Monday, February 19, 2018

নাথিং অ-ফিসিয়াল...




আমার এক পিসি ছিলেন। খুব ছোট বয়সে তাঁর বিয়ে হয় এক বিপত্নীকের সাথে। বিয়ের অল্প দিনের মধ্যে সামান্য ব্যবধানে হতে থাকে বাচ্ছাকাচ্ছা। তিন সন্তানের জননী বালিকা পিসি তাঁর পরিণত বয়সে আসার আগেই স্বামী হারা হন। অল্প বয়সে বিধবা নিজের জীবনের সব জৌলুস বিসর্জন দিয়ে সাদা থানের পরিধিতে সন্তানদের মানুষ করতে থাকেন। আমার স্মৃতিতে পিসির প্রথম মোলাকাত যখন  তখন তিনি প্রায় ৫০ ছুঁই ছুঁই। আমি বড় হতে লাগলাম পিসি বৃদ্ধা হতে লাগলেন। আমরা ভাইবোনরা কোন এক অদৃশ্য পারিবারিক বর্ণ বিপর্যয়ের উত্তারিধাকারে পিসিকে 'আপি' সম্বোধনে ডাকতাম। আপির যত বয়স বাড়তে লাগলো তাঁর হাঁটা চলা কথাবলা সব কিছুর মধ্যে অনাবিল এক হাস্যরস সঞ্চার হত আমাদের মনে। স্বল্প শিক্ষিতা, আবেগ সর্বস্ব, জীবনের ঘোরপ্যাঁচ না জানা, পূর্ণিমা অমাবস্যার ঘোরতর পালনে, এঁটো সকড়ি ক্লিষ্ট মমতাময়ী আপি যেন ছিলেন সবার পারিবারিক ক্রেস, উপোসের বাইবেল আর আমাদের কাছে ভুল শব্দের ডিকশনারী। যেমন ধরো বেসিন, আপি বলবেন ডেসিন। আবার তর্ক করবেন "তোরা হাসছিস ? তবে কী ওটা মেশিন না কী বেসিন"
এরকমই  চলত। অনেক শব্দ ভুলভাল রূপে হাজির হতো আমাদের শৈশবে। হিসি করতে যাওয়া আপির ডিকশনারী তে হয়ে যেত "ফাঁকে" যাওয়া। আমাদের চাপা হাসির রোল থামতো না।
যেমন মাছের আঁশ থাকে কিন্তু আপির ডিকশনারীতে মাংস ,ডিম , পেঁয়াজ ,রসুন সব্বার আঁশ ছিল।
আসলে বাঙালি বোধহয় এমনই। পাকস্থলীকে মাছ দিয়ে ভরিয়ে রাখে। শাক দিয়ে ঢেকে রাখে স্মৃতিজাল তবু সে স্মৃতির লতাপাতা ঠেলে প্রাণপণ বেরিয়ে আসে রুপোলি মেছো মন।

এই যেমন এখন আমার লতাপাতা চাপা স্মৃতিতে ভিড় করে আসছে ছেলেবেলার মফঃস্বল রেল শহরের ছোট মাছ বাজার। মাটিতে গোল করে বড় জোর ১০ কী ১৫ জন মাছ বিক্রেতা। বাবা ডিউটি তে গিয়ে প্রায়ই ২দিন কী ৩ দিন পর ফিরতেন। সাইকেল নিয়ে হাফ প্যান্ট আমি হাজির হতাম পালান কাকু ,লক্ষী পিসি বা বাতাসী পিসির সামনে মনমত মাছ বেছে ওজন করে নিলেই কাজ মিটে যেত। দর দাম মেটানোর পর্ব হত বাবা বাজার যাওয়ার দিনে। সে সব দিন এখন শীর্ষেন্দু র উপন্যাস এর মতোই অলীক।

