে (Tim Finley)। পকেটে তাঁর অনেকগুলো ওয়ার্ল্ড কাপ আর প্রায় সব কটা আইপিএল ডিরেক্ট করবার  অভিজ্ঞতা। ডিওপি সাউথ আফ্রিকার মরিস ফরি (Marius Fourie)। সঙ্গে ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা, কানাডা আর জার্মানির একঝাঁক অভিজ্ঞ ক্রু মেম্বার। "দাদা আপ সে হ পায়েগা"র দোলাচল ভুলে টুর্নামেন্টের ২য় ম্যাচে মানে প্রথম দিনেই ওয়েল ডান বলে গেলেন রমেশ স্যার। ঢাকা, চট্টগ্রাম , সিলেট টৈ টৈ করে কেটে যাওয়া ৪০টা দিন আজও জীবনের অন্যতম সেরা অ্যাসাইনমেন্ট হয়ে থাকবে। 


রোজ ভোর ৬টায় ঘুম থেকে উঠে সাতটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট সেরে ক্রু বাসের জন্য অপেক্ষা করা। আর সেই বাসটার দরজা খুলে গেলে প্রতিদিন বাসটায় ওঠার সময়ে রোমাঞ্চ জাগত। যেকোনও প্রফেসনাল ক্যামেরাম্যানের স্বপ্নে থাকে ওরকম একটা বাসে সওয়ার হওয়ার। বাসটা স্টেডিয়ামে থামলেই যে যার কাজে লেগে যাবে। স্ট্যাম্প ক্যাম আর হক আই প্রথমে সেট হবে তারপর স্পাইডার ক্যাম। তারপর ড্রোন। ততক্ষণে একটা কফি নিয়ে ম্যানড ক্যামেরার অপারেটরদের সঙ্গে একটা মিটিং করবেন টিম আর মরিস। সেটা মিটিং কম মজাই বেশি। টিম মানুষটা বেশ মজার। বিশেষ করে ওনার জন্যই ক্রিকেট ব্রডকাস্টের প্রাথমিক জড়তাটা কেটেছিল। বয়স ষাট পেরিয়েছে। প্রথম জীবনে ছিলেন ক্যামেরাম্যান। প্রথম মিটিংয়েই বলেছিলেন। পর পর দুটো ম্যাচ এই কথাটা মাথায় ঢুকিও না। হ্যাব ফান। এণ্ড এনজয় দ্যা গেম। আর আমদের উদ্দেশ্যে মানে আমি আর টিটু র উদ্দেশ্যে বলেছিলেন হ্যাণ্ড হেল্ড ক্যামেরা অকারনে কাঁধে রাখলে আমি মাঠে গিয়ে হাঁটু ভেঙে দিয়ে আসব। রিল্যাক্স করবে, যতটা সম্ভব। বিশ্বাস করুন সব জড়তা কেটে গিয়েছিল। মিটিংয়ের পর মাঠে যে যার পজিশনে চলে যাবে। শুরু হবে ফ্যাক্টস চেক। অডিও, সুপার স্লো মোশান , আলট্রা স্লো মোশান, অ্যাগুমেণ্টেড আর ভার্চুয়াল রিয়েলিটি গ্রাফিক্স। আর তার দু ঘণ্টা পর ম্যাচ শুরু। ২টো ম্যাচের শেষে শুরু হবে "ডি রিগ"। ক্যামেরা ডিসমেন্টাল করে বক্সে প্যাক করে প্রায় কয়েক কিলোমিটার কেবল গুটিয়ে তারপর সব জিনিসপত্র আসত স্টেডিয়ামের নির্দিষ্ট একটা জায়গায়। নিজেদের কাজ শেষ করবার পর কাজ শুরু হত আমাদের। আমি অয়ন সৌমেন দা আর মরিস। সব ইউনিট আর কেবল মার্কিং করে তা লিপিবদ্ধ করে তবে আমাদের ছুটি হত। 

