Thursday, March 20, 2025

মৃত্যুকে আবার আগাম দেখা যায় নাকি!



লাইফ আফটার ডেথ আমাদের খুব প্রিয় চর্চার বিষয়। কিন্তু মৃত্যু? আজ সকালেই ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম - 

অন্য কারও মৃত্যুর অভিজ্ঞতা নিজে অনুভব করেছেন? গতকাল দুপুরবেলা, সব যেন নিজের চোখে দেখলাম! আর ঠিক তার পাঁচ মিনিটের মাথায়... 

এই পোস্টটা করতেই বহু মানুষ তাঁদের কনসার্ণ দেখিয়ে জানতে চেয়েছেন আমার কিছু হয়েছে কিনা। আসলে তেমন কিছু নয়। একটা বিরল, আগে অনুভব করিনি এমন অনুভূতি হল কাল। মৃত্যুর অনুভূতি! সেটাই বলছি! আমি ফেসবুক পোস্টটা করেছিলাম এটা জানতে এমনটা আর কারও সঙ্গে হয়েছে কিনা। আমার বন্ধু তালিকায় এমন কেউ আছেন কিনা। মোদ্দা কথা বিষয়টা স্বাভাবিক কিনা। দেখলাম প্রায় ১৫৯৭জন পোস্টটা দেখেছেন। তাঁদের মধ্যে ১জন মাত্র এরকম ঘটনা বা অনুভুতির সম্মুখীন হয়েছেন। শ্রী সম্রাট মৌলিক, বিখ্যাত রিভার সাইক্লিস্ট ও লেখক। সম্রাট লিখছেন তিনি বহুবার এমন ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন। 

গতকাল দুপুরে একটা কাজে মোটরসাইকেলে চন্দননগর যাচ্ছি। বেলা সাড়ে ৩টে হবে। ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ। বম্বে রোড যেখানে দিল্লি রোডের সঙ্গে মিট করে ওই জায়গাটা ক্রস করছি। পাস দিয়ে একটা বড় লরি তীব্র গতিতে ওভারটেক করল। গরমের দুপুরে তার চলে যাওয়া দ্রুতগামী চাকা শব্দ করছে চটচটচটচটচট। আমার বাইকটা একই স্পিড আর একই গিয়ারে থাকায় ঘুঘুর মত কুরররররররর করে একটা আওয়াজ তুলে চলেছে। হঠাৎ মাথায় এল কিছু প্রশ্ন। 

এখন যদি ওই চলে যাওয়া ট্রাকটা আমার ওপর দিয়ে চলে যে? তারপর, কোন শেষ অডিও নিয়ে এই সুন্দর পৃথিবী ছাড়তাম? ট্রাকের চলে যাওয়া চটচটচটচটচট! তারপর আবার একটা প্রশ্ন পায়ের ওপর দিয়ে নাকি পেটের ওপর দিয়ে চাকা চলে যেত? বিশ্বাস করুন এই ৩টে প্রশ্ন মাথায় আসতেই এক ধাক্কায় বাইকের স্পীড ২০ কিলোমিটার নামিয়ে আরও সতর্ক হয়ে থ্রটল করতে লাগলাম। ততক্ষণে দিল্লি রোডের কানেক্টর পার করেছি। আর কিছুটা গেলেই ফ্লাই ওভারের নীচ দিয়ে ইউ টার্ন করে কোন্নগরের দিকের রাস্তাটা ধরব। এমন সময় দেখলাম রোড ব্লক। পুলিশ কর্ডন করে রাস্তা বন্ধ করেছে। জ্যামটা পাস কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। পুলিশ হাঁহাঁ করে এগিয়ে এল। 

কী হয়েছে? 

একজন সিভিক ভলান্টিয়ার বললেন - "ওই দেখুন!" বাঁদিকে তাকালাম। একটা ট্রেইলার ট্রাক, তার চাকার তলা দিয়ে দুটো পা দেখা যাচ্ছে। 

উনি আবার বললেন- "বিচ্ছিরি অবস্থা পা আর পেটের ওপর দিয়ে চাকা চলে গেছে।" 

উল্টো দিক থেকে তখন তীর বেগে পুলিশের একটা অ্যাম্বুলেন্স আসছে। ওটা ঘটনাস্থলে পৌঁছোতেই রোড ব্লক উঠে গেল। আমিও এগোলাম। 

মাথাটা ঝাঁ করে উঠল। এইরে এই দৃশ্যই তো জাস্ট পাঁচ মিনিট আগে যেন দেখলাম। এটা কী হল? এটা কী করে হল? এরকম আবার হয় নাকি! এটা কী দেজা ভু deja vu? 

আমি কৃতজ্ঞ সেই সব বন্ধুদের কাছে যারা আজ আমার সামান্য একটা পোস্টে উদ্বিগ্ন হয়েছেন। আমি তাঁদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।  

   

Friday, March 14, 2025

হাসি কান্নার দোল

দোলের সকাল। কেমন আর পাঁচটা দিনের সকালের মতো। কাল ন্যাড়া পোড়া হয়েছে, মেয়ের বন্ধুদের খুব মজা হয়েছে। ওরা ন্যাড়া পোড়ার আগুনে পোড়ানো আলু খেয়েছে কাল। 



মানুষ আজকাল বড্ড কন্ট্রোলড লাইফ লিড করতে অভ্যস্ত। কেবল বড়রাই না ছোটরাও! জল রঙে অ্যালার্জি। আবিরে কেমিক্যাল শুনেই ওরাও বড় হচ্ছে। আমাদের ছেলেবেলা অন্যরকম ছিল। হাতের রং থাকত প্রায় ১ সপ্তাহ। দোলের এক সপ্তাহ আগে থেকে ঢোল, নাল, খঞ্জনি নিয়ে গান হতো। মনন দা বলে এক বিহারী দাদা ছিলেন গানের দলের পাণ্ডা। শিব মন্দির সংলগ্ন চাতালে গান হতো, প্রতি সন্ধ্যেয়। আমি তবলা বাজাতে পারতাম বলে গানের দলে ডাক পড়ত, নাল বাজাতে। একদিন খোলও বাজিয়েছিলাম। কি আনন্দ! কি মজা! 