এমনই অলীক কয়েকটা দিন কেটেছিল শ্রীনগরে। একটা জনপ্রিয় ভ্রমণ শো তে তখন কাজ করি। অমরনাথ যাত্রা শ্যুট করে লাদাখ যাব। ইন্টারলাইন পারমিট শুটিং এর অনুমতি আর পর্যটন দপ্তরের কিছু টুকটাক কাজ বাকি। অতএব প্রায় সপ্তাহ খানেক থাকতে হবে শ্রীনগরে। সকালে অফিসিয়াল কাজ সেরে গোটা দিন নিরবিচ্ছিন্ন বিশ্রাম। কাশ্মীর কি কলি র ডাল যতই মোহময়ী হোক না কেন আমার কাছে তখন ভাসমান হাউজ বোটের নিঃসঙ্গতা নিরস দিন বিরস করে দিচ্ছিল। হাউজ বোটের এক কেয়ারটেকার একটা ছিপ হাতে ধরিয়ে পরামর্শ দিলেন মাছ ধরার । লেগে পড়লাম। সারা দুপুর চার আর ছিপ সম্বল করে ভাগ্য অন্বেষণ। প্রথম প্রথম কিছুই এল না। ঝাঁঝি, পানা, পাতাকে মাছ ভাবলাম। তারপর ফাতনা নড়ল ছিপে টান লাগল ছোট ছোট মাছ আসতে লাগল। সামনে শালিমার বাগ নিসাদবাগ, চারচিনার।  ডাল লেকের পটভূমিতে উড়ে যাচ্ছে কত মাছরাঙা,  ভেসে যাচ্ছে রঙিন শিকার। শিকারীর চোখ নিয়ে একা আমি সে সব দৃশ্যকল্প থেকে দূরে একা ধনঞ্জয়ের মত মাছের ধ্যান।
পদ্মার ইলিশ ডিলিশিয়াস শুনেছিলাম। প্রথম চোখে এবং চেখে দেখলাম চিটাগাং ক্লাবে। বাংলাদেশ ক্রিকেটবোর্ড বিদেশী সাংবাদিকদের অভ্যর্থনায় একটা পার্টি থ্রো করেছিল ভারত বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কা ট্রাইনেশন কাপের সময় ২০১১ সালে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে শচীন তেন্ডুলকরের টেস্ট সেঞ্চুরি দেখা, ৫ ফুটের ভিতর দাঁড়িয়ে মাস্টারব্লাস্টারের নেটে নকিং দেখা যদি লাইফটাইম এক্সপিরিয়েন্স হয় তাহলে ওরিজিনাল পদ্মার ইলিশ খাওয়া আর একটা লাইফটাইম এক্সপিরিয়েন্স এর সমাপতন। সে ইলিশ ভাজা আর বিরিয়ানির স্বাদ শব্দে বর্ণনার অতীত।
ইলিশ নিয়ে বিস্তর আদিখ্যেতায় যে সব মোহনবাগানী এতক্ষণে ভ্রু কোঁচকাচ্ছেন তাঁদের জন্য এবার একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। সালটা ২০০৬ সুন্দরবনের ডাকাতদের নিয়ে একটা তথ্যচিত্র র শ্যুটিং করছি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বনবিভাগের সহযোগিতা য় শ্যুট চলছিল খাঁড়ি আর জঙ্গলের গভীরে। সাথে সাথে বিশাল ম্যানগ্রোভ অরণ্যের মাঝে মাঝে জেগে থাকা জনজীবনের হালহকিকত দেখছিলাম আমরা। সুধন্যখালির পথে যেতে এরকমই এক গ্রামে খেয়েছিলাম এ গ্রেড কাঁকড়া আর দারুণ চিংড়ি। সুন্দরবন এ আধা নোনা জলের চিংড়ির স্বাদ ভেড়ির চিংড়ির থেকে অনেকটাই আলাদা। আকারে বড় বিশেষ নয় কিন্তু স্বাদে অতুলনীয়।  গোয়ার সমুদ্র সৈকতে বিভিন্ন স্যাকে অবশ্য ওজনে বড় চিংড়ি বা 'লবস্টার' পাওয়া যায়। খাওয়ার আগে সেগুলোর ছবি তুলে হাঁটু জলে পা ডুবিয়ে নৈশাহারে চরম তৃপ্তি, পরম সুখ।

আর আমাদের  তাজপুর, মন্দারমণি, শঙ্করপুর বা দীঘা তো মেছো বাঙালির অভয়ারণ্য। যাঁরা এই অঞ্চলে  গেছেন পারলে একবার শঙ্করপুর মৎস্য বন্দর বা দীঘা মোহনার মাছ বাজার ঘুরে আসতে পারেন। তাজা সামুদ্রিক মাছের এত ভাল বাজার সকাল সকাল ফুরফুরে করে দেবে প্রাণমন।  যেমন পারেন বর্ষাকালে  শিয়ালদহ থেকে ডায়মন্ড হারবার লোকালে চেপে বসতে। ইলিশের মরসুমে স্টেশন থেকে ভ্যান রিকশা  নিয়ে যান মাছের আডৎ। দেখবেন সার সার ট্রলার থেকে কুইন্টাল কুইন্টাল ইলিশ এসে স্তুপাকারে জমা হচ্ছে। বিশাল বিশাল দাঁড়ি পাল্লায় বেলচা করে তোলা হচ্ছে সাধের ইলিশ । আমার ভেতো বাঙালি মনে কালচারাল শক লেগেছিল । বেলচা বাহিত ইলিশের করুন দৃশ্যকল্প অতি বড় মোহনবাগানী ও সইতে পারবেন না। নিলামের দরদাম হাঁকডাক, কলরব, কোলাহল কাটিয়ে বাড়ি ফেরার পরও নাকে ভাসবে ইলিশের মোহময় সুগন্ধ।