সব সবসময়ে মাতিয়ে রাখত ড্যানি মরিসন

হোটেলে ফিরে ডিনার পেটে পড়লেই ঘুম আসত। ছুটির দিনে সকালটা কাটত টিভি দেখে। বেশিরভাগ "গান বাংলা"ই দেখতাম। ওদের কর্ণধার তাপস মাঠে আসতেন। দেখা হত রোজই। নিজেও দারুণ মিউজিশিয়ান। তাছাড়াও দেখতাম খবরের সব চ্যানেল গুলো। অদ্ভুত এক সহাবস্থান বাংলাদেশের নিউজ মিডিয়াগুলোর। আমাদের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের সম্প্রচার সত্ত্ব বাংলাদেশে ছিল মাছরাঙা টেলিভিশনের আর গ্লোবাল রাইট ছিল ডি স্পোর্টসের। ম্যাচের প্রতিদিনের হাইলাইটস যখন অন্য চ্যানেল দেখাত তখন তারা স্পস্ট লিখত "সৌজন্য মাছরাঙা টিভি"। আমাদের এই বাংলায় দুটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা বিরল। তাছাড়াও দেখতাম একটি চ্যানেলে অন্য চ্যানেলের অস্তিত্ব স্বীকার করবার রেওয়াজ। বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে যাবার ফলে একাধিকবার দেখেছি বৈশাখী টিভির জন্মদিনে একাত্তর টিভি ফুলের বোকে পাঠাচ্ছে এবং সেটা খবর হিসাবে প্রচারিত হচ্ছে! ভাবুন বিষয়টা।আর আমাদের এখানে পরিবেশটা এমন যেন এবিপি আনন্দ ভাবে ২৪ ঘন্টা মঙ্গল গ্রহের বাসিন্দা। ২৪ ঘণ্টা মনে করে কলকাতা টিভি এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিতে থাকে, কলকাতা টিভির কাছে দূর কোনও নক্ষত্রের বাসিন্দা টিভি ১৮। অন্তত চ্যানেল গুলো দেখলে যেন তাই মনে হয়। তখন হোটেলের একাঘরে বসে বসে বারবার মনে হত কেন এমন আমাদের বাংলায়, পশ্চিমবঙ্গে, হয় না। 

দুই বাংলাতেই মিডিয়াকর্মীরা প্রতিদিন একসাথে কর্মক্ষেত্রে থাকে।  ওপার বাংলায় ওরা একসাথে রবার বুলেট আর পেট্রল বোমা বা ককটেল বোমা একসাথেই খেয়েছে । আর এখানেও আমরা লাঠি, টিয়ার গ্যাস বা  স্প্রিন্টার একসাথেই খাই। বন্ধুতা না থাকলে সেটা হয়? এই কিছুদিন আগে ধাপায় গিয়েছিলাম একটা স্টোরি কভার করতে। ধাপার শ্মশান। ওখানে গিয়েই মনে পড়ল আজকালের ফটোগ্রাফার রনি দার কথা। রনি দার নশ্বর দেহটা ওই চুল্লি থেকেই ধোঁয়া হয়ে বাতাসে মিশে গিয়েছিল। বন্ধুত্ব না থাকলে সেটা হয়? শুধুই কি ব্র্যাণ্ডিং। খুব অল্প দিনের সাক্ষাত তবু আজও মিডিয়া সিটির ৩ নম্বর লিফটটায় উঠলেই মনে পড়ে অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখটা। বড় অল্প দিনের মেহেমানরা সব আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। 



আজ এই পয়লা আগস্ট সেই খেদ একটু হলেও মিটল একটা ছোট্ট ছবিতে। এই ছবিটা ঐতিহাসিক একটা দলিল হয়ে থাকল পশ্চিমবাংলার বেসরকারি মিডিয়া ইণ্ডাস্ট্রিতে। দেখুন ব্রেকিং, এক্সক্লুসিভ, সবার আগে খবর ধরানোর লড়াইটা তো থাকবেই। সুস্থ প্রতিযোগিতা উৎকর্ষতা আনেই। তা বলে বন্ধুতা রাখতে দোষ কোথায়? আর বন্ধুতা থাকলে সেই বন্ধুতা স্বীকার করতেও দোষ কোথায়? সেলিব্রেশনের দিন আজ। কি তাই না? তবে দুঃখ একটাই সেটা স্বীকার করতে এতটা দেরি হল। আর আনন্দ একটাই অবশেষে বন্ধুত্বের জয় হল।