এই সেদিন প্রবীণ অভিনেতা সুমন্ত্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে এসব স্মৃতির ভাঁড়ার খুলে গেল। আসলে দোলের দিনে যখন রঙের ফোয়ারা ছোটে, আবির, গুলাল ওড়ে তখন স্মৃতিরা ভিড় করে আসে। আমদের ছোট্ট রেল কলোনিতে একজন আসতেন। খাসির মাংস বিক্রেতা। এক হাতে একটা ব্যাগ আর একটা সাদা কাগজ কলম, অন্য হাতে দড়ি বাঁধা একটা ছাগল। বাড়ি বাড়ি ঘুরে কে কত মাংস নেবেন তার লিস্ট করতেন। লিস্টের মাংসের ওজন খাসির ওজনের কাছাকাছি এলেই একটা গাছের তলায় খাসি কাটা হতো। সে কি মজার বিষয়! সুমন্ত্রবাবুও বলছিলেন তাঁর যৌবনের স্মৃতি। বিহারী ফাগুয়ার গান হতো তাঁর বাড়ির চত্বরে। এখন সে সব দিন ম্রিয়মাণ হতে হতে হারিয়ে গেছে। সব সেলিব্রেশন ডিজিটাল মাধ্যমে সারা! তবে স্টার জলসার কথা সিরিয়ালের দোলের শুটিংয়ে সেই পুরনো পাড়া কালচারের ফিল পেলাম। 


অথচ আমাদের এই কলকাতা শহরেই এখনও কিছু অঞ্চলে কিছু মানুষ আগলে রেখেছেন কিছু পরম্পরা। যেমন আপনি যদি উত্তর কলকাতার দিকে কলেজ স্ট্রিট, বৌবাজার অঞ্চলে যান এই দোলের সময়ে পাবেন এক বিশেষ মিষ্টি, ঘি পোয়া। চাল গুঁড়ো, গুড় আর আরও সব উপাদান দিয়ে মণ্ড মেখে তা  ঘিয়ে ভাজা হয়। এই মিষ্টি ছাড়া দোল আর পঞ্চম দোল ভাবা যায় না ওই অঞ্চলে। 



এইরকমই এক অতীত পরম্পরার খোঁজ পেলাম রাজস্থানের জয়পুরে। 

গুলাল গোটা। লাক্ষার ফোলানো বলের ভিতরে আবির বা গুলাল দিয়ে বানানো হয়। রাজস্থান ঘোরা থাকলেও হোলির এই কালচার জানেন না অনেকেই। প্রথমে গালা বা লাক্ষার মণ্ড আগুনের তাপে গলানো হয়। তারপর ওই গলে যাওয়া মণ্ড একটি ছোট্ট পাইপের মতো ফাঁপা কাঠির আগায় লাগানো হয়। ওই পাইপকে বলা হয় ফুকনি। মুখ দিয়ে ফুকনিতে হাওয়া ভরে ফোলানো হয় গুলাল গোটা। সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডা জলের গামলাতে ভাসিয়ে দেওয়া হয় গোটা। যাতে তা ঠাণ্ডায় শক্ত হয়ে ওঠে। যে রঙের গোটা সেই রঙের আবির বা গুলাল ভরে কাগজ ও আঠা দিয়ে সিল করে দেওয়া হয় গোটা। প্রায় ২৯৮ বছর ধরে জয়পুরের রাজ পরিবারের আনুকুল্যে মণিহারো কা রাস্তায় হাতে গোনা কিছু মুসলিম পরিবার তৈরি করে চলেছেন এই গুলাল গোটা।       



ভারতের গোলাপি শহর, রাজস্থানের জয়পুরের নাম মহারাজা সোয়াই জয় সিংহের নামে। মাত্র ১১ বছর বয়সে পিতা মহারাজা বিষণ সিংহের মৃত্যুর পরে সিংহাসনে বসেন জয় সিংহ। ১৭২৭ সালে রাজস্থানের রাজধানী আমের থেকে জয়পুরে স্থানান্তরিত করেন তিনি। জলের প্রাচুর্য আর পরিকল্পিত শহর তৈরি এই দুই বিষয় মাথায় রেখে গড়ে ওঠে জয়পুর। ভারতের প্রথম পরিকল্পিত শহর। এই শহরের নামের সঙ্গে অমর হয়ে আছেন এক বঙ্গ সন্তান, এক বাঙালি বাস্তুকার। তিনি নৈহাটির বিদ্যাধর ভট্টাচার্য। জয়পুর শহরের নির্মাণের দায়িত্বভার তাঁর হাতেই দেন মহারাজা সোয়াই জয় সিংহ। শিল্পশাস্ত্র ও বাস্তুশাস্ত্রের নিপুন মিশেলে বিদ্যাধর ভট্টাচার্য তৈরি করেন অতীত ভারতের অন্যতম প্ল্যানড সিটি জয়পুর।  

লেখাটা শুরু করেছিলাম এক অভিনেতার কথা দিয়ে শেষ করি আর এক অভিনেতার কথায়। গৌরব। গৌরব রায় চৌধুরী। প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন, এমন সময়ে হারালেন বাবাকে! তার আগের দিন গৌরব তাঁর বাবাকে বলেছিলেন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন ফুল বডি চেক আপ করাতে। আর সেই চেক আপ হল না। বাবা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। 



যেমন আমার বন্ধু অয়নের বুকের ভিতরটা আজ হুহু করছে বাবা বিনা এবারের দোলে। আসলে রং আমাদের আসল চেহারাটা ঢেকে দেয়। হাসি গুলোর সঙ্গে রঙের গড়িয়ে পড়া রঙের ধারায় কান্না বা অশ্রু বিন্দু কখন মিশে যায়, কে জানে! বুকে ফাগুনের হাহাকার, মুখে রঙের প্রলেপ থাকে। ভাগ্যিস থাকে। নইলে বেআবরু হয়ে অশ্রুধারা দেখে ফেলত কেউ। ভালো থেকো গৌরব, ভালো থাকিস অয়ন। চলতে হয়, বাঁচবার জন্য চলতে হয়, বসন্তে যেমন একটা শিমুল বা পলাশ ফুলের গাছ তার সেরা পজেশনটাকে হেলায় মাটিতে ফেলে এগিয়ে চলে নতুন দিনের, নতুন বছরের দিকে তেমন ভাবেই চলতে হয়। সব্বাই ভালো থাকবেন। রঙের উৎসবে রঙিন হয়ে। পশু পাখি আর অনিচ্ছুক মানুষজনকে বাদ দিয়ে তাদের রেয়াত করে দোলে দুলে উঠুন। 

Saturday, March 1, 2025

বয়স শঙ্কা নয় এনার কাছে বয়স সংখ্যা মাত্র

বার্ধক্যের অনেক সমস্যা। পদে পদে ভয়। তাই অনেকেই ভাবেন বয়স একটি শঙ্কা। আবার অনেকে ভাবেন বয়স স্রেফ একটি সংখ্যা। যারা বার্ধক্য কিংবা বয়সের তোয়াক্কা না করে নিজের কাজ করে চলেন তেমনই এক অশীতিপর গুণীজনের গল্প আজ । 



ভারতে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান, এবং তাঁদের জীবনধারণের মান বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার ৮.৬% ছিল ৬০ বছরের বেশি বয়সী, যেখানে মহিলাদের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত বেশি। বয়স্কদের জীবনধারণের মান তাঁদের আর্থিক অবস্থা, পারিবারিক সহায়তা এবং স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে। ভারতে ১৮.৭% বয়স্কদের কোনো আয়ের উৎস নেই, এবং এই অনুপাত ১৭টি রাজ্যে জাতীয় গড়ের চেয়েও বেশি। এছাড়া, ৪০% এরও বেশি বয়স্করা সবচেয়ে দরিদ্র শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত।


ভারতের সংবিধান বয়স্ক নাগরিকদের মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকার নিশ্চিত করেছে। ২০০৭ সালে প্রণীত 'দ্য মেনটেন্যান্স অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অব পেরেন্টস অ্যান্ড সিনিয়র সিটিজেনস অ্যাক্ট' অনুযায়ী, সন্তানরা তাঁদের বয়স্ক পিতামাতার দেখাশোনা করতে বাধ্য। এছাড়া, রাজ্য সরকারগুলোকে প্রত্যেক জেলায় কমপক্ষে ১৫০ শয্যাবিশিষ্ট বৃদ্ধাশ্রম স্থাপন করতে হবে। সার্বিকভাবে, ভারতে বয়স্কদের জীবনধারণের মান উন্নত করতে সরকারি উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও, আর্থ-সামাজিক বৈষম্য এবং স্বাস্থ্যসেবার অভাবের কারণে অনেক প্রবীণ নাগরিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন।


আমাদের দেশে ৮০ বছরের ওপরে বয়স্ক মানুষদের জীবনযাপন মূলত তাঁদের শারীরিক অবস্থা, পারিবারিক পরিবেশ ও আর্থিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। অনেক প্রবীণ মানুষ তাঁদের পরিবারের সন্তান সন্ততি-নাতি-নাতনির সঙ্গে সময় কাটান, নয়ত পূজা অর্চনা করেন, কেউ কেউ আধ্যাত্মিকতা, ধ্যান ও যোগে দিন কাটান। আর্থিক দিক থেকে পেনশন বা অবসরকালীন ভাতার ওপরে অনেকেই নির্ভরশীল। আবার অনেক মানুষ তাঁদের পরিবারে অন্যের ওপরে নির্ভরশীল হয়েই জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়ে দেন।


তাঁদের মধ্যে কারও শখ বই পড়া, রেডিও শোনা, পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ, বাগান করা, ধ্যান-যোগ চর্চা এবং মন্দির বা ধর্মস্থলে যাওয়া। কিছু প্রবীণ ব্যক্তি সমাজসেবামূলক কাজেও যুক্ত থাকেন, যেমন ছোটদের পড়ানো বা গরিবদের সহায়তা করা। মনোভাবের দিক থেকে অনেকে জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞ ও সন্তুষ্ট থাকেন, তবে কিছু মানুষ একাকিত্ব, অবহেলা বা শারীরিক অসুস্থতার কারণে মানসিক অবসাদেও ভুগতে থাকেন। পরিবারের সান্নিধ্য,সামাজিক স্বীকৃতি ও যত্ন তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। প্রযুক্তির প্রসারের কারণে কিছু প্রবীণ মানুষ স্মার্টফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারও শিখছেন, যা তাঁদের যোগাযোগ ও বিনোদনের নতুন মাধ্যম হয়ে উঠেছে। 


জয়ন্ত সাহা, একজন ফটোগ্রাফার। তবে ফটোগ্রাফি পেশা নয় জয়ন্তবাবুর। তাঁর ছবি প্রদর্শিত হয় বিভিন্ন সালোন আর প্রদর্শনীতে। বয়স বিরাশি হলেও এই বয়সে অন্যেরা যখন কাবু তখন তাঁর প্রবীণ আঙুল গুলি নিয়মিত ছুঁয়ে আসে ক্যামেরার শাটার বটন। পথে নেমে প্রতিদিন মুহূর্তদের ধরার ছায়াবাজি খেলেন এই অশীতিপর যুবক। কলকাতার রাস্তায় দিনে রাতে যে অফুরান প্রাণ তাকেই ধরার জন্যে হন্যে মাস্টার ফটোগ্রাফার জয়ন্ত সাহা।

বলেন "আমাদের সম্পর্কের পাঠ পড়ায় ইউনিভার্স।" তাঁর ফটোগ্রাফির বই OUR KOLKATA এই ভিডিওয়  জানুন তাঁর জীবনের গল্প, সঙ্গে কলকাতার অতীত থেকে বর্তমান ফটোগ্রাফি সংস্কৃতির এক চলমান ইতিহাস।  



আমি জয়ন্ত বাবুর সঙ্গে আড্ডা দিলাম কিছুদিন আগে। দেখুন সেই আড্ডার ভিডিও আমার ইউটিউব চ্যানেল Wonder World Bangla য়। লিঙ্ক নিচে দেওয়া রইল। 


 

Thursday, February 6, 2025

মশা মারতে কামান দাগা তো শুনেছেন, তা বলে বিড়াল বাঁচাতে কবাডি খেলা!

 

 

শা মারতে কামান দাগা তো শুনেছেন, তা বলে বিড়াল বাঁচাতে কবাডি খেলা!

 

সরস্বতী পুজো কেমন কাটল সবার? এই ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই পাখা চালাতে হচ্ছে। এখনই আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে গরমটা কেমন পড়তে চলেছে এই বছর! সেদিন একটা অনুষ্ঠানে অভিনেতা জিতু কামালের সঙ্গে কথা হচ্ছিল জিতু বলছিলেন আজকাল আমাদের এখানে শীত পড়ে না। সারা বছর গরম, বর্ষা আর অল্প গরম পড়ে। প্রসঙ্গ থেকে সরে যাচ্ছি। সরস্বতী পুজোতেও অন্য উৎসবের মতোই শব্দ দানবের তাণ্ডব চলল। হাওড়ার উলুবেড়িয়ার ভিডিও দেখে আতঙ্ক হচ্ছিল। তারস্বরে ডিজে চালিয়ে হাজার হাজার মানুষ নেচে চলেছে। এ কোন আমদানি করা সংস্কৃতি বুঝতে পারছি না। আমি যে পাড়ায় থাকি সেখানেও উদ্দাম ভয়াবহ সব গান চলল। গান পয়েন্টে ঘুমের দফারফা হল রাত আড়াইটে অবধি। বুঝি না প্রশাসন, পুলিশ কী করেন? সামনেই মাধ্যমিক পরীক্ষা। ছাত্রদের জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা। মাইক আর লাউড স্পিকারে নিয়ন্ত্রণ আনলে কি ভোট ব্যাঙ্কে চাপ পড়ত? বা ছাপ পড়ত? তাই কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমিয়ে গেলেন তাঁরা যাদের পাহারা দেওয়াটাই দস্তুর! উলুবেড়িয়ার উদ্দাম নাচের ছবি যখন ভাইরাল হচ্ছে তখনই সম্রাট, সায়ন, চিত্রক, কল্যাণী দিরা তুলে ধরলেন এক অন্য ছবি। উলুবেড়িয়া থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে ঘটল এমন এক ঘটনা যা ওই উদ্দাম, অর্থহীন, মগজহীনতার মুখে সজোরে একটা থাপ্পড় মারল।

 


পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র পর্ষদ, হাওড়া জেলা বন বিভাগ, জেলা পরিষদ, বিধায়ক আর হাওড়া জেলা যৌথ পরিবেশ মঞ্চ আমতার গাজীপুর পঞ্চানন সংঘে আয়োজন করল এক কবাডি প্রতিযোগিতা। না প্রো কবাড্ডি লিগের ম্যাচ না। ছিল না ততটা জৌলুসও। কিন্তু এই কবাডির গুরুত্ব অপরিসীম। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপ্রাণী মেছো বিড়ালের সম্পর্কে সচেতনতা প্রসারে মেয়েদের এই কবাডি টুর্নামেন্ট।