মাছের গন্ধে গদগদ বাঙালি। কিন্তু সেই গন্ধই কখনও কখনও প্রাণ ঘাতিকা হয়ে যায়। না আমি শুঁটকির মৎস্যগন্ধা থেকে সুস্বাদু যোজনগন্ধা হয়ে ওঠার গল্প বলছি না। আমি ফিস সসের কথা বলছি। সময়টা ২০১১ সালের দুর্গাপুজোর সময়। ভিয়েতনাম যাচ্ছি ১০-১২ ঘন্টার বিমান যাত্রা আর তারপর ঘন্টা তিনেক গাড়িতে আসার পর রাত ২টো নাগাদ হোটেল পৌঁছলাম। খিদেয় পেট চুঁইচুঁই। রুম সার্ভিস শেষ অর্ডার দিয়ে গেল, নুডুলস । টেবলে সল্ট, পেপার, চিলি, টোমাটো সসের সাথে ছোট্ট কাচের বোতলে ফিস সস। আমার সহকর্মী সাংবাদিক খিদের চোটে সব সসের সাথে ফিস সসও ঢেলে নিল নুডুলস এ। প্রথম গ্রাস মুখে তোলার পর তার মুখের মানচিত্র গেল বদলে। দ্বিতীয় গ্রাস মুখে উঠতেই তার গা গুলিয়ে বমি উঠে এল। তারপর সারা ভিয়েতনাম সফর মুর্তিমান ত্রাসের মত হয়ে রইল ফিস সস। দু দেশের কত মিল মাছে ভাতে মিল, জাতীয় ফুলের পদ্মে মিল, ফুটবল প্রেমে মিল। শুধু ফিস সসের দুশমনীর জন্যই "তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম" হল না।

পূর্বের থেকে পশ্চিমে গেলেও আমার সঙ্গে আঁশের মত এঁটে রইল মাছ। ডেনমার্কের হিরৎস্যালস বন্দরের কাছেই পৃথিবীর ২য় বৃহত্তম সামুদ্রিক মাছের অ্যাকোরিয়াম। আর তার পরের স্টেশনেই অগুনতি ফিস ক্যাফে আর ফিস বুটিক। ঢুঁ মারতেই ট্রাউট, টুনা, সার্কের অসাধারণ সব ডিশ আর তার সাথে প্রণ, লোবস্টার। ফিলে করা কাঁচা মাছের হিমশীতল শোকেস রয়েছে তারপাশেই। একটু এগিয়ে গেলেই সার সার বিলাস বহুল ইয়াচ তাদের সেরা গেমের ছবি সাজিয়ে নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে অ্যাঙ্গলিং টুরিস্ট দের অপেক্ষায়। পকেটের কিছু ক্রোণ খরচ করলেই নর্ন সি বা আটলান্টিকের গভীরে নিয়ে গিয়ে মাছ ধরা দেখিয়ে সেই মাছ সহযোগে ভরপেট পেটপুজো করিয়ে তীরে ফেরত।















লেখাটা লিখছি মণিপুরের ইম্ফল থেকে। ফুটবল ম্যাচের সরাসরি সম্প্রচারের কাজে এসেছি। গত মাসেও এসেছিলাম। তখন ২৬শে জানুয়ারি। বনধ চলছে। কোথাও একটাও জাতীয় পতাকা উড়তে দেখা যাচ্ছে না। ফাঁকা বাজারের একপাশে শুধু একটা দোকান খোলা। খবরের কাগজে শুকনো কিছু ভাজা মাছ (স্থানীয় ভাষায় 'নারি' ) সাজিয়ে বসে আছেন এক মহিলা। কোনও ক্রেতা কোত্থাও নেই। শুধু মিলিটারির অ্যান্টি এক্সপ্লোসিভ সাঁজোয়া গাড়ি আর ভারী বুটের শব্দ। মনে হল খবরের কাগজের ওপর এই মৎস্য অবতারই আজকের হেডলাইন।

If you like it comment below in the comment box and follow
Me in facebook , twitter & youtube




প্যারালাল মিডিয়া এ প্রকাশিত 


No comments: