Nandan Paul নন্দন পাল
LIFE is a mix bag of experiences
Wednesday, August 21, 2024
মশাও পৃথিবীর মঙ্গলের কাজে লাগে
Tuesday, August 6, 2024
পরিচারিকা থেকে কলকাতার 'রাতের রাণী- মিস শেফালি' হয়ে ওঠার অবিশ্বাস্য কাহিনী
রাতের কলকাতা। এক রহস্যময়, আলো আঁধারে ঘেরা। আজ আপনাদের সামনে অতীত কলকাতার প্রথম ক্যাবারে কুইনের গল্প। অনেক প্রশ্ন আর রহস্যের মাঝে শেষ রাতের শিউলি ফুলের মতো ফুটে ছিলেন সেই নিশি সম্রাজ্ঞী। আজ মিস শেফালির গল্প।
তখনও দেশভাগ হয়নি। বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে কলকাতার আহিরিটোলায় এসেছিলেন দাস পরিবার। সেই পরিবারের তৃতীয় সন্তান একটি মেয়ে। নাম আরতি দাস। বাবা অসুস্থ। কাজ করতে পারেন না। এদেশে আসবার সময়ে সামান্য যা কিছু সঞ্চয় ছিল তাও নিঃশেষিত হয়েছে। পরিবারের মুখে অন্নের যোগান তুলে দিতে আরতির মা গার্হস্থ সহায়কের কাজ নিলেন। বাড়িতে অনেকগুলো মুখ। রোজগার নিতান্তই কম! তাই কিশোরী আরতি বাধ্য হয়ে এক রকম জোর করেই চৌরঙ্গীর এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারে কাজের মেয়ে হিসাবে নিযুক্ত হল। আর সেখান থেকেই মোড় ঘুরে গেল আরতির। আরতি থেকে মিস শেফালি। কলকাতার প্রথম ক্যাবারে কুইন হয়ে ওঠার সেই উপাখ্যান আজ।
মিস শেফালি একবার একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক অনির্বাণ চৌধুরীকে তাঁর উত্থানের গল্প বলেছিলেন। কী বলেছিলেন সেদিন ক্যাবারে কুইন?
মিস শেফালি তাঁর জীবদ্দশায় সেই সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন-
'অনেক নদী, নালা, কাদা পেরিয়ে হিমালয় দেখেছি। বাবার কষ্ট, ভাইয়ের কান্না, দেখেছি। ১০ সাড়ে দশ বছর বয়সে আহিরিটোলার বানী নামের এক মহিলাকে জোরাজুরি করতাম কাজ দাও কাজ দাও। সে একটা কাজ দিল। মায়ের অনুমতি নিয়ে বাণী আমাকে এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বাড়িতে নিয়ে যায়। প্লেট ধোয়ার কাজ। সেখানে রোজ বিকেলে খানাপিনা ও নাচের আসর বসত।'
দেখে দেখে সেই নাচের ঘোর লেগে যায় আরতির চোখে আরতির মনে। লুকিয়ে লুকিয়ে সে সব নাচ তুলতে থাকেন আরতি। তখন সে নিতান্তই বালিকা। ওই আসরে গান গাইতে আসতেন ভিভিয়েন হ্যানসাম। তখনকার কলকাতার পানশালার ডাকসাইটে গায়ক। আরতি ভিভিয়েনকে ধরেন একটা কোনও কাজের জন্য। ভিভিয়েন প্রশ্ন করেন নাচতে পার? আরতি তাঁর গোপনে দেখে নকল করা নাচ দেখান। পানশালায় নর্তকীর কাজ জুটিয়ে দেন ভিভিয়েন।
ভিভিয়েন আরতিকে প্রথমে নিয়ে যান গ্র্যান্ড হোটেলে। তারপর গ্র্যান্ড থেকে বার করে ভিভিয়েন আরতিকে নিয়ে যান ফিরপোজে। আরতির নাচ পছন্দ হয় ফিরপোজের ম্যানেজারের। কিন্তু ম্যানেজার বলেন এই নাম চলবে না। ভিভিয়েন বলেন আজ থেকে তোমার নাম আরতি দাস নয় । আজ থেকে তোমার নাম শেফালি। তোমার বেতন ৭০০ টাকা। আরতি জিজ্ঞেস করেন 'আবার বলুন কত বেতন!' নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না উদ্বাস্তু পরিবারের সেই অভাবী মেয়েটা।
তবে প্রথম দিনের পরিধেয় পোশাক দেখে কেঁদে ফেলেন সদ্য আরতি থেকে মিস শেফালী হওয়া সেই কিশোরী। সেই পোশাকে যে শরীরের অনেকটাই হয়ে পড়ছিল উন্মুক্ত। বেআব্রু। তবে বল রুমে প্রথম নাচের আসরেই মাতিয়ে দেন তিনি। প্রশংসা আর হাততালিতে ফেটে পড়ে নিশি আসর।
ফিরপোজও যেন চাইছিল ক্যাবারের নতুন রানীকে গড়ে পিঠে তৈরি করে নিতে। তারাই আরতিকে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় কথাবলা শেখায়। নাচের বিভিন্ন রকমের তালিম দেয়। সেই সময়কার পার্ক স্ট্রীট অন্যরকম। ব্রিটিশরা তখনও শহরে। আরতি সেই সাক্ষাৎকারেই বলেন "লুকিয়ে চুরিয়ে স্ট্রিপটিজ হতো পার্ক স্ট্রিটের পানশালা আর নিশিনিলয়গুলিতে"। যদিও তাঁর কাছে এমন প্রস্তাব কখনও আসেনি। তখন তিনি খ্যাতির শিখরে উঠছেন। তাঁর এক ঝলক পেতে শহরের সন্ধ্যাগুলো উদ্বেল। 'তোমাকে ভালবাসি , তোমাকে ছাড়া বাঁচব না, তোমাকে বিয়ে করতে চাই'। এমন প্রস্তাব আসত অহরহ। তিনি জানতেন এসব যৌবনের ঘোর। এ ঘোর চিরস্থায়ী নয়। তাই ওসব খুব একটা পাত্তা দিতেন না।
সেই সময়ে কিছুদিন ধরে কেউ একটা ফোন করছিল। শেফালি ভেবেছিলেন তাঁর বহু অনুরাগীর মধ্যে কেউ বুঝি ফোন করছেন। শেষমেশ বাধ্য হয়েই একদিন ফোন ধরলেন শেফালি। ফোনটা ধরতে ফোনের ওপার থেকে শোনা গেল, "তুমি হয়ত আমার নাম শুনলেও শুনতে পার আমি সত্যজিৎ রায় বলছি। আমার তোমাকে চাই"। ২০ সার্কাস অ্যাভেনিউ থেকে গেলেন বিশপ লেফ্রয় রোড। সত্যজিৎ বলেছিলেন তোমার ব্লাউজ খুলতে অসুবিধে আছে? তুমি কি সিগারেট খাও? এক সাক্ষাৎকারে শেফালি শোনান প্রতিদ্বন্দ্বী ছবির শুটের সেই অভিজ্ঞতা-
"আমি তো আগে কখনও করিনি। ডায়লগ বলতে গেছি। অমনি শুনলাম 'কাট'। স্ক্রিপ্টটা ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। আমি তো ভয় পেয়ে গেছি। সত্যজিৎ তখন বলেন তোমার স্ক্রিপ্ট আমি এখানেই করে নেব"।
বাঙালির ম্যাটিনি আইডল উত্তম কুমারকেও নাচিয়ে ছেড়েছিলেন মিস শেফালি। একবার উত্তম কুমার তাঁর নাচ দেখতে এসেছিলেন। এপ্রসঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে মিস শেফালি বলেন। 'সুযোগ পেলাম। উত্তম কুমারের সঙ্গে নাচার সুযোগ। মনে মনে বললাম তুমি উত্তম কুমার, আমিও মিস শেফালি। তোমাকে আমি আজ নাচাচ্ছি।' উত্তমকুমারকে দাদার মতো ভালবাসতেন মিস শেফালি। সুচিত্রা সেনের অভিনয়ের দারুণ ভক্ত ছিলেন কলকাতার ক্যাবারে কুইন। সুচিত্রা মিস শেফালির নাটক 'সম্রাট সুন্দরী' দেখতে আসেন একবার।
আজীবন মুম্বইয়ের হেলেনকে নিজের গুরু মানতেন। একলব্য যেমন গুরু দ্রোণকে গুরু মানতেন তেমনি। তাই হেলেনের সঙ্গে শো করতে চাননি কখনও।
কখনও সখনও মনে হয়েছে মিস থেকে মিসেস হয়ে যেতে। কিন্তু সেই মনে হওয়া সেই ইচ্ছেকে কখনও আমল দেননি। কারন তিনি জানতেন আজ যে পুরুষ তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে সে একদিন ছেড়ে চলে যাবেই। বরং তিনি শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছেন আরতি দাসের হাতটাই। যে আজীবন তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ছায়া হয়ে থেকেছিল।
কোনোদিন শিল্পীর সম্মান জোটেনি মিস শেফালিদের। মুখ থেকে লাইমলাইট থেকে সরে যাওয়ার পর আর পাঁচটা সাদামাটা
মহিলার মতো জীবন কাটাতেন। হতাশ আরতি দাস মনে করতেন, ক্যাবারে ডান্সারদের শিল্পসত্ত্বা নিয়ে কেউ কোনও দিন কথা বলেননি। কাজ না থাকায় শেষ জীবনে আর্থিক সমস্যারও সম্মুখীন হয়েছেন । অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার জন্যেও অর্থাভাব হয়। দীর্ঘদিন কিডনির অসুখে ভুগে। অবশেষে ২০২০সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মিস শেফালি পাড়ি দেন তারাদের দেশে। তাঁর আত্মজীবনী 'সন্ধ্যা রাতের শেফালি’ পাঠক মহলে যথেষ্ট সাড়া ফেলে। এই পার্ক স্ট্রিট থেকে উত্থান আর এক সিঙ্গারের। তিনি পদ্মভূষণ প্রাপক ঊষা উত্থুপ। অথচ আরতি দাস ওরফে মিস শেফালিরা থেকে যান ক্যাবারে কুইনের মতো এক প্রশ্ন সূচক তকমা নিয়েই। আপনাদের কী মত এই প্রসঙ্গে? কমেন্টে জানান। আর এই বিষয়ের ওপরে আমার তৈরি একটি ভিডিও দেখুন নিচের লিঙ্কে ক্লিক করে।
Thursday, June 20, 2024
চোলাই মদ খেয়ে মরলে ২লাখ! আর চোলাই থেকে বাঁচালে?
সাধারণত মোটরবাইক চালালে আমি ফোন ধরি না। কিন্তু সেদিন ১৪টা ফোন ধরেছি। সেক্টর ফাইভ থেকে বাড়ি আসার মধ্যে। অবশ্যই বাইক দাঁড় করিয়ে। একটা সর্বভারতীয় চ্যানেলের চাকরি ছাড়ার কথাটা সদ্য জানিয়ে পোস্ট করেছিলাম ফেসবুকে। একের পর এক ফোন, মেসেজ, হোয়াটসঅ্যাপ। ওই সময়ে মা আর স্ত্রীর খুব সাপোর্ট পেয়েছিলাম। বন্ধুরা অনেকেই বলেছিল যা হবে ভালই হবে। বাবা বলেছিলেন, "এরপর করবি কী?"
কোয়েল , ওয়ান্ডার ওয়ার্ল্ড বাংলা নামে একটা ইউটিউব চ্যানেল আর তার ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রাম পেজ তৈরি করেছিল। শুরু করলাম সেখানেই। স্বাধীন সাংবাদিকতা।
কেন প্রথম স্টোরি কল্যাণী পালুই?
কল্যাণীদির সঙ্গে অনেকদিনের আলাপ। ফোনে। বেশ কয়েকবার যাব যাব করেও যাওয়া হয়নি ওনার কাছে। ভাবলাম ওনার আর ওনার মেয়েদের ওপরেই তৈরি করি প্রথম ভিডিওটা। চোলাই মদের বিষক্রিয়ায় বাংলার বিভিন্ন জেলায় এখনও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। মিডিয়ায় সব খবর আসে না। এটা জানি। বেশ জোর দিয়েই বলতে পারি। কারন মিডিয়ার অনেক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাঁরা পচা সুপারির তৈরি গুটখাকে পান মশলা বলে খবরের মাঝে মাঝে গেলাবেন। সেই সংবাদ মাধ্যম বা তাঁদের ইন্টারনেট পেজ যে অনেক শিশু, যুবক দেখে ওই বিষাক্ত পচা সুপারিকে ফ্যান্টাসাইজ করে মারাত্মক মুখের রোগের সম্মুখীন হবে এ সব খেয়াল তাঁরা রাখবেন না এটাই স্বাভাবিক। ইনকাম বড় বালাই। টার্গেট বালাই ৬০।
এই অবস্থায় কল্যাণী দির মতো মানুষদের প্রচার আরও বেশি করে করা দরকার। অন্তত তাতে আমার ৭বছরের সন্তানের কাছে আমি মাথাটা উঁচু করে থাকতে পারব! টাকা পয়সা প্রয়োজন কিন্তু মগজ, শিরদাঁড়া? অনেকেই 'শিরদাঁড়া বিক্রি নেই' ক্যাপশন লেখা টিশার্ট পরেন। তাঁদের অনেককেই চিনি। কী পরিমাণে বিকৃত মগজ ও বিক্রিত শিরদাঁড়া সেসব শরীরে! যাই হোক সেকথা লেখা যাবে অন্য কোনও ব্লগে! এখানে কল্যাণী পালুইয়ের গল্প।
কল্যাণী পালুই সমাজসেবী। কাজ শুরু করেছেন ২০০৪ থেকে। শেষ ২০ বছর ধরে দুহাতে সামলাচ্ছেন দুটি বড় কাজ। তাঁর ছোট্ট অফিস গ্রামীণ হাওড়ার তুলসিবেড়িয়ায়।
১ বাল্যবিবাহ রোধে স্কুল, কলেজে, গ্রাম-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে নাবালিকাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। সেই সচেতনতা আজ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে এক ক্লাস নাইনের মেয়ে তার বিয়ের কথা শুনে যোগাযোগ করে তুলসিবেড়িয়ার কল্যাণীদির মেয়েদের সঙ্গে। তাঁরা পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে সেই মেয়ের বিয়ে বানচাল করে দেয়। নবম শ্রেণির সেই মেয়ে এখন বি,এড করছেন। আবার লুকিয়ে চুরিয়ে নাবালিকার বিয়ে দিলেও তার প্রতিকার করতে ছুটে যান কল্যাণী।
বাংলার গ্রামে গ্রামে সচেতনতার অভাবে আজও বহু নাবালিকার বিয়ে হয়। অনেক নাবালিকাকেই পাচার করে দেওয়া হয়। গল্প গুলো বলছিলেন কল্যাণী। তিনি হাওড়া স্টেশন থেকে এমনই ৬জন মেয়েকে উদ্ধার করেন একবার। কল্যাণীর কর্মকাণ্ডের আর একটি দিক-
২ বেআইনি চোলাই মদের ঠেকে চড়াও হয়ে মদ কেনাবেচার সঙ্গে যুক্তদের আটক। তারপর পুলিশ ও আবগারি দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করে দোষীদের ধরিয়ে দেওয়া। আর বাজেয়াপ্ত মদ আবগারি দফতরের হাতে তুলে দেওয়া। কখনও সখনও ভাঙচুর। আগুন লাগিয়ে মদের ঠেক পুড়িয়ে, জ্বালিয়ে দেওয়া। লাল পাড় সাদা শাড়ি, হাতে শাঁখা পলা। গ্রামের সাধারণ ঘরোয়া মহিলারাই অবৈধ মদের আসর দেখলে রণং দেহি হয়ে ওঠেন। তখন চুলোয় যাক কাজ, তা সে যত গুরুত্বপূর্ণই হোক না কেন!
ওঁরা নিতান্ত দ্ররিদ্র পরিবারের মহিলা। বাড়িতে বাবা, ভাই আর স্বামীদের মাতলামি দেখে অতিষ্ঠ। অনেকে প্রিয়জনদের মারা যেতেও দেখেছেন বিষমদের বিষক্রিয়ায়।দেওয়ালে ঠেকেছে ওঁদের পিঠ। তাই ওঁরা আজ ঘুরে পাল্টা মারটা দিচ্ছেন। আপনারা দেখবেন এই ব্লগের সঙ্গে দেওয়া ভিডিও A Hooch Story Of Howrah চোলাই ও বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে লড়াই Wonder World Bangla তে মেয়েরা বলছেন এই কাজে তাঁরা মারা গেলেও কোনও আক্ষেপ নেই।
আর এই কাজের কাণ্ডারি কল্যাণী তাঁকেও হুমকি দেওয়া হয়েছে বহুবার। গলায় ছুরি ধরে চমকানো হয়েছে। তবু তিনি দমে যাননি। বাংলার বিভিন্ন জেলায় আর ওড়িশায় ছুটে গেছেন বিষ মদ চোরাই চোলাইয়ের বিরুদ্ধে এক অসম যুদ্ধে।
এখনও এই লোকসভা নির্বাচনের আগে ফোন এসেছে ওঁদের কাছে- কদিন ধর পাকড়টা যদি একটু বন্ধ রাখেন। তাও ম্রিয়মান হননি ওঁরা। বাধা যত এসেছে বুঝেছেন ঠিক পথেই রয়েছেন। যে পথে কষ্ট থাকলেও শান্তি আছে অনেকটা। সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে নিজেকে বিকিয়ে দেওয়া নেই। বরং বিলিয়ে দেওয়া আছে। ওঁদের পোশাকে আঁকতে হয় না 'শিরদাঁড়া বিক্রি নেই!'
আজ আপনাদের পরিচয় করাব সাধারণের মধ্যে মিশে থাকা এই অসাধারণ মহিলা আর তাঁর দলকে। পরিচয় করাব কল্যাণী পালুইকে।
দেখুন ভিডিও ওপরে ক্লিক করে। আর অবশ্যই কমেন্ট করে জানান কেমন লাগল এই ভিডিওটা।
Friday, April 19, 2024
সম্পর্কের উত্তাপ বাড়িয়ে রাখুন
Sunday, March 3, 2024
ছোট বুনো বিড়ালদের নিয়ে 'চিতা প্রজেক্ট' এর ৭ বিজ্ঞানীর গবেষণায় উঠে এল বাংলার রাজ্য প্রাণী সংরক্ষণের গুরুত্ব
আজ বিশ্ব বন্যপ্রাণ দিবস। গতকাল কথনের ফোন এল। কথন বন্দ্যোপাধ্যায়, আমার প্রাক্তন সহকর্মী উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুযোগ্য পুত্র। কুনো অভয়ারণ্যে থাকে ও। প্রাণী বিজ্ঞানী। ওর সঙ্গে কথা বলার পরই ভাবলাম এই ব্লগটা লেখা দরকার।
"ভারতের বাস্তুতন্ত্রে ছোট বিড়াল প্রজাতির প্রাণীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি বাস্তুতন্ত্রে এরা শিকারের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে। আর এর ফলে পুষ্টির স্থানান্তর সহজ হয় আর গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থলগুলি সুরক্ষিত রাখে। এই সব 'স্মল ক্যাট'দের পরিবেশগত তাৎপর্য গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, এই প্রজাতিগুলি সংরক্ষণের নিরিখে খুবই কম মনোযোগ পায়। বৃহত্তর মাংসাশী বাঘ, সিংহ, লেপার্ড বা চিতার ওপর ফোকাস অনেকটাই বেশি। তাদের পাশাপাশি এদের অবস্থা সম্পূর্ণ এবং তীব্রভাবে বিপরীত।"
কথাগুলো বলছেন সাতজন প্রাণী বিজ্ঞানী। মধ্যপ্রদেশের কুনো পালপুর চিতা প্রজেক্টে ওঁরা যুক্ত, শুরুর সময় থেকে। কথন বন্দ্যোপাধ্যায়, কৌশিক ব্যানার্জি, মারিয়া ভিট্টোরিয়া মাজামুতো, সুমন কোলে, জন এল কোপরোস্কি, কামার কুরেশি ও যাদবেন্দ্রদেব ঝালা । এই সাত বিজ্ঞানী ৯টি স্থানীয় ফেলিড (felids) বা অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের বন্য বিড়ালের উপরে তাঁদের রিসার্চ শুরু করেন। তাদের অবস্থা, বাসস্থান, সমস্যা আর চোরাশিকারের কারণে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কাজ শুরু হয়।
এদের মধ্যে ছিল
১ ক্যারাকল Caracal,
২ ডেজার্ট ক্যাট desert cat,
৩ ফিশিং ক্যাট fishing cat (পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য প্রাণী)
৪ জঙ্গল ক্যাট jungle cat
৫ রাস্টি স্পটেড ক্যাট rusty spotted cat
৬ ক্লাউডেড লেপার্ড clouded leopard
৭ লেপার্ড ক্যাট leopard cat
৮ মার্বেল্ড ক্যাট marbled cat
৯ গোল্ডেন ক্যাট golden cat
এই নয়টি স্থানীয় ভারতীয় ছোট বিড়ালের ওপরে বিজ্ঞানীরা তাঁদের কাজ শুরু করেন। ওই বিড়ালগুলির সংরক্ষণের অবস্থা মূল্যায়ন করে, উন্নততর প্রজাতি সংরক্ষণের জন্য ডেটা একত্রিত করেন। বিশ্বব্যাপী ছোট মাংসাশী প্রাণীর সংরক্ষণের নিরিখে এদের সংযোগ স্থাপন করেন বিজ্ঞানীরা। এই কাজ বেশ ক্টহিন ছিল। কারণ বিগত ৫০ বছরে এদের সম্বন্ধে তথ্যের ব্যাপক অভাব ছিল। আর এই সমস্যা বিজ্ঞানীদের জন্যে পদে পদে বাধা হয়ে ওঠে। এর ফলে প্রাথমিকভাবে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ যে ইকোলজিক্যাল ডায়নামিক্স তার কোনও তথ্যই পাচ্ছিলেন না বিজ্ঞানীরা।
তাই অন্য পথে কাজ শুরু হয়। সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই 'ছোট বিড়ালদের' বাসস্থানের পরিবেশ, জলবায়ু, মানুষের সঙ্গে বাসস্থান ভাগের ফলে তৈরি সমস্যা, বড় মাংসাশী প্রাণীর উপস্থিতি, এদের বাসস্থানের টোপোগ্রাফি আর গাছপালার ধরণের ওপরে ভিত্তি করে কাজ শুরু করেন বিজ্ঞানীরা। ওই সাত বিজ্ঞানী দেখেন বন আইনের কিছুটা কড়াকড়ির কারণে ১৯৯৭ থেকে চোরা শিকারের বাজারে এই ৯ বিড়ালের চাহিদা কিছুটা কমেছে। কিন্তু সমস্যা আরও ব্যাপক হয়েছে।
এদের মধ্যে অধিকাংশই তাদের বাসস্থান মানুষের সঙ্গে ভাগাভাগি করে থাকে। যেমন আমাদের রাজ্য প্রাণী ফিশিং ক্যাট বা মেছো বিড়াল।
তাই মানুষের সঙ্গে এদের সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ফ্যাক্টর। রোজ বাড়ছে মানুষের জনসংখ্যা, বাড়ছে শিল্প, আর তার ফলে এদের বাসস্থান সংকুচিত হচ্ছে। তাই বিজ্ঞানীরা এদের সংরক্ষণে পরিবেশগত তথ্যের প্রয়োজনীয়তা দৃঢ়ভাবে তুলে ধরেন। বিশেষ করে জনসংখ্যা, শিকার-শিকারীর সম্পর্ক এবং মানুষের কারণে এদের আবাসস্থল পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়াগুলি নিরীক্ষণ করেন। এই ফ্যাক্টরগুলিকে সংরক্ষণগত কৌশলগুলির মধ্যে একত্রিত করার পক্ষে সওয়াল করেন।
এ বিষয়ে নিজেদের গবেষণার শেষে ওই বিজ্ঞানীরা বলছেন বিশ্বব্যাপী ছোট বিড়াল বা ফিলিডের (felids)সফল সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে প্রয়োজন এদের জন্য রাজনৈতিক স্তরে দেখভাল ও প্রতিশ্রুতি। আর এদের বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক সমর্থন ও সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা। এই কাজ যুদ্ধকালীন তৎপরতায় না হলে এরা বিপন্ন থেকে বিলুপ্ত হতে আর দেরি নেই।
সারা দুনিয়ার বাস্তুতন্ত্রে এদের, এই ছোট বিড়ালদের ভুমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাই এদের সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে যেকোনও সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন ওই বিজ্ঞানীরা।
Saturday, February 4, 2023
লাল শালু 'বীরন্ন' সাম্রাজ্য
এটা একটা ২ বছরের পুরনো লেখা
পুরনো চাল নাকি ভাতে বাড়ে!
বড় বড় জুঁইফুলসাদা ভাত রুপোর কাঠি
হলুদ জাফরানরঙা ভাত সোনার কাঠি
এক বীরন্ন রূপকথা
বাতাস বিরিয়ানভি
পথেই হবে যে পাত চেনা
চলতে চলতে মানুষ চালাক হয় কি না জানা নেই, কিন্তু চালক হয় আর চালু হয়। চালের দানা আর চুলোর আগুন খুঁজতে খুঁজতে চালু হয়। চালু মানে ইজি, চালু মানে জীবনে বা হোয়াটসঅ্যাপের স্ট্যাটাসে “অ্যাভেলেবেল” হয়। চুলোয় জ্বলতে থাকা আগুনেরও তো চাই চালের দানা। তাই চালু পথ গন্তব্য বেঁধে দেয়। পাতের যোগানে পথেই নামে যে রোজ, তার জীবন আর সেই পথের বাঁকেই অজান্তে কোথাও হয়ে যায় পাত চেনা। প্যারডিতে সলিল গেয়ে ওঠেন “পথে এবার নামো সাথি পথেই হবে যে পাত চেনা”। আমার শহর
কলকাতায় তো আসলে লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য কোল পাতা। যারা সকালে উঠে এ শহরে আসেন আর রাত্রে বহুদূর মফস্বলের বাড়িতে ফেরেন। রোজকার লোকাল ট্রেনের অ্যাম্বার আলোমাখা কালো জানলা, শেষরাতে কুকুর জাগা পাড়া আর ফাঁকা প্ল্যাটফর্মের শূন্যতা। তাঁরা যেন নিজভুমে পরবাসী। এ শহরেও তাঁরা কি বহিরাগত? এ তত্ব, এ শব্দ খাটে না এই মলিন ম্যাড়ম্যাড়ে শহরটার ক্ষেত্রে। এ শহর যেন ক্ষয়িষ্ণু রক্তাল্পতায় ভোগা এক একাকীনি মা। যিনি পাত পেড়ে ভাত বেড়ে তার সন্তানদের জন্য বসে আছেন। হাতের হলুদ মোছা আঁচলে মুখ মুছে। মুখে হাসি নিয়ে। আর তার সন্তানরা? তাদের কথা তো জানা। তাঁরা আছেন তাই এ শহর বাঁচে।
এ শহর অন্নপূর্ণা। প্রতিদিন নবান্নের প্রত্যাশায় আগুন জ্বলে এই শহরের উনোনে উনোনে। কখনও পলান্ন, কখনও ‘বীরান্ন’ বেড়ে বসে আছে তার নিত্যদিনের জীবন সংগ্রামে কখনও জিতে বা কখনও হেরে যাওয়া সংগ্রামী সন্তানদের জন্য। জীবনের বীর আমজনতার জন্য। আজ সেই বীরান্নের গল্প। যার কৌলীন্য ম্লান হয়ে গেলেও প্রলোভন প্রশ্নাতীত। পড়ে যাওয়া জমিদার বাড়ির মতই যার দম্ভ। ইত্তিহাসের মতই গৌরবান্বিত যার অতীত। শহর কি মফস্বলে একটা মাংসের দোকানের আশেপাশেই তার মন্দির, ঠেক,আড়ত বা যা খুশি বলতে পারেন। দূর থেকে লাল শালু বাঁধা হাঁড়ি যেন গ্ল্যাডিয়েটর অ্যারিনার যোদ্ধার হাতের লাল কাপড় আর আমার আপনার উন্মত্ত ক্ষুধা যেন ক্ষ্যাপা ষাঁড়। ফুঁসছে কখন বেরিয়ে এসে ‘আক্রমণ’ বলে হামলে পড়বে ওই একটা থালা ভরা সেদ্ধ চাল,আলু,ডিম আর মাংসের পারাবারে। পার পাবে না কেউ! এমন মিঠা আতর, কেওড়া জল মেশানো ঘ্রান আসছে। এক এক বার করে বিশাল ঢাকনা হাঁড়ির মুখ থেকে সরছে আর ভক ভক করে বাতাসে মিশে যাচ্ছে সেই ঘ্রান।
আমাদের লড়াইয়ের ঘাম অশ্রু, দূষণ ডিজেল, গ্রিন হাউজ বাতাসে ভারি সুন্দর লাগছে আউধি পাখওয়ানের খসবু। বাতাস ভারী হচ্ছে। বাতাস বিরিয়ানভি হচ্ছে। মেহফিল জমছে। আমাদের হেরে যাওয়া, লড়াই করা, ঘেয়ো কুকুরসম জীবনে যেন এক লহমায় টপাটপ মোমের বাতি জাগছে। জীবনের ঝাড়বাতিটা ঝাড়পোঁছ হচ্ছে রসনার আলো জ্বলবে বলে।
এ শহর খালি পেটে ফেরায় না কাউকে। পকেটের মাপ অনুযায়ী থালা ভরে ভাত বেড়ে দেয়। ক্ষ্যাপা পরশ পাথর খোঁজে ট্রামের লাইনে আর বিড়বিড় করে বলে “দানে দানে পে লিকখা রহতা খানেবালওঁ কা নাম।“ আর আমার আপনার মত কিছু মানুষের রস ও রসনায় ভর করছেন নবাব ওয়াজেদ আলি শাহর রহেমত। আমার আপনার খেটে খাওয়া শহর, লড়তে লড়তে হার না মানা শহর, ঘাম মুখ ধুয়ে রুমালে গাল মুছে প্যাকেটের আবরণ সরাচ্ছে। টালিগঞ্জ পাড়ার সহকারী টেকনিসিয়ানটি আজ টিফিন আনে নি, লাঞ্চে প্রোডাকসান বিরিয়ানি খাওয়াবে বলে। যদিও সহ অভিনেত্রিটি আগামিদিনে লিড রোল পাওয়া ও রোগা হবার বাসনায় শুকনো শসাতেই লাঞ্চ মেটাবেন। শপিং মলের সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করা মহিলা, যার হাতের শাঁখা পলা আর তার সঙ্গের শার্ট প্যান্টটা বড় বেমানান কিংবা ছোট অফিসের আরও ছোট ক্ষয়িষ্ণু কর্মী, যার তিন দিন অফিস ঢুকতে লেট হলে একদিনের পারিশ্রমিক মালিক কাটবেই আর তাতেই তার মুখ কালো। সেসব মুখে হঠাৎ হাজার ভোল্টের আলোর ঝিলিক। হলুদ, সাদা চালের আস্তরণ সরছে, যেন সোনার কাঠি আর রুপোর কাঠির ছোঁয়া লেগে চকমকি হচ্ছে। প্রকাশিত হচ্ছে সেই ‘পট মিল’ যার প্রতিশ্রুতিতে অনেক মানুষকে অপহরণের টোপও তৈরি করা যায়। বিরিয়ানি! ঝটপট সাবাড় সমস্তটা ।
কলকাতার বিরিয়ানি পাক্কি বা পাক্কা বিরিয়ানি। ঢাকায় কাচ্চি বাঁ কাসসির চলটাই বেশি। বিরিয়ানি বিশেষজ্ঞ বা খাবার বিশারদরা যদিও বলেন বিরিয়ানি হয় গরুর মাংসেই। বাকিসব মাংস মিশ্রিত ভাতই নাকি পোলাও! বাংলাদেশে মোরগ পোলাও আসলে আমাদের চিকেন বিরিয়ানিরই নামান্তর। কোনও চিনা যেমন কলকাতার পথ চলতি সার্বজনীন চাইনিজ খেয়ে চিনতে পারবেন না ওটার চিন দেশে জন্ম, তেমন কলকাতার বিরিয়ানিও সময়ের প্রয়োজনে, চাহিদার যোগানে নিজের রূপ পরিবর্তন করেছে। তাই কলকাতার বিরিয়ানির নিজস্ব স্বাদ যেন স্বতন্ত্র। যেন ভৌগলিক নিশান উড়িয়ে স্বমহিমায় আসীন তার সিংহাসনে। শুধু মাটন, চিকেনেই থেমে নেই এই বিরিয়ানি। ডিম বিরিয়ানি, আলু বিরিয়ানি এমনকি পনির বিরিয়ানি পর্যন্ত পাওয়া যায় বাজারে। আয়তন অনুযায়ীও বিরিয়ানির হেরফের এ শহরের সিগনেচার। মুম্বাইয়ে কাটিং চায়ে পাওয়া যায় বলে যারা নাক সিটকান তাঁদের অবগতির জন্য সবিনয়ে বলি আমার আপনার শহর ‘হাফ প্লেট’ বিরিয়ানিও অফার করে। পুরানো দিল্লীর দরিয়াগঞ্জের যে মসজিদটি আছে তার আশেপাশে ওজন করে পাওয়া যায় কাবাব ও বিরিয়ানি। সেই সংস্কৃতিও এখন ধীরেধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে কলকাতায়। বিরিয়ানির চালের ব্যবহারেও এসেছে এক উল্লেখযোগ্য বদল। খুব একটা জনপ্রিয় না হলেও বাসমতীর জায়গায় গোবিন্দভোগ চালের বিরিয়ানি পাওয়া যাচ্ছে শহরের বেশ কটি ছোট বড় রেস্তোরাঁয়।
আসলে খিদে যে বড় বালাই। যে বুঝেছে সেই সম্মান করে পাতকে। সেই পাত পেড়ে ভাত বাড়ে। ক্ষুন্নিবৃত্তির চেয়ে বড় সভ্যতা বোধহয় আর কিছু নেই। সিরাজ, আমিনিয়া, আরসালান, জিশানের সম্ভ্রান্ত অন্দরমহলে ঢুকতে যাদের পিছনে টেনে ধরে ফুটো পকেট আর জীবনের হাজারো কষ্টকর আর্থিক প্রতিবন্ধকতা তাঁদের জন্যই ওই লাল শালু ঢাকনা দেওয়া টং টং ধবনি। কলকাতার নতুন অফিসপাড়া সেক্টর ফাইভে এ লাঞ্চ আওয়ারে গেলে দেখবেন যেন ধর্মতলার ফুটের সেল চলছে। একজন যুবক হাঁকছেন “শুধু ষাট শুধু ষাট” তো তার সহকারী তরুণটি “ষাট শুধু ষাট শুধু”। এক অনাবিল ক্যাকোফোনি ধ্বনিত হচ্ছে। আহ্বানের রোমাঞ্চকর সে কোরাস গীতি যেন হ্যামলিনের বাঁশি! গুটিগুটি পায়ে তথ্য প্রযুক্তি প্রকৌশলীরা আসছেন ঝুপস গুলিতে। পরিষ্কার পরিবেশে এই কোভিডোত্তর কলকাতায় ধোঁয়া ওঠা সেদ্ধ চালের ফাঁকে ফাঁকে দেখা দিচ্ছে চিকেনের লেগ পিস , মাটনের সিনা, পাঁজরা, পিছলি রানের অংশ বিশেষ। মুখেই মিলিয়ে যায় এমন চন্দ্রমুখি আলু এক চামচে ক্ষতবিক্ষত। আহ জীবন! তুমি এত কিছু রেখেছ এখনও আমার জন্য!
সময়ের সাথে সাথে বাংলায় বিরিয়ানি ক্রমে ক্রমে তার কৌলিন্য হারিয়েছে। একটা সময় যখন সারা শহরে বিরিয়ানি বলতে পার্ক সার্কাস বা আমিনিয়া, সিরাজই বুঝত বাঙালি তখন বিয়েবাড়ির ভোজসভায় শো স্টপারের ভুমিকায় অবতীর্ণ হত বিরিয়ানি। বিরিয়ানি কাটার মিস্ত্রী মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সিরাজ বা আমিনিয়া থেকে আসত বিয়েবাড়িতে। সে মিস্ত্রী শুধু কেটেই খালাশ। রান্নার দায় তার থাকত না। আজ সেই কুলীন খাদ্য তার অবস্থান থেকে অনেকটা নেমে এসেছে। সে পতন খুব একটা কম নয়। একেবারে সটান পথেই নেমেছে সে। পথে নেমে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে।
তাই তো এনআরসি (NRC)ও সিএএ(CAA) র প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক যখন অবরুদ্ধ হয় তখন সংবাদ শিরোনামে ছবি আসে – পথ জুড়ে তোড়জোড় হচ্ছে বিরিয়ানি রান্নার। প্রতিবাদের ভাষার সাথে কোথাও বিরিয়ানি মিলে মিশে একাকার। অবরোধকারিদের তুলতে এসে পুলিশও পুরো থ। এ কেমন প্রতিবাদ? একদিকে শয়ে শয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি অন্যদিকে অবরোধকারিরা রীতিমত আলু কেটে, পিঁয়াজ কেটে, চাল সেদ্ধ করে বিরিয়ানি রান্নার তোড়জোড় করছে! কোথাও রাজ সিংহাসন থেকে নেমে এসে মানুষের সাথে মিলেমিশে গেছে এই জনগণমন তান্ত্রিক খাবার।
তীব্র মহামারিতে যখন দিশাহীন মানুষ। জীবন গিয়েছে থেমে, চলে গেছে জীবিকা, আর্থিক নিরাপত্তাও বিপন্ন। তখনও মানুষের পাশে এসে তার জীবনের লড়াইয়ে হাতটা ধরেছে বিরিয়ানিই। ঘটনাস্থল মুম্বই। গত আট বছর ধরে মুম্বইয়ের বেশ কটি পাঁচতারা হোটেলে সেফ হিসেবে কাজ করেছেন অক্ষয় পার্কার। কোভিড আবহে কাজ হারিয়ে দিশেহারা অক্ষয় হেরে যান নি, দমেন নি। দাদরের শিবাজি মন্দির এলাকায় রাস্তার পাশে খুলেছেন ‘পার্কার বিরিয়ানি হাউজ’। পাঁচতারা হোটেলের স্বাদ ছড়িয়ে দিয়েছেন অলিতে গলিতে। খুলে গেছে সিমসিম! অক্ষয় ভেজ, আণ্ডা আর চিকেন বিরিয়ানির থালা সাজিয়ে দিচ্ছেন শহরবাসীদের। আধ প্লেট ৬৫ টাকা আর পুরো থালা ১৪০ টাকা দিয়ে চেটেপুটে খাচ্ছে 'আখখা মুম্বই'। অক্ষয় অর্ডার পাচ্ছেন পার্টি অর্ডারও। ভেজ বিরিয়ানি প্রতি কেজি ৮০০ টাকা আর নন ভেজ প্রতি কেজি ৯০০ টাকা। বাড়ির একমাত্র উপার্জনকারী অক্ষয় বিরিয়ানির হাত ধরে পায়ের তলায় মাটি পেলেন।
রাস্তার বাজে বিরিয়ানিরা
রাস্তার ভাল বিরিয়ানি অনেক রয়েছে। তবে যাদের জন্য বদনাম হয় পথের বিরিয়ানি তাদের হেঁশেলের উপকরণের খোঁজ একটু নেওয়া যাক এবার। চাল আধ সেদ্ধ করে রাখা হয়। তারপর মাংস হলুদ জলে সেদ্ধ করে রাখা হয়। এরপর পামোলিন তেলে মাংস কিছুটা রান্না করে বেরেস্তা (আগে থেকে ঝুরো ঝুরো করে কাটা পেঁয়াজ ভাজা), বিরিয়ানি মশলা আর ঘি ছড়িয়ে চাপা দেওয়া হয়। রাস্তার বিরিয়ানির সবচেয়ে বড় সমস্যা বা হেলথ হ্যাজার্ড হল পামোলিন তেল আর হলুদ কামধেনু রঙ। কেশরের বদলে এই ইণ্ডাস্ট্রিয়াল রঙ ব্যবহারের ফলেই রিস্ক বাড়ে ক্যান্সার সহ বহু জটিল স্নায়বিক রোগের আর পথের বিরিয়ানিও আমজনতার কাছে হয়ে ওঠে ভিলেন।
কেন বিরিয়ানি এত জনপ্রিয়
কলা আর কাঁঠাল এর মধ্যে কলা কেন জনপ্রিয় এ কথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। কলা খাওয়ায় কোনও ঝামেলা নেই। চটপট খোলো আর ঝটপট খাও। একই কথা বিরিয়ানির ক্ষেত্রেও হয়ত খাটে। একটি নির্ঝঞ্ঝাট সম্পূর্ণ খাবার। ঝোল পড়ে যাওয়ার সমস্যা নেই, কাঁটা বাছার অসুবিধা নেই। হাতটা টিস্যুতে মুছে অল্প জলে ধুয়ে নিলেই হ’ল। কোথাও যেতে যেতে গাড়িতেও খাওয়া যায়। সাথে সাইড ডিস কিছু না হলেও দিব্যি চলে। তাই তো পাতুরির চেয়ে বিরিয়ানি এত জনপ্রিয়। তাছাড়াও ডাব চিংড়ি কিংবা ইলিশ ভাপার একটা মিল এর তুলনায় একটা বিরিয়ানি দামেও সস্তা। এটাও বিরিয়ানির জনপ্রিয় হওয়ার একটা বড় কারন। একই পরিমাণ প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট আর ফ্যাট একসাথে বাজারের অন্য খাবারের তুলনায় অপেক্ষাকৃত সস্তায় পাওয়া যায় বিরিয়ানিতেই। তার ওপর এতটুকু সম্ভ্রম না কমিয়ে অপেক্ষাকৃত সস্তায় নবাবী খাবার বলতে তো বিরিয়ানিই আছে। কাজের মাঝে বা কাজ করতে করতে বিরিয়ানি খাওয়া যায় অনায়েসেই। তাই এককালের কুলীন পাখওয়ান তার কৌলীন্য হারিয়ে হয়ে জনতার দরবারে হয়ে উঠেছে জনপ্রিয় ফাস্ট ফুড।
কলকাতা বা তার আসেপাশে ফুটের বিরিয়ানির এপিসেন্টার বা হটস্পট
ডালহৌসি, স্টক এক্সচেঞ্জ এলাকার অফিস পাড়ার বিরিয়ানি। কেন্দ্র, রাজ্য সরকারি কেরানি থেকে বড়বাবু সবাই নিয়ম করে খদ্দের। বাদ যান না বেসরকারি চাকুরে কিংবা চাকরি প্রার্থীরাও।
মেটিয়াব্রুজ এলাকায় লাইন দিয়ে বিরিয়ানি খাওয়া একটা দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। মেটিয়াব্রুজের রাস্তার বিফ বিরিয়ানি যেকোনোও কুলীন বিরিয়ানিকে টেক্কা দেবে।
মমিনপুর, খিদিরপুর ওয়াজেদ আলি শাহের এলাকা অতএব এখানকার বিরিয়ানি তো প্রণম্য।
পার্কসার্কাসের সাত মাথার মোড় আর বিরিয়ানির সংযোগ যেন সাত পাকে বাঁধা। কুলীন আরসালান, আমিনিয়া, জিসানের পাশাপাশি হাজারো হাজি সাহেব পথ আলো করে, গন্ধ মম করে বসে আছে। পার্কসার্কাসে পথে ঘাটে কারনে অকারনে বিরিয়ানি বানানো যেন অর্ডার অফ দ্যা ডে।
এই অঞ্চলে ভাল গোস্ত বিরিয়ানি বা গরু বিরিয়ানি পেতে লাল মসজিদের পাশে আর উল্টো দিকের ইটিং হাউজ গুলোয় ঢুঁ মারুন।
বিফ বিরিয়ানি ভাল পাওয়া যায় রাজাবাজার এলাকায়। আর মেটিয়াব্রুজ অঞ্চলেও।
সেক্টর ৫ কলকাতার নতুন অফিস পাড়া। ওয়েবেল মোড় আর এসডিএফ এলাকার দর্মার ঝুপড়ি দোকান। প্রচলিত নাম ‘ঝুপ’। সেখানকার কেজিএন বিরিয়ানি ভাল বিরিয়ানির নতুন ঠিকানা।
নিউটাউন ফুড জোনে ঝুপসের বিরিয়ানি অ্যাপের মাধ্যমে অর্ডার পায়। বিক্রিও হয় হুহু করে। এখানকার আজহার বিরিয়ানি বেশ জনপ্রিয়।
ফুলবাগানের রাজ বিরিয়ানিও বেশ স্বোয়াদিষ্ট।
ওয়েলেসলি এলাকার হাণ্ডি বিরিয়ানি জিভে জল আনে।
টিপু সুলতান মসজিদের নীচে মঞ্জিলাত এর বিরিয়ানির মেজাজটাই আলাদা ।
রাসবিহারী অ্যাভিন্যুয়ে সমর দার বিরিয়ানি। সমর কয়াল রোজ ১৫০ থেকে ২০০ হাফ এবং ফুল প্লেট বিরিয়ানি তৈরি করেন। প্রিয়া সিনেমার উল্টো দিকের ফুটপাথে বসছেন ২০ বছরের বেশি সময় ধরে। শুধু বিরিয়ানিই বিক্রি করেন। চিকেন, মটন এবং আলু বিরিয়ানি।
লেক গার্ডেনসের অন্নপূর্ণা বিরিয়ানির বেশ নামডাক। অর্ডার দিয়ে প্যাকেট হাতে পেতে বেশ সময় লাগে।
বারুইপুরের আসমা বিরিয়ানি একটা সময় ফুট থেকে শুরু করে আজ ব্র্যাণ্ড। চিকেন, মটন আর বিফ বিরিয়ানি পাওয়া যায়।
যেমন ব্র্যাণ্ড হয়েছে ব্যারাকপুরের দাদা বৌদির বিরিয়ানি। ৫ মিনিটে ১০০ প্যাকেট বিরিয়ানি বিক্রির রেকর্ড এই দোকানের। দিনের যে কোনও সময় গেলে অর্ডার দেওয়ার জন্য লাইন দিতেই হবে আপনাকে।
ব্যারাকপুরে একটু বাইরেই আছে ডি বাপির বিরিয়ানি। এলাকায় বেশ নামডাক এনারও।
ব্যারাকপুরের ঢাকা বিরিয়ানির প্রলোভন এড়ানো অসম্ভব।
জগদ্দলের বহু দোকানের ফুটের বিরিয়ানিরও আশেপাশে বেশ নামডাক।
কল্যাণী এলাকায় সম্রাট বিরিয়ানি, সোনালী বিরিয়ানি, ঘোষ দার বিরিয়ানি বিখ্যাত।
বোম্বে রোডের অঙ্কুরহাটি এলাকায় জাতীয় সড়কের দুপাশে পরপর রয়েছে বেশ কিছু রাস্তার বিরিয়ানি স্টল।
দ্বিতীয় হুগলী সেতু থেকে নেমে আন্দুল রোড ধরে আলমপুর পর্যন্ত গেলে দুপাশে বেশ কয়েকটি রাস্তার বিরিয়ানি। তারমধ্যে মুসকানের বিরিয়ানি গভীর রাত অবধি জেগে থাকে।
কাউয়া বিরিয়ানি আসলে কী কাকের মাংস?
কাউয়া বিরিয়ানি আসলে ‘কাউয়া’ বা কাকের মাংস দিয়েই বানানো কিনা তা প্রমাণ সাপেক্ষ। তবে কম দামে মুরগীর জোগান দেয় বিভিন্ন পোলট্রি ফার্ম। সে ক্ষেত্রে কোনও রোগ বা মড়কে মুরগী মারা পড়লে বা স্বাভাবিক ভাবে মরা, মৃত মুরগী দিয়ে বানানো হয় সস্তার বিরিয়ানি। জলের দরে কিনে তা দিয়ে লাভের কড়ি ভালই কামান কাউয়া বিরিয়ানি ওয়ালারা।
ভাগাড় কাণ্ড ও বিরিয়ানি
২০১৮ র এপ্রিল মাসের শেষ দিকে এক ভোরবেলা বজবজের একটি ভাগাড়ের কাছে একটি গাড়ির চাকা কাদায় আটকে যায়, স্থানীয় বাসিন্দারা দেখেন গাড়িটি থেকে বেশ কিছু প্যাকেট নামানো হচ্ছে। পচা মাংসের কটু গন্ধ পেয়ে স্থানীয় মানুষজন গাড়িটিকে আটকে রেখে পুলিশকে খবর দেন। পুলিশি জেরায় ধৃতরা স্বীকার করে শুধু বজবজেই নয় কলকাতার বেশ কিছু ভাগাড় থেকে মৃত পশু ও পাখিদের দেহাবশেষ ও মাংস কেটে নিয়ে তার সাথে রাসায়নিক মিশিয়ে হিমায়িত করে তারপর সেসব মাংস তারা চালান করত কলকাতার বহু নামি ও বেনামী হোটেল, রেস্তরাঁতে। স্বভাবতই সেই মাংসর বিশাল একটা অংশ আসত রাস্তার পাশের বহু বিরিয়ানির দোকানে। এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই রোজই সংবাদের শিরোনামে উঠে আসে খাদ্য দপ্তরের রেইডের ঘটনা। সাথে মিডিয়ার কভারেজ দিনের আলোর মত পরিষ্কার করে দেয় শহরের খাবারের হাল ও চালচিত্রটা। একের পর এক নামজাদা রেস্তোরাঁতেও অভিযান চালায় রাজ্য খাদ্য দফতর। সংবাদপত্র আর টেলিভিশন চ্যানেল গুলোতে হেড লাইন নেয় পচা গলা পশু ও পাখির মাংসের ছবি। কলকাতার একটি কোল্ড স্টোরেজ থেকে উদ্ধার হয় দুই মেট্রিক টন হিমায়িত পচা মাংস।
তবুও আমজনতা বা শহরবাসীর রাস্তার বিরিয়ানি খাওয়ার অভ্যাসকে বন্ধ করতে পারেনি ভাগাড় কাণ্ডের আতঙ্ক। সাময়িক মন্দার পর আবার গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে লাল শালু বিরিয়ানি সাম্রাজ্য। আসলে সস্তা খাবারের যোগান আর আকাশ জোড়া অভাব যখন পাশাপাশি বাস করে তখন আতঙ্কের বাতাবরণকে যখন তখন উপেক্ষা করা যায়। ভাগাড়ের ইতিহাস বোধহয় তা ই শিখিয়েছে এই আদ্দিকালের শহরকে।
খাবারের পাতে ধর্মের ছদ্মবেশে রাজনীতির আস্ফালন ও বিরিয়ানি
২০১৯ জুন মাসের প্রথম দিকে এই শহর দেখল অদ্ভুত এক ঘটনা। যা ইতিপূর্বে এই বাংলা দেখে নি কখনও। চারপাশে ঘটে চলা অসহিষ্ণুতার প্রেক্ষিতে এই ঘটনা মারাত্মক ইঙ্গিতবাহী। একটি ব্যাক্তিগত উদ্যোগে কিছু মানুষজন কলকাতায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জনজাতির খাবার নিয়ে আয়োজন করে একটি খাদ্য উৎসবের। গরু, ছাগল, শুয়োর ও মাছের বিভিন্ন পদ দিয়ে সাজানো ওই উৎসবের নাম রাখা হয় ‘বিফ ফেস্টিভ্যাল’। উদ্দেশ্য পাকস্থলির উৎসব যাপনের মাধ্যমে সামাজিক সম্প্রীতির উদযাপন। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই খবর প্রচারিত হতেই জামার আস্তিন গুটিয়ে মারমুখি হয়ে ওঠে তীব্র ধর্মীয় ভাবে গোঁড়া কিছু সংগঠন। অনুষ্ঠানটির আয়োজকদের উদ্দেশ্য করে কটূক্তিতে ভরে যায় সামাজিক মাধ্যম। ঘটনার তীব্রতা এমন হয়ে পড়ে যে ‘বিফ ফেস্টিভ্যালে’র নাম বদলে ‘বিপ ফেস্টিভ্যাল’ করতে বাধ্য হয় আয়োজকরা। তাতেও ক্ষান্ত হয় না ধর্মান্ধ সমাজ রক্ষকরা।
অনুষ্ঠানের আয়োজকদের কাছে আসে প্রায় ৩০০টিরও বেশি হুমকি ফোন। আয়োজকদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অনুষ্ঠানটি বাতিল করবার। এই বিপ ফেস্টিভ্যালের বন্ধ হয়ে যাওয়া এ শহরের খাদ্য সংস্কৃতিতে ধর্মীয় সংগঠনের রক্তচক্ষু ও প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক অনুপ্রবেশের নিরিখে নিঃসন্দেহে একটিযুগান্তকারী ঘটনা। ভবিষ্যৎই বলবে কোন যুগের সূচনা করল এই ঘটনা।
সার্বজনীন খাবার, এ শহর কাউকেই খালি পেটে ফেরায় না
বাংলায় খাবারের পাতে মাংসের জাত কোনও দিনই ধর্মের নিক্তিতে মাপা হয় নি। এ শহর খাবারের স্বাদ, গুণগত মান এবং দামকেই গুরুত্ব দিয়ে রসনা বিলাসে মেতেছে। অপেক্ষাকৃত কম রেস্তওয়ালা, গরীব গুর্বো মানুষ জন কেও এ শহর বিমুখ করে নি। রাজপথ থেকে রাজ দরবার সর্বত্রই বিরিয়ানির অবাধ পদচারনা। ব্রিগ্রেড কাঁপানো রাজনীতির অলিন্দেই হোক কি ইডেনে শীতের রোদে উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকা স্কোর বোর্ডকে একধারে রেখে বিরিয়ানির মোড়ক খুললেই বাঙালির আর থাকে 'না লাজ লজ্জা, ঘোচে সাজসজ্জা' এক অমোঘ টানে বিরিয়ানির ঘ্রাণে সে মন্ত্র মুগ্ধের মত আবিষ্ট হয়ে পড়ে।
এ শহরে সব চাওয়া পাওয়া মেটে না সবার। কারও কারও দিনের শেষে ম্লান মুখ কাকেশ্বর কুচকুচের মতই অন্ধকার হাতে ধরা শুধই পেন্সিল। তবুও সেই রোজকার জীবনের সংগ্রামে বীর মানুষগুলোর জন্যই তো সাদা হলুদ ভাতের ফাঁকে আলু, ডিম, আর মাংসের আহ্বান। তবুও তো আর পাঁচটা দিনের সাদামাটা ভাতডালতরকারী জীবনে বীর বেশে বিরিয়ানির পদার্পণ সাদাকালো জীবনটাকে এক লহমায় রঙিন করে তোলে। এ হেন অন্ন তো বীর অন্নই বটে। আমরা যদি বিরিয়ানিকে তাই আদর করে “বীর অন্ন” বলে ডাকি তা কি খুব ভুল হবে?
Sunday, September 11, 2022
ওঁদের জীবনের ম্যাজিকে হার মেনেছে ৯/১১
Saturday, August 20, 2022
স্মৃতি অফ জয়ঃ বন্ধু বাইলেন - সংবাদ প্রতিদিনের ক্রোড়পত্র 'রোববারে' প্রকাশিত
আমাদের স্কুল বয়সে রেডিও-ই ছিল দূরের জানলা। তাও সেটা সব সময় সহজলভ্য ছিল না। 'মারফি মিনিব্য ডিলাক্স'-এর ব্যাটারি কমে গেলে বা ঝড়-জলে সিগন্যাল ডিস্টার্বড হলে রেডিও শোনার মজাটাও কিরকিরে হয়ে যেত। তখন ধারাবিবরণী শোনার চেয়ে পাড়ার খেলার মাঠই বেশি ডাকত। যেহেতু বেড়ে ওঠার রেলওয়ে কলোনিটা কলকাতা থেকে অনেক দূর, জেলায়- তাই খবরের কাগজ যখন হাতে এসে পৌঁছত, তখন বোধহয় পরের দিনের কাগজ অর্ধেকটা ছাপা হয়ে যেত। আমাদের নিস্তরঙ্গ জীবনযাপনে ঢিল মেরে যেত শেষ বিকেলে হাতে পাওয়া সংবাদপত্রের শিরোনাম। '৮৩-তে ভারতের বিশ্বকাপ জেতার 'সেলিব্রেশান' নেহাতই 'নাদান বয়স' আর ভৌগলিকভাবে আলোকবৃত্তের অনেক বাইরে থাকায় ভালভাবে আঁচই করতে পারি নি।
কিন্তু জীবন আচমকা কত কী দেয়!
২৫ বছরের একটা টাইম ল্যাপ।
কাট টু ২৩ জুন ২০০৮। দিল্লির 'সুন্দর নগর'-এর ৩৯ নম্বর বাড়ির বাইরের রাস্তা। বাড়িটার নাম-ফলকে লেখা মালিকের পরিচয়-- কে, দেব। আমার সঙ্গী রেডিওর বদলে ক্যামেরা। রিপোর্টার দেবাশিসের সঙ্গে সেই পড়ন্ত বিকেলে পায়চারি করছি। আজ একটা ফাটকা খেলছি আমরা। ৮৩'-র বিশ্বজয়ী দলের 'সাপোর্ট স্টাফ'-দের কানাঘুষোতে আড়ি পেতে পাওয়া একটা 'টিপ'(Tip)- কে 'লক্ষ্যভেদ' করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। দেবাশিস বলছে-'১৯৮৩-র ২৫ জুন ওয়ার্ল্ড কাপ জেতার পর থেকে টিমমেট-রা একসঙ্গে কোনও পার্টি করেনি। আজ এই বাড়িতে ২৫ বছরের তুলে রাখা সেই পার্টি! ভাবতে পারছিস? ছবি পেলে কী স্টোরি হবে! আনবিলিভেবল!' তখন ওর রক্তচাপ মাপলে পারদ স্ফিগমোম্যানোমিটারের স্কেলের উচ্চসীমায় ঠোক্কর খাচ্ছে দেখা যেত হয়ত! দুপুর থেকে এই একই কথা বারবার বলে চলেছে।
বিকেল ধীরে ধীরে সন্ধ্যের হাত ধরে রাতের কাছাকাছি যেতে চাইছে। ইতিমধ্যে সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের কেউকেটা দু'-তিনটে চ্যানেলের ডাকসাইটে কয়েকটা চেনামুখের আনাগোনা দেবাশিসের চোয়াল শক্ত করে দিচ্ছে বারবার। বিড় বিড় করে বলতে শুরু করল- ' কেঁচে গেল রে! এক্সক্লুসিভ থাকল না স্টোরিটা।' এরই মাঝে একটা চ্যানেল 'ওবি ভ্যান' পাঠাবে কি না জানার জন্য প্রতিনিধিকে ফোন করল। এপার থেকে- ' সারজি ইয়ে ইনলোগোঁ কি প্রাইভেট পার্টি হ্যায়। বিসিসিআই, স্পন্সর্স কোই ভি অ্যালাউড নেহি হ্যায়, তো মিডিয়া ক্যায়সে অন্দর যা পায়েগি?' ওপার থেকে কী নির্দেশ এল বুঝে ওঠার আগেই ময়দান ফাঁকা। বাকিরাও মহাজনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জুনের সেই সন্ধ্যায় মার্চ করল।
সন্ধ্যের পড়ে-যাওয়া আলোয় মরে যাওয়া আশা আর দেবাশিসের চোখ- দুটোই একসঙ্গে উজ্জল হয়ে উঠল। খোঁজখবর সিদ্ধ চোখ ততক্ষণে দেখে নিয়েছে ৩৯ নম্বর বাড়িটার ভিতরে জ্বলে-ওঠা নরম মোমের আলোগুলো। যারা হাজার বাতির ঝলকানিতে অনায়াস, তাদের নিশিযাপনের 'ট্রেলার' এর আভাষ পেয়ে 'দিল' তখন 'মাঙ্গে মোর'।
ধীরে ধীরে দিল্লির সন্ধ্যে সাবালিকা হচ্ছে। আর বাড়িটার সামনে এক একটা সম্ভ্রান্ত গাড়ি এসে দাঁড়াচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে আসছেন সৈয়দ কিরমানি, দিলীপ বেঙ্গসরকর, সুনীল গাভাসকর, কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত, শ্যাম্পেন হাতে কীর্তি আজাদ। একটা করে ছবি হচ্ছে, দেবাশিসের হাসি চওড়া হচ্ছে। এরপর এসে দাঁড়ানো গাড়ি থেকে নাম্লেন '৮৩র ফাইনালের লাস্ট ল্যাপের 'গোল্ডেন বয়' মহিন্দর অমরনাথ, সস্ত্রীক। এদিকে ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে আজকের 'এক্সট্রা টাইম'-এর 'ডেটলাইন' পেরল। 'ফিড' পাঠিয়ে আজকের বুলেটিনে এই খবরটা ধরানো যাবে না। আর অ্যাসাইনমেন্ট-টায় যা সময় লাগবে, মনে হচ্ছে ততক্ষণ খাবারের সব দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। বিস্কুট খেয়েই আজকের রাতটা কাটাতে হবে। ওদিকে ৩৯ নং বাড়িটার স্নিগ্ধ রোশনাইয়ে উজ্জ্বলতা জোগাতে আগমন হয়েই চলেছে 'ভিভিআইপি' অতিথিদের। সন্দীপ পাটিল, বলবিন্দর সান্ধু, রজার বিনি আর মদন লাল। হঠাৎ মা-র কথা মনে পড়ল।
নিতান্ত বোতল খাওয়ার বয়সে রেডিও চালিয়ে গানের ষড়যন্ত্রে আমাকে ঘুম পাড়াত মা। একবার নাকি বোতলে দুধ শেষ, আর রেডিওতে গান শেষে শুরু হয়েছে ক্রিকেট-ধারাবিবরণী। বহু দূর কোনও ক্রিজে আউট হয়েছেন ব্যাটসম্যান মদন লাল। কমেন্ট্রেটরের গলায় হা- হুতাশ- 'অউর ইয়ে মদনলাল আউট!' রেডিওটার ধারে পাশে থাকা শ্রোতাদের হতাশাব্যাঞ্জক চিৎকার ছোট্ট 'আমি'-টাকে বিচলিত করে এক অদ্ভুত উল্লাস দিয়েছিল। আধা-বোধের সেই দিনগুলোয় 'আউট' শব্দের অর্থভ্রমে কাচের ফিডিং বোতল মাটিতে ফেলে ভাঙা কাচের ওপরে নাকি শুরু করেছিলাম তুড়ুক নাচ। মুখে চিৎকার, 'মদনলাল আউত মদনলাল আউত।' পরে মনে হয়েছে ভাঙা কাচের মধ্যে না বুঝে নেচে আমার চারপাশে সেদিন না-জানি কত গব্বর সিং তৈরি করেছিলাম। হাফপ্যান্ট থেকে ফুলপ্যান্ট হওয়া কৈশোরে এই ক্যাবলামির ঘরোয়া ধারাবিবরণীতে শৈশবে জড়িয়ে থাকা নিতান্ত গুরুত্বহীন এই ঘটনায় কতবার যে আমাকে বিব্রত,লজ্জিত করেছেন মদন লাল।
সম্বিত ফিরে পেলাম এক পরিচিত কণ্ঠের ডাকে- 'আপ এক হেল্প করেঙ্গে?'
উঁচু লোহার গেটটা থেকে বেরিয়েছেন কালো হাইনেক টি-শার্ট আর জেড ব্ল্যাক জিনস পরা 'পামোলিভ কা জওবাব নেহি' হাসিওয়ালা লোকটা। কোলে লোমশ দুধ-সাদা পোষ্য সারমেয়। আড়ষ্টতা নিয়ে এগিয়ে গেলাম। বললাম- টেল মি স্যার হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ? ক্যাপ্টেন দেব ব্ললেন-'অন্দর সাবলোগ পার্টিমে হ্যায়। আপ থোড়া উনকি ভিডিও শ্যুট কর দেঙ্গে?'
বলে কী লোকটা? অনুরোধ? কী বলব একে? এ কি মেঘ না চাইতেই আকাশ ঝেঁপে বৃষ্টি? না কি সূর্যোদয়ের আগে ঝকঝকে রোদ? সম্মতি দিতেই আবার বললেন-'লেকিন এক বাত, কিসিকো ডিস্টার্ব মত করনা আপ।'
বাড়ির মালিকের সঙ্গে গেট পার করে লালচে মার্বেল পাতা ড্রাইভওয়ে পার করে ফুল দিয়ে সাজানো লনটায় যখন ঢুকলাম, তখন অদ্ভুত এক সাম্রাজ্য সেখানে। ভারতের ক্রিকেট-রংবাজির শুরুয়াতের নায়করা বসেছেন নিজস্ব মজলিসে। সঙ্গত দিচ্ছে 'সুন্দর নগর' এর সুন্দরতম এই বাড়ি। আর বাড়ির মেহমান নওয়াজ মালিক। রুচিবোধ, পরিমিতিবোধ আর আন্তরিকতা মিশিয়ে এক স্বপ্নিল প্রতীক্ষার শেষে দাঁড়িয়ে আজ সাফল্য উদযাপন করছে এই বাংলোর প্রতিটা ইট,কাঠ, ঘাস,পাতা,আলো,বাতাস। মৃদু গান বাজছে। শ্যুট শুরু কি করব? উত্তেজনায় বুকে একশো হাপরের টান। কানে বাজছে,' কোই ভি অ্যালাউড নেহি হ্যায়, তো মিডিয়া ক্যায়সে অন্দর যা পায়েগি?' মনের মাথায় মনে-মনে থাপ্পড় মেরে ঠাণ্ডা করলাম। পুরো অ্যামবিয়েন্সটা ক্যামেরাবন্দী করব চেষ্টা করছি। সব শব্দ, সব বর্ণ। হতাশ লাগছিল, সুগন্ধগুলোকে কেন যে ক্যাপচার করার কোনও উপায় নেই! ঘাসে ঢাকা ছোট্ট লনটাতে 'বাফেট কাউন্টার'। মাথায় পাগড়ি পরা শেফ-রা ব্যস্ত খাবার পরিবেশনে। রকমারি স্যালাড, স্টার্টার, মেইনকোর্স পার করে আসছে সুমিষ্ট ডেজার্ট। মাঝে মাঝে 'নহবত'-এর পুতুল মিনিয়েচার। সত্যিই তো, কাপ জেতার সানাইটা এত-দিন একসঙ্গে শোনা হয়ে ওঠেনি এঁদের। কাঠের গুঁড়ি দিয়ে বানানো টুল-চেয়ার। ব্যালকনিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মহারথীরা নৈশভোজে ব্যস্ত। আবহ-র পর এবার প্রত্যেক নায়কদের 'অলগ অলগ ক্লোজ আপ' নিতে হবে। শট ডিভিশনের আবদারটি স্বয়ং কপিল পাজি-র। অতএব ক্লোজ-আপ পর্ব শুরু।
ডিনার তখনও ভেরি মাচ অন। মৃদু শাসন কানে ভেসে এল-'ডোন্ট এভার শ্যুট, হোয়েন সামওয়ান ইজ ইটিং!' বক্তা সুনীল মনোহর গাভাসকর। কী সত্যি,অথচ সহজ কথা! খাওয়ার সময় ক্যামেরার শাসন তো একপ্রকার 'পানিশেবল অফেন্স!' আজও কথাটা সযত্নে মেনে চলি। এদিকে খোশ-আড্ডায়, ঠাট্টায়, বিগত ইতিহাস, বিগত ঝগড়া, বিগত সাফল্যের সতীর্থরা বলছে- ' বন্ধু কী খবর বল, কত দিন দেখা হয় নি!'
অটোগ্রাফ নিচ্ছেন কপিল দেব
এই জমায়েত তো কত দিন আগে হওয়ার! এই সাফল্য শ্যাম্পেনে চুমুক তো এক প্রজন্ম আগে দেওয়ার কথা! অনেকগুলো ব্যস্ত বছর পার করে আজ ওঁরা মুখোমুখি একসঙ্গে। ফ্রেমে বাঁধানো এক শিল্পীর আঁকা রম্যচিত্র হাতে ক্যাপ্টেন। অটোগ্রাফ করাচ্ছেন সহকর্মীদের ওই ছবিটির ওপর। কারণ ছবির বিষয়-কাপ হাতে তিনি। কপিলের বাড়ির দোলনায় কীর্তি আজাদ তখন মৃদু দুলছেন আর স্মিত হাসছেন। '৮৩র দলে না থাকলেও অজয় জাদেজাও উপস্থিত হাসিমুখে। এবার শেষের শুরু। বিদায় নেওয়ার পালা। 'হোস্ট' যেন তাঁর ব্যবহারে সবাইকে বলতে চাইছেন, এটা তোমাদের সব্বার বাড়ি, তোমাদের একসঙ্গে পেয়ে আমি পঁচিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া যুদ্ধজয়ের জন্য ধন্যবাদ দিতে চাই। আর মেহমানরা যেন বলে যাচ্ছেন,'হাম সাথ সাথ হ্যায়'। আগামীকাল কাকভোরে গোটা দল উড়ে যাবে হিথরো। সেখান থেকে লর্ডসের ব্যালকনিতে। ২৫ বছর পর, ২৫ জুন ২০০৮ আবার ওঁরা লর্ডসে। আবার ওই দলটা। ওটা কপিলের ইন্ডিয়া।
আমারও ঝাঁপ বন্ধ করার পালা। কপিলের সেক্রেটরি নাম-ধাম, কোন হোটেলে আছি, কীভাবে ভিডিও ফুটেজটা সংগ্রহ করবেন জেনে নিলেন। ক্যাপ্টেন এসে বললেন 'আপ ডিনার জরুর করকে যাইয়েগা।' আবদার করে বলে বসলাম- আপনার একটা 'বাইট' পেলে খুব ভাল হয়। রাজি হয়ে গেলেন। গেটের বাইরে অপেক্ষারত সহকর্মী দেবাশিস সেন-কে ডেকে আনা হল। সারা হল অনেক না বলা কথায় ভরা সাক্ষাৎকার। তারপর পার্টির হোস্টের তত্বাবধানে এক 'উমদা' ডিনার। 'হরিয়ানার হ্যারিকেন'-এর সৌজন্য আর আতিথেয়তার ঝড়ে উড়তে উড়তে তখন আমরা ভাসছি সাতওয়া আসমানে!
পরে অনেক ভেবেছি। স্পন্সরমুখী, বিপণনমুখী 'সব কুছ বিকতা হ্যায়'- মার্কা 'মেড ইন ইন্ডিয়া'-য় এই পার্টিটাও নিশ্চয় দারুণ একটা 'কমোডিটি' হতে পারত। কিন্তু হতে হতে দিলেন না কপিল দেব ও তাঁর কমরেডরা। কেন গোপনীয়তার মোড়কে আদরে মুড়ে রাখা হল এই সম্মেলন? আসলে ওঁরা হয়ত এখনও বিশ্বাস করেন, পৃথিবীতে এমন অনেক কিছু আছে যেগুলো সযত্নে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে হয়। 'দোস্তি' শব্দটারও একটা সুন্দর মানে পেলাম। আর দেখলাম, এই সব কিছুর নায়ক যিনি, তাঁর নায়ক হয়ে ওঠার নেপথ্যের মানুষগুলোর সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়া, সম্পর্ক। যার জোরে তিনি এই তথাকথিত প্রচারের লোভ সংবরণ করার শক্তি পেয়েছিলেন সেদিন। এটা করতে অদম্য দম লাগে। যে দম-এর নাম কপিল দেব নিখাঞ্জ। আমাদের পোড়া দেশে যার চওড়া হাসিতে অভয় পেয়ে আসমুদ্রহিমাচল এক স্বপ্ন দেখতে-দেখতে কখন যেন একটা খেলাকে ধর্মে পরিণত করে ফেলল।
আমরা যারা আশির দশকে বড় হয়েছি, তাদের মিডল স্ট্যাম্পে কপিল আর বাউন্ডারিতে সুনীল। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং, টেলিমিডিয়া, ঝিনচ্যাক জীবনযাত্রা থেকে 'মিলো দূর' থাকা আমাদের কৈশোরের ভারত। ফেলুদা,ডাকপিওন,চুইংগাম,কলিংবেল,ফুলন দেবী, দূরদর্শন, অল ইন্ডিয়া রেডিও ভরা আমাদের জীবনে '৮৩ ছিল চেটেপুটে, চুষে-চিবিয়ে খাওয়া একমাত্র তৃপ্তির নাম।
এসব শুনে আমার এক বিশ্বনিন্দুক বন্ধু ব্লল-'ধুস,সব নিউমারোলজি, বুঝলি? আসলে ৮ আর ৩ হল ১১। ভারতীয় ক্রিকেটে ১৯৮৩ আর ২০১১ বিশ্বকাপের বছর। শেষ দুটো সংখ্যা ১১। আর এবারও ১১। এবারও তাই হবে।'
আমি বললাম, ১ আর ৫ যোগ করলেও ১১ হয়? চ্যাংড়ামি হচ্ছে!
ও বলল - 'তোরা না পেশাদার অবিশ্বাসী! আরে এবার একে-পাঁচে ১১ নয়, এটা হল ১১ নম্বর বিশ্বকাপ। এবারেও মেন ইন ব্লু, টিম ইন্ডিয়া।'
শুনে ভাই বলল-'কিস্যু ফলো করো না! ট্যুইট-এ ক'জন ফলোয়ার তোমার? হ্যাসট্যাগ ওন্ট গিভ আপ (#won'tGiveUp) শোনোনি?' ভ্যাবলা মুখে ক্যাবলা হয়ে বসে গেলাম ডিজিট্যাল মার্কেটিং চোস্ত 'ট্যুইটার কিং' ভাইয়ের সামনে।
Sunday, July 3, 2022
কে বলে ক্যারিব্যাগ ছাড়া বাঁচা যায় না!
রাজ্য সরকার ৭৫ মাইক্রনের নিচে সমস্ত প্লাস্টিক ক্যারি ব্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞার বাস্তবায়নের অনেকটা নির্ভর করছে আমার আপনার ওপরে। পলিথিন ক্যারিব্যাগ ছাড়া একটা বাজার করতে যাওয়ার কল্পনা করুন। ততক্ষণ অন্য একটা বিষয় নিয়ে একটু কথা চলুক যেখানে এই ব্যানের বাইরে ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিক। যথেষ্ট ভাবে, যথেচ্ছ ভাবে। তা পড়েই থাকে আমাদের চোখের সামনে। আপাতভাবে দূষক বলে মনে হয় না তা। ফেস মাস্ক।
যে ডিস্পোসিবেল মাস্কগুলো সাধারণত আমি আপনি পরছি কিংবা মেডিকেল গ্রেড সার্জিকাল মাস্ক- সেগুলো সবই পলিপ্রোপিলিন প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি। যখন সেই প্লাস্টিক ছোট ছোট টুকরো হয়ে যায়, তখন এটি পচে যেতে বা ডিকম্পোজে হতে প্রায় ৪৫০ বছর সময় লাগতে পারে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য কাপড়ের মুখোশগুলো (reusable cloth face mask) আরও পরিবেশ বান্ধব বা ইকো ফ্রেন্ডলি।
ধরুন আপনি মর্নিং ওয়াক এ গিয়ে মাটিতে একটি মাস্ক দেখতে পেলেন। প্লাষ্টিক হলে হয়ত আপনি হাত দিয়ে সরিয়ে দেবেন কিন্তু খুব কম লোকই মাস্ক তা স্পর্শ করতে চাইবে। সবাই ভাববে যে কোনও সম্ভাব্য ভাইরাস-ভরা শ্বাসকে রক্ষা করেছে ওই মাস্কটি । তাই এটি উড়ে না যাওয়া পর্যন্ত সেখানেই পড়ে থাকে। রাস্তা ঘাট , মুদি দোকান, বাজার থেকে শুরু করে, পার্কিং স্পেস , নদী এবং সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে ল্যান্ডস্কেপকে দূষিত করে তুলছে ফেস মাস্ক।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ১.৫ বিলিয়নেরও বেশি ফেস মাস্ক ২০২০তে মহাসাগরে পড়েছে, যার ফলে অতিরিক্ত ৪৬৮০ থেকে ৬২৪০ মেট্রিক টন সামুদ্রিক প্লাস্টিক দূষণ হয়েছে। বিশ্বব্যাপী, প্রতি মাসে প্রায় ৬৫ বিলিয়ন গ্লাভস ব্যবহার করা হয়। ফেস মাস্কের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ - মাসে ১২৯ বিলিয়ন। অর্থাৎ প্রতি মিনিটে প্রায় ৩ মিলিয়ন ফেস মাস্কের ব্যবহার হচ্ছে। আর একটি সমীক্ষাতে বলছে প্রতিদিন ৩.৪ বিলিয়ন ফেস মাস্ক বা ফেস শিল্ড বাতিল করা হয়। এর মধ্যে এশিয়া প্রতিদিন ১.৮ বিলিয়ন মাস্ক নষ্ট করে। সারা বিশ্বের নিরিখে এই পরিমাণ যেকোনও মহাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশ্বের বৃহত্তম জনসংখ্যা (১.৪ বিলিয়ন) সহ চীন প্রতিদিন প্রায় ৭০২ মিলিয়ন ফেস মাস্ক বাতিল করে।
আমাদের রাজ্যে ৭৫ মাইক্রনের নিচে সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহারে আপাতত দোকানদারদের ওপর ৫০০ টাকার জরিমানা ধার্য করা হয়েছে। আর ক্রেতাদের জন্য জরিমানা ৫০টাকা। পিসিবি ১০২৬টি ক্যারিব্যাগ প্রস্তুতকারক সংস্থাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। পিসিবি, হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যাল এবং আইভিএল ধানসেরি পেট্রোকেমিক্যালকে নির্দেশ দিয়েছে যাতে পাতলা ক্যারিব্যাগ প্রস্তুতকারক সংস্থা গুলিকে প্লাস্টিকের দানা তারা বিক্রি না করে।
এবার শুরুর কথায় ফিরি। আপনার একটা সকাল। আপনার একটা বাজার করা প্লাস্টিক ক্যারি ব্যাগ ছাড়া ভাবতে পারেন কি?
আলবাত পারেন।
শাক সবজির জন্য বাড়ি থেকে কাপড়ের ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন।
মুদিখানার জন্যও আলাদা একটা ব্যাগ।
আর সবচেয়ে চিন্তা যেটা ভাবছেন সেই মাছ বা মাংসের জন্য ব্যবহার করতে পারেন টিফিন বক্স ।
কে বলে পলিথিন ক্যারিব্যাগ ছাড়া বাঁচা যায় না!
Saturday, March 19, 2022
আমার রঙরঙ খেলা লেখা | Holi Special Blog
বরাভূমের ‘বাহা সাঁদেশ’
এই লেখাটির জন্য অশেষ কৃতজ্ঞতা সপ্তর্ষি
বৈশ্যকে। লেখা পড়ার আগে দেখে নিন ভিডিওটা। চলুন একটু ঘুরে আসি আমার বেড়ে ওঠার সুন্দরী জেলাটায়।
প্রকাশিত লেখার লিঙ্ক
বিটের মূল, নিমের পাতা, আর
পলাশের ফুল। এইটুকুই সম্বল। সেই বিট, নিম আর পলাশের নির্যাস দিয়ে প্রথমবার ‘বাহা
সাঁদেশ’ আবির তৈরি করেছেন পুরুলিয়ার বিরহড় জনগোষ্ঠীর মহিলারা। সাঁওতালি ভাষায়
‘বাহা’ হল ফুলের উৎসব, আর ‘সাঁদেশ’ মানে খবর। এবারের দোলে ওঁদের এই আবিরের ৫০ কিলো
নিঃশেষিত হয়েছে প্যাকিং করার মাত্র ১৭ ঘণ্টা ৫৫ মিনিটের মধ্যে! ওঁদের স্বনির্ভরতার
লক্ষ্যে কাজ করেন যাঁরা, তাঁরাও হতবাক আবিরের এহেন জনপ্রিয়তায়। তাই আবার জোরকদমে
শুরু হয়েছে আবির তৈরির তোড়জোড়। ২০০ গ্রাম ৭০ টাকা আর ৪০০ গ্রামের প্যাকেট ১৪০
টাকা। পাওয়া যাচ্ছে পুরুলিয়া, বলরামপুর বাগমুণ্ডি, বালি, বেলুড়, উত্তরপাড়া
দক্ষিণেশ্বর আর উত্তর কলকাতার সমস্ত মেট্রো স্টেশন চত্বরে। আবির চেয়ে ফোন আসছে
কাটোয়া, বর্ধমান আর উত্তরবঙ্গ থেকেও।
পলাশ- পুরুলিয়ার প্রাইড |
বিট বেটে অযোধ্যা পাহাড়ের ঢালে শুকনো হচ্ছে রোদে |
সবজি বাজার থেকে বিট কিনে তা
কেটে, তারপর বেটে রোদে শুকিয়ে তৈরি হয়েছে বিটের আবির। জঙ্গলের নিম গাছে পাতা বেটে
নিমের বাহা সাঁদেশ। আর পুরুলিয়ার গর্ব পলাশ ফুল দিয়ে তৈরি হয়েছে পলাশের আবির। তবে
সেক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশিকা অক্ষরে-অক্ষরে মেনে একটাও পলাশ ফুল গাছ থেকে পাড়েননি
বিরহড় মহিলারা। গাছের তলায় ঝরে পড়া রক্তিমাভ পলাশ কুড়িয়ে এনে জলে সেদ্ধ করে
মিক্সার গ্রাইন্ডারে পিষে আবির তৈরি করেছেন ওঁরা। এই সব কাজের কারিগরি প্রশিক্ষণ ও
খুঁটিনাটি ওঁদের হাতে ধরে মহিলাদের শিখিয়েছেন ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত
প্রিয়াঙ্কা ভট্টাচার্য। তিনি বলছেন, “পিছিয়ে পড়া, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আবেগের
সুড়সুড়িকে মূলধন করে নয়, বরং গুণমানে বাজারের অন্যান্য ভেষজ আবিরের সমকক্ষ হয়েই
যাতে নিজের স্থান করে নেয় বাহা সাঁদেশ, সেটাই আমাদের লক্ষ্য ছিল”।
মৈত্রেয় ফাউন্ডেশনের সপ্তর্ষি বৈশ্য কলকাতার মানুষ হলেও ইদানিং
নিত্যযাত্রীর মতই তাঁর আনাগোনা বিরহড় ডেরা বেড়সা গ্রামে। তিনিই বলছিলেন, “বাহা
সাঁদেশ বিক্রি করে যে অর্থ উপার্জন হচ্ছে, তা জমা হচ্ছে ওই মহিলাদের
স্বনির্ভরগোষ্ঠীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। আর লাভের একটি অংশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে ওই
মহিলাদের ব্যবসার ভবিষ্যৎ মূলধন। যাতে ওঁরা পরবর্তীকালে এই ধরনের কাজ করতে গিয়ে
কারও মুখাপেক্ষী না হন। এমনকী আমাদের সাহায্য ছাড়াও ওঁরা যাতে প্রকৃত পক্ষেই
স্বনির্ভর হতে পারেন। এটাই এখন আমাদের মূল উদ্দেশ্য।"
জলে ফুল সিদ্ধ করার পর ছাঁকা হচ্ছে পলাশ ফুলের নির্যাস |
বসন্ত ঋতুরাজ। সে তার সেরা সম্ভার হেলায় পথে ছড়িয়ে বীর সন্ন্যাসীর
মতো হেঁটে চলে যায় নীল দিগন্তে। অযোধ্যা পাহাড়ের ঢালে সদ্য নির্মিত নীলরঙের কিছু বাড়িতে
এখন প্রান্তিক, আদিম এই বিরহড়দের ডেরা। এবারের বসন্তে ঝরে পড়া অরণ্যের সম্পদ ফুল পাতা
দিয়ে বসন্তের রঙ বানিয়ে ওঁরা হাজির আমার আপনার সঙ্গে রঙমিলান্তির খেলাতে। ওঁদের তৈরি
এই রঙ যেন আমাদের মর্মে, কর্মে আর যাওয়ার পথে এগিয়ে যেতে লাগে! তাই কি ফুল ফুটিয়েছে
পুরুলিয়ার পাহাড়তলির পলাশবন?
এবার দেখুন ভিডিও যেটা প্রকাশিত হয়েছে টিভি নাইন বাংলা ডিজিট্যালে
পোয়াবারো- ঘি
পোয়া
ফেসবুকের গ্রুপ
কলকাতার নকশি কথা দারুণ। এই গ্রুপের মেম্বারদের অনেকেই কলকাতা ও তার আশেপাশের অনেক
বিষয় নিয়ে পোস্ট দিয়ে থাকেন। তাই এই লেখার জন্য তাঁদের জানাই কৃতজ্ঞতা।
প্রকাশিত লেখাটির
লিঙ্ক
দোল রঙের উৎসব, মিষ্টিরও। মঠ,
বাতাসা, লাড্ডু, সন্দেশ, নাড়ু, খাজা, গজা, জিলিপি, পায়েস, পেঁড়া, ছানা, দই,
ঠাণ্ডাইয়ে মাখামাখি হয়ে বসন্ত যখন জাগ্রত হয় প্রতিবার, তখন ভিড় জমে বৌবাজারের এই
ছোট্ট দু’টি দোকানে। ‘শ্রীহরি’ আর ‘রাধারানী সুইটস’। যেন রাধামাধব আর বৃন্দাবন
বিলাসিনী রাইয়ের যুগলবন্দি। দোল থেকে পঞ্চম দোল—প্রতিবছর মানুষের ঢল নামে দোকান
দু’টোয়। হোলির সময়ে এক বিশেষ মিষ্টি পাওয়া যায় এখানে। শতবর্ষ পার হয়ে গিয়েছে, তবুও
একই রকম জনপ্রিয়তা এই দোকানের এই বিশেষ মিষ্টির। নাম ‘ঘি পোয়া’। প্রতি পিসের দাম
মাত্র ৬টাকা। চেনা শহরের অচেনা এই মিষ্টির খোঁজ দিচ্ছে TV9 বাংলা। চেনা শহর
কল্লোলিনী কলকাতার অচেনা এই মিষ্টি দেখতে হুবহু আলুর চপের মতো। ভাজা হয় খাঁটি গব্য
ঘিয়ে।
বৌবাজার, নতুনবাজার, বেহালা আর উত্তর কলকাতার তামাম বনেদি বাড়িতে এই
মিষ্টি ছাড়া দোল অচল। কলকাতার বনেদি বাড়িগুলিতে দোল গোবিন্দের আরাধনায় ভোগ নিবেদন
হয় ঘি পোয়া দিয়ে। দোল থেকে পঞ্চম দোল ঘি পোয়া ছাড়া প্রসাদ নাকি মুখে রোচে না বনেদি
বাড়ির ননীচোরার। তাই সারা শহরে উত্তর থেকে দক্ষিণ যত প্রাচীন বাঙালি বাড়ি আছে,
তাঁদের কাছে দোলের এক ঐতিহ্যের সমার্থক হয়ে উঠেছে এই ঘি পোয়া। রজত পাইন বৌবাজারে
থাকেন। তিনিই বলছিলেন ঘি পোয়ার এই ট্রাডিশানাল ক্রেজের কথা। দেবমাল্য শীল প্রতিবছর
এই মিষ্টির টানে ফিরে-ফিরে আসেন এই দোকানে। দোলের চাঁচড়ের পুজোয় সঞ্জীবকুমার
মল্লিকের বাড়িতে পুজো হয়। তার জন্য দু’দিন আগেই তিনি এসে বায়না করে গিয়েছেন ১৫০
পিস ঘি পোয়া, জানালেন শ্রীহরি সুইটসের মালিক কৃষ্ণ গুপ্তা। দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে
তিনি অনবরত গাওয়া ঘিয়ে ভেজে চলেছেন এই ঘি পোয়া। হালুইকরদেরও ফুরসত নেই। জানালেন
তিন প্রজন্ম ধরে চলে-আসা এই ঘি পোয়ার রেসিপি। চালের গুঁড়ো, সুজি, গুড় আর ঘি দিয়ে
মেখে মণ্ড তৈরি করা হয়। তারপর হাতের তালুর চাপে চ্যাপ্টা করে গরম ঘিয়ে ভাজা হয় সেই
মণ্ডের পোয়া।
কলকাতার বাঙালি বনেদি বাড়িতে
দোলে গোপাল সেবায় মাস্ট এই মিষ্টি। আর লাগে মালপোয়া। শ্রীহরি সুইটসের পাশের দোকান
রাধারানী সুইটসের নরেশ গুপ্তা বলছিলেন ঘি পোয়ার যোগ নাকি ওড়িশায়। শ্রীক্ষেত্র
জগন্নাথধামে ছাপান্ন ভোগের এক ভোগ এই ঘি পোয়া। জগন্নাথের উৎকল থেকে এই খাদ্য
সংস্কৃতির আগমন এই বাংলায়। তা-ও শতাব্দীকাল আগে।
পূর্ণিমায় দোল গোবিন্দর ভোগের জন্যই এই মিষ্টির চাহিদা এখন তুঙ্গে।
আপনিও যদি চান, চেখে দেখতে চলে আসুন বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রীটের বৌবাজার
মার্কেটের সামনের এই দোকান দু’টোয়। গরমাগরম ঘি পোয়া প্রতি পিস মাত্র ৬ টাকা। মুখে
দিয়েই বৃন্দাবনের বিলাস। তবে সাবধান, এটা খাবার পর ঠাণ্ডা পানীয় খাবেন না। গরম চা
কফি চলতে পারে। খাঁটি ঘিয়ে তৈরি তো, তাই ঠাণ্ডা খেলে বিপত্তি ঘটতেই পারে!
ঘুম-ON
এই ত্রয়ীর অন্তিম
লেখা ওয়ার্ল্ড স্লিপ ডে বা বিশ্ব নিদ্রা দিবস নিয়ে। যাঁদের ঘুম নিয়ে সমস্যা তাঁদের
কাজে লাগতে পারে এই লেখাটা। কৃতজ্ঞতা জানাই
সেলিমপুরের সোমনস স্লিপ ক্লিনিকের ডাঃ সৌরভ দাসকে আর অরেঞ্জ স্লিপ অ্যাপনিয়া ক্লিনিকের
ডাঃ উত্তম আগরওয়ালকে।
প্রকাশিত লেখার লিঙ্ক
https://tv9bangla.com/health/important-facts-about-sleep-you-need-to-know-529981.html
আজ বিশ্ব ঘুম দিবস। ঘুম হেলাফেলার বিষয় নয়। সারা দুনিয়া জুড়ে চিকিৎসকরা
বলছেন ঘুম সম্বন্ধে সচেতন হতে। আর সেই কারণেই ওয়ার্ল্ড স্লিপ সোসাইটি বলছে ঘুমের গুণগত
মান ভাল হলে মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটে যা তৈরি করে একটা সুন্দর পৃথিবী। আমাদের প্রতিদিনের
কাজে আমরা সম্মুখীন হই বহু ঘটনার। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলি রয়ে যায় স্মৃতিতে।
এই স্মৃতিশক্তি তৈরিতে ঘুমের ভূমিকা অপরিহার্য। সুস্থ ভাবে বাঁচার জন্য সুন্দর ভাবে
ঘুমনোটা জরুরী। কিন্তু কেমন ভাবে আসবে সুখের সেই সুস্থ ঘুম? কিন্তু কেমন ভাবে আসবে
সুখের সেই সুস্থ ঘুম?
কলকাতার দুজন চিকিৎসক ডাঃ সৌরভ
দাস এবং ডাঃ উত্তম আগরওয়াল আমাদের জানালেন কী কী করলে আসবে SOUND SLEEP
শোওয়ার ঘরটিকে করুন যতটা সম্ভব নিঃশব্দ ও অন্ধকার ঘুমোতে যাওয়ার আগে
ফোন সাইলেন্ট বা এয়ারপ্লেন মোডে রাখুন বিছানার চাদরটাকে টানটান ও পরিষ্কার করে নিন
ঘুমের আগে অল্প উষ্ণ গরম জলে স্নান করলে ভাল ঘুম আসে সন্ধ্যের পর চা, কফি বা নরম
পানীয় খাবেন না, ধূমপান একদমই নয়। এই নিয়ম মানতে পারলে ভাল ঘুম আসবেই । পরের দিনের
করণীয় কাজের তালিকা কাগজে লিখে রাখুন আর সেই দিন কী করলেন তাও লিখুন ঘুমোতে যাওয়ার
আগে। দেখবেন চিন্তা মুক্ত ঘুম আসবে । রাত্রের দিকে কম জল খাওয়া অভ্যাস করুন। দিনে
বেশি জল খান। ডিনারের পর অল্প অল্প সিপ করে জল খান ঘুমোতে যাওয়ার আগে টয়লেট করে
শুলে রাত্রে অযথা ঘুম ভাঙবে না বেডরুমে ঘড়ি এমন ভাবে রাখুন যাতে বিছানায় শুয়ে ঘড়ি
দেখা যাবে না। তাই ঘড়ি দেখে ঘুম না আসার অস্থিরতাও থাকবে না। এতে করে ঘুমের ব্যাঘাত
ঘটবে না।
চিকিৎসকরা বলছেন অনিদ্রা বা অতিনিদ্রা দুটোই শরীর খারাপ হওয়ার কারণ
হতে পারে।
তাই জেনে নিন কতটা ঘুমনো উচিত একজন সুস্থ মানুষের। কমপক্ষে কতটা ঘুম
দরকার কোন বয়সের মানুষের –
সদ্যজাতদের জন্য- ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা প্রাইমারি ক্লাসে পড়ুয়াদের জন্য –
১০ থেকে ১২ ঘণ্টা সেকেন্ডারি ক্লাসের পড়ুয়াদের জন্য – ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা প্রাপ্ত
বয়স্কদের ৭-৯ ঘণ্টা
অনেকে ভোরে ট্রেন বা ফ্লাইট ধবার চিন্তায় সারারাত ঘুমোতে পারেন না।
সেক্ষেত্রে কীভাবে অ্যালার্ম দিলে ভাল ঘুম হয় ?
ডাক্তারবাবুরা বলছেন এক্ষেত্রে যদি ভোর ৫ টায় উঠতে হয় তাহলে অ্যালার্ম
দিন আগের দিন বিকেল ৫ টায়। আর তারপর সব কাজ রাত ৮টার মধ্যে মিটিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে
যান ।
যারা রাতের শিফটে কাজ করেন তাঁদের ঘুমোতে হবে সকালে। আর সেই ঘুমটাকেও
দিতে সমান গুরুত্ব। ভারি পর্দা ঝুলিয়ে রেখে ঘরটাকে অন্ধকার রাখতে হবে । ঘুমোতে
যাবার এক ঘণ্টা আগে থেকে চলবে না সেলফোন বা অন্য কোনও ডিভাইজ ব্যবহার করা।
বাঙালি নাকি ঘুমকাতুরে! তার নাকের ডাকে নাকি কাক চিল বসে না বাড়িতে।
সারা বাংলা জুড়ে একটা সমীক্ষা চালিয়ে ডাঃ সৌরভ দাস জানাচ্ছেন সামগ্রিকভাবে বাঙালির
ঘুমের মান কেমন? আর সেই সমীক্ষার ফল হতাশ হবার জন্য যথেষ্ট। ডাঃ দাস বলছেন
সামগ্রিক ভাবে বাঙালির ঘুমের মান খুবই খারাপ। আর ষাটোর্ধদের ক্ষেত্রে সেটা আরও
খারাপ হয়ে সংকটজনক অবস্থায় এখন।
এই মুহুতের পৃথিবীতে ৮০ টিরও বেশি স্লিপ ডিজঅর্ডারের খোঁজ দিয়েছে
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান। যার মধ্যে সংগীত শিল্পী বাপ্পি লাহিড়ী র অকাল প্রয়াণের
কারণে সচেতনতা এসেছে স্লিপ অ্যাপনিয়ার ক্ষেত্রে । বাপ্পির মৃত্যুর পর থেকে ভিড়
বাড়ছে শহরের স্লিপ ক্লিনিক গুলোয়। কোথাও হয়ত দেরিতে হলেও হয়ত আসছে সচেতনতা । আর এই
সচেতনতাটা সারা বছর জারি রাখতেই আজকের এই বিশ্ব নিদ্রা দিবস । তাই কোনও কারণে ঘুমে
ব্যাঘাত ঘটলেই ডাক্তারবাবুর কাছে যান। গুরুত্ব দিন ঘুমকে । শুধু আজ নয় আজীবন।
Disclaimer: এই প্রতিবেদনটি শুধুমাত্র তথ্যের জন্য, কোনও ওষুধ বা
চিকিৎসা সংক্রান্ত নয়। বিস্তারিত তথ্যের জন্য আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
এবার দেখুন ভিডিও যেটা প্রকাশিত হয়েছে টিভি নাইন বাংলা ডিজিট্যালে