 


পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র পর্ষদের সিনিয়র অফিসার সৌমেন্দ্রনাথ ঘোষ , হাওড়া জেলা মুখ্য বন আধিকারিক দীপক কুমার মন্ডল,উলুবেড়িয়া রেঞ্জ অফিসার রাজেশ মুখার্জী , হাওড়া জেলা পরিষদের বন ও ভূমি কর্মাধ্যক্ষ মানস কুমার বসু, আমতা বিধানসভা কেন্দ্রের প্রাক্তন বিধায়ক অসিত মিত্র ,আমতা কেন্দ্রের বর্তমান বিধায়ক সুকান্ত পাল, হাওড়া জেলা যৌথ পরিবেশ মঞ্চ এর সভাপতি সৌরেন্দ্র শেখর বিশ্বাস ,সম্পাদিকা কল্যানী পালুই , কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেছোবিড়াল গবেষক সম্রাট চক্রবর্তী, সংসদ প্রতিনিধি তাপস বাকুলী, গাজীপুর গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান চন্দনা চোঙ্গদার ও আমতা থানার আধিকারিক সমাপ্তি রায় হাজির থেকে কবাডি খেলোয়াড়দের উৎসাহ দিলেন।

এখন আপনার মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে কী এই রাজ্য প্রাণী, মেছো বিড়াল? কেন এই বিড়াল রাজ্য প্রাণী? চলুন আজ আমরা জেনে নিই এই বিড়াল সম্বন্ধে। আমরা জানি বিড়াল সাধারণত জলকে ভয় পায়। কিন্তু জলই এই বিড়ালের বেঁচে থাকার অন্যতম শর্ত। বলা ভাল প্রধান শর্ত। এরা জলাভূমির বাস্তুতন্ত্রের শীর্ষ শিকারি। মেছো বিড়াল জলে ডুব দিয়ে তলা থেকে বড় বড় মাছ শিকার করে। দেড় বা দু কেজির মাছ তুলে আনা এদের কাছে নস্যি। এরা বিশ্বের একমাত্র বিড়াল প্রজাতি যারা জলের মধ্যে এভাবে শিকার করে। জলাজমি এদের বিচরণ ক্ষেত্র। জলা জমিতে শিল্প, জলা ভরাট বা জলাজমি নষ্ট হওয়ায় এরাও হয়ে পড়ছে বিপন্ন। এরা মাছ ছাড়াও কীট পতঙ্গ, ব্যাঙ ও সাপ খেয়ে পরোক্ষে চাষির উপকারই করে।

 


এদের বিজ্ঞান সম্মত নাম প্রিয়োনাইলুরাস ভাইভারিনাস। বাংলায় এদের অনেক নাম বাঘরোল, মাছবাঘা, গোবাঘা, মেছো বিড়াল। এদের আকার সাধারণ বিড়ালের থেকে অনেকটাই বড় হওয়ায় এদের অনেকেই বাঘ বলে ভুল করেন। বাঘরোল নাম জনপ্রিয় হবার কারনেও অনেকে এদের বাঘের সঙ্গে গুলিয়ে আতঙ্কিত হন। বলতে দ্বিধা নেই চাকরি করার সময়ে দেখেছি মেইন স্ট্রিম মিডিয়ার অনেক বড় বড় অভিজ্ঞ সাংবাদিকদেরও এদের সম্বন্ধে সম্যক ধারণা নেই। আর তার ফলেই এদের দেখা গেলেই টিভি চ্যানেল গুলোতে হালচাল পড়ে। হেডলাইন হয়, ব্রেকিং নিউজ হয়- ‘অজানা প্রাণীর আতঙ্ক’। এদের বেঁচে থাকা আরও বিপদ সংকুল হয়ে পড়ে সৌজন্যে ‘অশিক্ষিত’ গণমাধ্যম! এই ধরনের হেডলাইনের বিরুদ্ধে আমি আগেও বহুবার সরব হয়েছি। আবারও হলাম। মাননীয় নিউজ প্রোডিউসার আপনি জানেন না যখন কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপককে ফুটেজ দেখান, তিনিই আইডেন্টিফাই করে দেবেন প্রাণিটির নাম। নইলে সময় কম থাকলে গুগল লেন্সে ফেলুন। উত্তর পাবেন। আপনার অজ্ঞতা মানেই কোনও প্রাণী অজানা হতে পারে না।

 


যাই হোক মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে আসছি, আবেগপ্রবণ হয়ে। ফিরি ফিশিং ক্যাটের গল্পে। হ্যাঁ গল্পই তো। এদের সংখ্যা যেভাবে কমছে, এদের সম্বন্ধে না জানলে আগামিদিনে এদের স্থান হবে গল্পের পাতায়। তাই চিনুন এদের। এরা ধৈর্যশীল শিকারি। একটা মাছ শিকারের জন্য এরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা জলের ধারে বসে থাকে। আর এতেই এরা মানুষের রোষে পড়ে। অথচ এরা মানুষের প্রতি মোটেই আক্রমণাত্মক নয়। সংরক্ষণের নিরিখে এরা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সমকক্ষ অর্থাৎ IUCN লাল তালিকাভুক্ত। মানে অতি সংবেদনশীল বিপন্ন প্রজাতির। আমাদের রাজ্যের রাজ্যপ্রাণী এই বিড়াল। ফেব্রুয়ারি মাস এদের জন্য সচেতনতা প্রসারের উদ্দেশ্যে বিশ্ব জুড়ে পালিত হয়। কেননা ভারত ও বাংলাদেশ ছাড়াও এদের দেখা যায়, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিস্তৃত জলাভুমিতে। পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, আসাম, অন্ধ্রপ্রদেশে। আর আমাদের রাজ্যে এদের আবাস হাওড়া, হুগলী, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, পূর্ব মেদিনীপুরের জলাজমিতে। সম্প্রতি পুরুলিয়াতেও বাঘরোল দেখা গেছে বন বিভাগের ট্র্যাপ ক্যামেরায়। মাছে ভাতে বাঙালির রাজকীয় রোল মডেল বা রাজ্যপ্রাণী এরা ছাড়া আর কেই বা হতে পারে! এদের চিনুন এদের সম্বন্ধে সঠিক বিজ্ঞানসম্মত তথ্যই এদের বাঁচাতে পারে। মানুষের সঙ্গেই এরা এদের বাসস্থান ভাগাভাগি করে নেয় বলে অভয়ারণ্য বা স্যাঙ্কচুয়ারি করে এদের সংরক্ষণ প্রায় অসম্ভব। কথাটা আমি বলছি না, একসময়ে একটি প্রতিবেদন তৈরির সময়ে এই কথা আমাকে বলেন রাজ্যের প্রধান মুখ্য বনপাল, ওয়াইল্ড লাইফ, আইএফএস, শ্রী দেবল রায় মহাশয়।    

 

এদের সংখ্যা রোজ কমছে। দ্রুত কমছে। এদের মৃত্যুর কারণ রোড কিল ও মানুষের সঙ্গে সংঘাত। এই কবাডি প্রতিযোগিতার শেষে হাওড়া বন দফতরের তরফে আশ্বাস দেওয়া হয় রাস্তায় দেওয়া হবে সাইনেজ। যেসব জায়গা মেছো বিড়ালের পারাপারের করিডোর সেখানে বন দফতরের পক্ষ থেকে লাগানো হবে রোড সাইন।    

Wednesday, August 21, 2024

মশাও পৃথিবীর মঙ্গলের কাজে লাগে

কলকাতার চিকিৎসাশাস্ত্রের ইতিহাসে ২০শে অগস্ট দিনটি বিশেষ। ১৮৯৭ এর ২০শে অগাস্ট স্যার রোনাল্ড রস স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশার পৌষ্টিকতন্ত্রে ম্যালেরিয়ার জীবাণু আবিস্কার করেন। প্রথমবার প্রমাণিত হয় মানুষের ম্যালেরিয়া রোগের বাহক মশা। এই আবিস্কার চিকিৎসা  বিজ্ঞানে যুগান্তকারী। 
তৎকালীন প্রেসিডেন্সি জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক হিসাবে রোনাল্ড রস তখন কলকাতায়। এখানেই তিনি কাজ করেন ম্যালেরিয়া সম্পর্কে তাঁর যুগান্তকারী আবিস্কার নিয়ে। বর্তমানে সেই হাসপাতালকে আমরা এসএসকেএম হাসপাতাল নামে চিনি। 
পরিসংখ্যান বলছে প্রতি বছর প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এই কারণে মশা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাণঘাতী প্রাণী। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জি়কা'র মতো মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত পৃথিবীর প্রায় ১০০টি দেশ। 
বিজ্ঞানিরা বলেন প্রাণীদেহ থেকে নির্গত কার্বনডাই অক্সাইড,গন্ধ ও তাপমাত্রা মশাকে মানুষের প্রতি আকৃষ্ট করে। কেবল স্ত্রী মশাই প্রাণীদেহ থেকে রক্ত খেয়ে থাকে। আর এই রক্ত মশার বংশবিস্তারের জন্য ডিম তৈরিতে প্রোটিনের উৎস হিসেবে কাজে লাগে। পুরুষ মশারা মানুষকে কামড়ায় না,তারা উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে রস সংগ্রহ করে। 
আচ্ছা কখনও ভেবে দেখেছেন যে মশার কারণে আমাদের এত রোগভোগ এই পৃথিবীতে যদি সেই মশাই না থাকত তাহলে কেমন হত? কখনও  ভেবে দেখেছেন মশার কি কোনও উপকারিতা আছে? আসলে প্রকৃতির কোনও সৃষ্টিই হেলাফেলার নয়। প্রত্যেকের নিজস্ব কাজ আছে। মশার ও নির্দিষ্ট কাজ রয়েছে।
পৃথিবীতে ৩৫০০টি প্রজাতির মশা আছে তাদের মধ্যে প্রায় ৩৪০০ প্রজাতির মশা কোনো ক্ষতি করে না। মাত্র ৯০টির থেকে একটু বেশি সংখ্যক প্রজাতির মশা মানুষের জন্য বিপজ্জনক। বাকিরা কোনও অনিষ্ট করে না।

বরং তারা পৃথিবীর খাদ্য-শৃঙ্খলে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।  কিছু মাকড়সা, টিকটিকি, গিরগিটি, ব্যাঙের মুখ্য খাদ্য মশা। এছাড়া মশার ডিম মাছের খাবার। তাই মাছের খাদ্য চাহিদা মেটাতেও বিশেষ ভূমিকা রাখে মশা। যখন মশা উড়ন্ত অবস্থায় থাকে তখন ফড়িং,ছোট ছোট পাখি ও কীটপতঙ্গ মশা খেয়ে জীবনধারণ করে।
মশা একটি ইনডিকেটর স্পেসিজ। একটি বাস্তুতন্ত্রে মশা থাকা মানে সেখানকার পরিবেশের মাপকাঠিগুলি যেমন তাপমাত্রা,আর্দ্রতা ও জলের মান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়              
ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণায় জানা গেছে 'পুরুষ মশা ফুলের মধু খায়, যা পরাগ মিলনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। পৃথিবী থেকে যদি মশা  বিলুপ্ত হয়,তাহলে বহু খাদ্য-শৃঙ্খলের উপর তার সরাসরি প্রভাব পড়বে।’ আর একদল গবেষক বলছেন,মশার যায়গায় অন্য পতঙ্গ পরাগ মিলন করলেও   মশার প্রতিস্থাপক পতঙ্গটি মশার চেয়েও ভয়ঙ্কর এবং দ্রুতগতিতে রোগ বিস্তার করবে।’
মশা না থাকলে পাখির সংখ্যা ব্যাপক হারে কমবে। অনেক কীট-তাত্ত্বিকদের মতে, মশার কারণে গ্রীষ্মমন্ডলীয় জঙ্গল এলাকায় মানুষ বসবাস করতে পারে না। সেসব অঞ্চলে মশা না থাকলে মানুষ আরও অনেক বেশি গাছপালা কেটে বন উজাড় করে বসতি স্থাপন করত। অনেক বেশি পরিমাণ মশার বসবাস উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে। প্রতি বছর যে পরিমাণ পরিযায়ী পাখিরা এখানে আসে তাদের মূল খাদ্য হচ্ছে মশা। তাই যদি মশা-ই না থাকে, তাহলে প্রায় ৫০ শতাংশ পরিযায়ী পাখি আর দুই মেরুতে আসবে না। ফলে সেখানকার পরিবেশ বদলাতে শুরু করবে। তাছাড়া ভিনদেশ থেকেও বছরের নানা সময় লক্ষাধিক তৃণভোজী পশু এই অংশে মাইগ্রেট হয়ে থাকে। মশার কামড় থেকে বাঁচতে যে জায়গায় মশার ঝাঁক বেশি থাকে, সে জায়গা এড়িয়ে অন্য পথ বেছে নেয় এই তৃণভোজী প্রাণীরা। হঠাৎ যদি কোনো বছর এই মশার ঝাঁক না থাকে, তাহলে কোন দিকে যেতে হবে, তা তারা বুঝতে পারবে না। ফলে রাস্তা হারিয়ে গণহারে সবাই মারা যাবে। আর এরা এত সংখ্যায় তৃণভোজী মারা গেলে অন্যান্য মাংসাশী প্রাণীদের খাদ্য সংকট    হবে। তাছাড়াও এদের মলে থাকা বীজের কারণে যে গাছ জন্মায় তাও বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে।

এই বিষয়ের ওপরে আমার তৈরি একটি ভিডিও দেখুন। লিঙ্ক দিচ্ছি।

https://youtu.be/kWudaJV9_i4?si=RIuc1UDJuFAe4b_O


Tuesday, August 6, 2024

পরিচারিকা থেকে কলকাতার 'রাতের রাণী- মিস শেফালি' হয়ে ওঠার অবিশ্বাস্য কাহিনী



রাতের কলকাতা। এক রহস্যময়, আলো আঁধারে ঘেরা। আজ আপনাদের সামনে অতীত কলকাতার প্রথম ক্যাবারে কুইনের গল্প। অনেক প্রশ্ন আর রহস্যের মাঝে শেষ রাতের শিউলি ফুলের মতো ফুটে ছিলেন সেই নিশি সম্রাজ্ঞী। আজ মিস শেফালির গল্প। 

তখনও দেশভাগ হয়নি। বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে কলকাতার আহিরিটোলায় এসেছিলেন দাস পরিবার। সেই পরিবারের তৃতীয় সন্তান একটি মেয়ে। নাম আরতি দাস। বাবা অসুস্থ। কাজ করতে পারেন না। এদেশে আসবার সময়ে সামান্য যা কিছু সঞ্চয় ছিল তাও নিঃশেষিত হয়েছে। পরিবারের মুখে অন্নের যোগান তুলে দিতে আরতির মা গার্হস্থ সহায়কের কাজ নিলেন। বাড়িতে অনেকগুলো মুখ। রোজগার নিতান্তই কম! তাই কিশোরী আরতি বাধ্য হয়ে এক রকম জোর করেই চৌরঙ্গীর এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারে কাজের মেয়ে হিসাবে নিযুক্ত হল। আর সেখান থেকেই মোড় ঘুরে গেল আরতির। আরতি থেকে মিস শেফালি। কলকাতার প্রথম ক্যাবারে কুইন হয়ে ওঠার সেই উপাখ্যান আজ। 



মিস শেফালি একবার একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক অনির্বাণ চৌধুরীকে তাঁর উত্থানের গল্প বলেছিলেন। কী বলেছিলেন সেদিন ক্যাবারে কুইন? 

মিস শেফালি তাঁর জীবদ্দশায় সেই সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- 

'অনেক নদী, নালা, কাদা পেরিয়ে হিমালয় দেখেছি। বাবার কষ্ট, ভাইয়ের কান্না, দেখেছি। ১০ সাড়ে দশ বছর বয়সে আহিরিটোলার বানী নামের এক মহিলাকে জোরাজুরি করতাম কাজ দাও কাজ দাও। সে একটা কাজ দিল। মায়ের অনুমতি নিয়ে বাণী আমাকে এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বাড়িতে নিয়ে যায়। প্লেট ধোয়ার কাজ। সেখানে রোজ বিকেলে খানাপিনা ও নাচের আসর বসত।' 



দেখে দেখে সেই নাচের ঘোর লেগে যায় আরতির চোখে আরতির মনে। লুকিয়ে লুকিয়ে সে সব নাচ তুলতে থাকেন আরতি। তখন সে নিতান্তই বালিকা। ওই আসরে গান গাইতে আসতেন ভিভিয়েন হ্যানসাম। তখনকার কলকাতার পানশালার ডাকসাইটে গায়ক। আরতি ভিভিয়েনকে ধরেন একটা কোনও কাজের জন্য। ভিভিয়েন প্রশ্ন করেন নাচতে পার? আরতি তাঁর গোপনে দেখে নকল করা নাচ দেখান। পানশালায় নর্তকীর কাজ জুটিয়ে দেন ভিভিয়েন। 

ভিভিয়েন আরতিকে প্রথমে নিয়ে যান গ্র্যান্ড হোটেলে। তারপর গ্র্যান্ড থেকে বার করে ভিভিয়েন আরতিকে নিয়ে যান ফিরপোজে। আরতির নাচ পছন্দ হয় ফিরপোজের ম্যানেজারের। কিন্তু ম্যানেজার বলেন এই নাম চলবে না। ভিভিয়েন বলেন আজ থেকে তোমার নাম আরতি দাস নয় । আজ থেকে তোমার নাম শেফালি। তোমার বেতন ৭০০ টাকা। আরতি জিজ্ঞেস করেন 'আবার বলুন কত বেতন!' নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না উদ্বাস্তু পরিবারের সেই অভাবী মেয়েটা। 

তবে প্রথম দিনের পরিধেয় পোশাক দেখে কেঁদে ফেলেন সদ্য আরতি থেকে মিস শেফালী হওয়া সেই কিশোরী। সেই পোশাকে যে শরীরের অনেকটাই হয়ে পড়ছিল উন্মুক্ত। বেআব্রু। তবে বল রুমে প্রথম নাচের আসরেই মাতিয়ে দেন তিনি। প্রশংসা আর হাততালিতে ফেটে পড়ে নিশি আসর। 

ফিরপোজও যেন চাইছিল ক্যাবারের নতুন রানীকে গড়ে পিঠে তৈরি করে নিতে। তারাই আরতিকে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় কথাবলা শেখায়। নাচের বিভিন্ন রকমের তালিম দেয়। সেই সময়কার পার্ক স্ট্রীট অন্যরকম। ব্রিটিশরা তখনও শহরে। আরতি সেই সাক্ষাৎকারেই বলেন "লুকিয়ে চুরিয়ে স্ট্রিপটিজ হতো পার্ক স্ট্রিটের পানশালা আর নিশিনিলয়গুলিতে"। যদিও তাঁর কাছে এমন প্রস্তাব কখনও আসেনি। তখন তিনি খ্যাতির শিখরে উঠছেন। তাঁর এক ঝলক পেতে শহরের সন্ধ্যাগুলো উদ্বেল। 'তোমাকে ভালবাসি , তোমাকে ছাড়া বাঁচব না, তোমাকে বিয়ে করতে চাই'। এমন প্রস্তাব আসত অহরহ। তিনি জানতেন এসব যৌবনের ঘোর। এ ঘোর চিরস্থায়ী নয়। তাই ওসব খুব একটা পাত্তা দিতেন না। 



সেই সময়ে কিছুদিন ধরে কেউ একটা ফোন করছিল। শেফালি ভেবেছিলেন তাঁর বহু অনুরাগীর মধ্যে কেউ বুঝি ফোন করছেন। শেষমেশ বাধ্য হয়েই একদিন ফোন ধরলেন শেফালি। ফোনটা ধরতে ফোনের ওপার থেকে শোনা গেল, "তুমি হয়ত আমার নাম শুনলেও শুনতে পার আমি সত্যজিৎ রায় বলছি। আমার তোমাকে চাই"। ২০ সার্কাস অ্যাভেনিউ থেকে গেলেন বিশপ লেফ্রয় রোড। সত্যজিৎ বলেছিলেন তোমার ব্লাউজ খুলতে অসুবিধে আছে? তুমি কি সিগারেট খাও? এক সাক্ষাৎকারে শেফালি শোনান প্রতিদ্বন্দ্বী ছবির শুটের সেই অভিজ্ঞতা-  

"আমি তো আগে কখনও করিনি। ডায়লগ বলতে গেছি। অমনি শুনলাম 'কাট'। স্ক্রিপ্টটা ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। আমি তো ভয় পেয়ে গেছি। সত্যজিৎ তখন বলেন তোমার স্ক্রিপ্ট আমি এখানেই করে নেব"। 

বাঙালির ম্যাটিনি আইডল উত্তম কুমারকেও নাচিয়ে ছেড়েছিলেন মিস শেফালি। একবার উত্তম কুমার তাঁর নাচ দেখতে এসেছিলেন। এপ্রসঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে মিস শেফালি বলেন। 'সুযোগ পেলাম। উত্তম কুমারের সঙ্গে নাচার সুযোগ। মনে মনে বললাম তুমি উত্তম কুমার, আমিও মিস শেফালি। তোমাকে আমি আজ নাচাচ্ছি।' উত্তমকুমারকে দাদার মতো ভালবাসতেন মিস শেফালি। সুচিত্রা সেনের অভিনয়ের দারুণ ভক্ত ছিলেন কলকাতার ক্যাবারে কুইন। সুচিত্রা মিস শেফালির নাটক 'সম্রাট সুন্দরী' দেখতে আসেন একবার।    



আজীবন মুম্বইয়ের হেলেনকে নিজের গুরু মানতেন। একলব্য যেমন গুরু দ্রোণকে গুরু মানতেন তেমনি। তাই হেলেনের সঙ্গে শো করতে চাননি কখনও। 

কখনও সখনও মনে হয়েছে মিস থেকে মিসেস হয়ে যেতে। কিন্তু সেই মনে হওয়া সেই ইচ্ছেকে কখনও আমল দেননি। কারন তিনি জানতেন আজ যে পুরুষ তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে সে একদিন ছেড়ে চলে যাবেই। বরং তিনি শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছেন আরতি দাসের হাতটাই। যে আজীবন তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ছায়া হয়ে থেকেছিল।

কোনোদিন শিল্পীর সম্মান জোটেনি মিস শেফালিদের। মুখ থেকে লাইমলাইট থেকে সরে যাওয়ার পর  আর পাঁচটা সাদামাটা

মহিলার মতো জীবন কাটাতেন। হতাশ আরতি দাস মনে করতেন, ক্যাবারে ডান্সারদের শিল্পসত্ত্বা নিয়ে কেউ কোনও দিন কথা বলেননি। কাজ না থাকায় শেষ জীবনে আর্থিক সমস্যারও সম্মুখীন হয়েছেন । অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার জন্যেও অর্থাভাব হয়। দীর্ঘদিন কিডনির অসুখে ভুগে। অবশেষে ২০২০সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মিস শেফালি পাড়ি দেন তারাদের দেশে। তাঁর আত্মজীবনী 'সন্ধ্যা রাতের শেফালি’ পাঠক মহলে যথেষ্ট সাড়া ফেলে। এই পার্ক স্ট্রিট থেকে উত্থান আর এক সিঙ্গারের। তিনি পদ্মভূষণ প্রাপক ঊষা উত্থুপ। অথচ আরতি দাস ওরফে মিস শেফালিরা থেকে যান ক্যাবারে কুইনের মতো এক প্রশ্ন সূচক তকমা নিয়েই। আপনাদের কী মত এই প্রসঙ্গে? কমেন্টে জানান। আর এই বিষয়ের ওপরে আমার  তৈরি একটি ভিডিও দেখুন নিচের লিঙ্কে ক্লিক করে। 



 

Thursday, June 20, 2024

চোলাই মদ খেয়ে মরলে ২লাখ! আর চোলাই থেকে বাঁচালে?

সাধারণত মোটরবাইক চালালে আমি ফোন ধরি না। কিন্তু সেদিন ১৪টা ফোন ধরেছি। সেক্টর ফাইভ থেকে বাড়ি আসার মধ্যে। অবশ্যই বাইক দাঁড় করিয়ে। একটা সর্বভারতীয় চ্যানেলের চাকরি ছাড়ার কথাটা সদ্য জানিয়ে পোস্ট করেছিলাম ফেসবুকে। একের পর এক ফোন, মেসেজ, হোয়াটসঅ্যাপ। ওই সময়ে মা আর স্ত্রীর খুব সাপোর্ট পেয়েছিলাম। বন্ধুরা অনেকেই বলেছিল যা হবে ভালই হবে। বাবা বলেছিলেন, "এরপর করবি কী?" 

কোয়েল ওয়ান্ডার ওয়ার্ল্ড বাংলা নামে একটা ইউটিউব চ্যানেল আর তার ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রাম পেজ তৈরি করেছিল। শুরু করলাম সেখানেই। স্বাধীন সাংবাদিকতা। 



কেন প্রথম স্টোরি কল্যাণী পালুই?  

কল্যাণীদির সঙ্গে অনেকদিনের আলাপ। ফোনে। বেশ কয়েকবার যাব যাব করেও যাওয়া হয়নি ওনার কাছে। ভাবলাম ওনার আর ওনার মেয়েদের ওপরেই তৈরি করি প্রথম ভিডিওটা। চোলাই মদের বিষক্রিয়ায় বাংলার বিভিন্ন জেলায় এখনও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। মিডিয়ায় সব খবর আসে না। এটা জানি। বেশ জোর দিয়েই বলতে পারি। কারন মিডিয়ার অনেক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাঁরা পচা সুপারির তৈরি গুটখাকে পান মশলা বলে খবরের মাঝে মাঝে গেলাবেন। সেই সংবাদ মাধ্যম বা তাঁদের ইন্টারনেট পেজ যে অনেক শিশু, যুবক দেখে ওই বিষাক্ত পচা সুপারিকে ফ্যান্টাসাইজ করে মারাত্মক মুখের রোগের সম্মুখীন হবে এ সব খেয়াল তাঁরা রাখবেন না এটাই স্বাভাবিক। ইনকাম বড় বালাই। টার্গেট বালাই ৬০। 

এই অবস্থায় কল্যাণী দির মতো মানুষদের প্রচার আরও বেশি করে করা দরকার। অন্তত তাতে আমার ৭বছরের সন্তানের কাছে আমি মাথাটা উঁচু করে থাকতে পারব! টাকা পয়সা প্রয়োজন কিন্তু মগজ, শিরদাঁড়া? অনেকেই 'শিরদাঁড়া বিক্রি নেই' ক্যাপশন লেখা টিশার্ট পরেন। তাঁদের অনেককেই চিনি। কী পরিমাণে বিকৃত মগজ ও বিক্রিত শিরদাঁড়া সেসব শরীরে! যাই হোক সেকথা লেখা যাবে অন্য কোনও ব্লগে! এখানে কল্যাণী পালুইয়ের গল্প। 


শুটিংয়ের মাঝে আমাদের একটা সেলফি মোমেন্ট


কল্যাণী পালুই সমাজসেবী। কাজ শুরু করেছেন ২০০৪ থেকে। শেষ ২০ বছর ধরে দুহাতে সামলাচ্ছেন দুটি বড় কাজ। তাঁর ছোট্ট অফিস গ্রামীণ হাওড়ার তুলসিবেড়িয়ায়।


বাল্যবিবাহ রোধে স্কুল, কলেজে, গ্রাম-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে নাবালিকাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। সেই সচেতনতা আজ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে এক ক্লাস নাইনের মেয়ে তার বিয়ের কথা শুনে যোগাযোগ করে তুলসিবেড়িয়ার কল্যাণীদির মেয়েদের সঙ্গে। তাঁরা পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে সেই মেয়ের বিয়ে বানচাল করে দেয়। নবম শ্রেণির সেই মেয়ে এখন বি,এড করছেন। আবার লুকিয়ে চুরিয়ে নাবালিকার বিয়ে দিলেও তার প্রতিকার করতে ছুটে যান কল্যাণী।

বাংলার গ্রামে গ্রামে সচেতনতার অভাবে আজও বহু নাবালিকার বিয়ে হয়। অনেক নাবালিকাকেই পাচার করে দেওয়া হয়। গল্প গুলো বলছিলেন কল্যাণী। তিনি হাওড়া স্টেশন থেকে এমনই ৬জন মেয়েকে উদ্ধার করেন একবার। কল্যাণীর কর্মকাণ্ডের আর একটি দিক-

বেআইনি চোলাই মদের ঠেকে চড়াও হয়ে মদ কেনাবেচার সঙ্গে যুক্তদের আটক। তারপর পুলিশ ও আবগারি দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করে দোষীদের ধরিয়ে দেওয়া। আর বাজেয়াপ্ত মদ আবগারি দফতরের হাতে তুলে দেওয়া। কখনও সখনও ভাঙচুর। আগুন লাগিয়ে মদের ঠেক পুড়িয়ে, জ্বালিয়ে দেওয়া। লাল পাড় সাদা শাড়ি, হাতে শাঁখা পলা। গ্রামের সাধারণ ঘরোয়া মহিলারাই অবৈধ মদের আসর দেখলে রণং দেহি হয়ে ওঠেন। তখন চুলোয় যাক কাজ, তা সে যত গুরুত্বপূর্ণই হোক না কেন!

ওঁরা নিতান্ত দ্ররিদ্র পরিবারের মহিলা। বাড়িতে বাবা, ভাই আর স্বামীদের মাতলামি দেখে অতিষ্ঠ। অনেকে প্রিয়জনদের মারা যেতেও দেখেছেন বিষমদের বিষক্রিয়ায়।দেওয়ালে ঠেকেছে ওঁদের পিঠ। তাই ওঁরা আজ ঘুরে পাল্টা মারটা দিচ্ছেন। আপনারা দেখবেন এই ব্লগের সঙ্গে দেওয়া ভিডিও A Hooch Story Of Howrah চোলাই ও বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে লড়াই Wonder World Bangla তে মেয়েরা বলছেন এই কাজে তাঁরা মারা গেলেও কোনও আক্ষেপ নেই।

আর এই কাজের কাণ্ডারি কল্যাণী তাঁকেও হুমকি দেওয়া হয়েছে বহুবার। গলায় ছুরি ধরে চমকানো হয়েছে। তবু তিনি দমে যাননি। বাংলার বিভিন্ন জেলায় আর ওড়িশায় ছুটে গেছেন বিষ মদ চোরাই চোলাইয়ের বিরুদ্ধে এক অসম যুদ্ধে।

পথে নেমে লড়াইয়ে সামিল কল্যাণী


এখনও এই লোকসভা নির্বাচনের আগে ফোন এসেছে ওঁদের কাছে- কদিন ধর পাকড়টা যদি একটু বন্ধ রাখেন। তাও ম্রিয়মান হননি ওঁরা। বাধা যত এসেছে বুঝেছেন ঠিক পথেই রয়েছেন। যে পথে কষ্ট থাকলেও শান্তি আছে অনেকটা। সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে নিজেকে বিকিয়ে দেওয়া নেই। বরং বিলিয়ে দেওয়া আছে। ওঁদের পোশাকে আঁকতে হয় না 'শিরদাঁড়া বিক্রি নেই!'

আজ আপনাদের পরিচয় করাব সাধারণের মধ্যে মিশে থাকা এই অসাধারণ মহিলা আর তাঁর দলকে। পরিচয় করাব কল্যাণী পালুইকে।



দেখুন ভিডিও ওপরে ক্লিক করে। আর অবশ্যই কমেন্ট করে জানান কেমন লাগল এই ভিডিওটা।


 







Friday, April 19, 2024

সম্পর্কের উত্তাপ বাড়িয়ে রাখুন


আমার শ্বশুরমশাইয়ের বয়স প্রায় ৮৩ বয়স জনিত সমস্যা সঙ্গে অ্যালঝাইমার্স। ফলে সমস্যা একটু হয় মাঝেমধ্যে। এই সে দিন বললেন -
খবরের কাগজে বলছে হাওয়ায় নিউমোনিয়া হচ্ছে। 
যাঁরা স্মৃতিবিপন্ন মানুষদের নিয়ে ঘর করেন তাঁদের কাছে এরকম ঘটনা খুবই স্বাভাবিক। স্মৃতিশক্তির বিপন্নতায় ওঁরা ভুলতে থাকেন। যাক সে অন্য কথা। ইদানিং সেই শ্বশুরমশাইয়েরও গরম লাগছে। রীতিমত হাঁসফাঁস করছেন গরমে। সারা দুপুর জেগে থাকছেন গরমে। ওনার এয়ার কন্ডিশনার সহ্য হয় না। তাই আমরা একটা এয়ার কুলার কিনতে গেলাম। সেখানে গিয়ে একটা ঘটনা শুনলাম। সেটাই আজকের ব্লগে আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করছি। 

পৃথুলা এক মহিলার গল্প। গল্প নয় মোটেই। একেবারে টাটকা বাস্তব। তো সেই মহিলা একে পৃথুলা মানুষদের গরম একটু বেশি লাগে তার মধ্যে এই মরুভূমির মতন গ্রীষ্মতাপ। একেবারে জর্জরিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন একটি এসি কেনার। সিদ্ধান্তটি নেওয়ার সময় থেকে শুরু হয় তাঁর স্বামীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি। পরবর্তীতে সেটা পৌঁছায় ঝগড়াতে। ওই শোরুমের এক কর্মীর মুখে ঘটনার বিবরণ শুনছি। 


তারপর ওই মহিলা একপ্রকার নিরুপায় হয়ে নিজেই চলে আসেন ইলেকট্রনিক কোম্পানির শোরুমে। সঙ্গে নিজের জমানো ২৮ হাজার টাকা। পিছু পিছু চলে আসেন ওই মহিলার স্বামী। শো রুমেই শুরু হয়ে যায় দম্পতির বাগবিতণ্ডা। শো রুমের কনকনে এয়ার কণ্ডিশনার চলছিল। তার মধ্যেই মহিলা দরদর করে ঘামছিলেন। স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া চলছিলই। মহিলা ততক্ষণে বিলিং করিয়ে নিয়েছেন। ২৮ হাজার ডাউন পেমেন্ট। বাকি টাকা ইন্সটলমেন্টে। পরের দিন সকালেই ডেলিভারির কথা ছিল। পৃথুলা সেই মহিলা বারেবারে স্টোর কিপারদের বলেছিলেন সকাল সকাল এসিটা ডেলিভারি দিতে।

পরের দিন সকালে শোরুম খুলতে ওই ভদ্রমহিলার স্বামীর একটা ফোন। এ প্রান্তে শোরুমের কর্মী, যিনি ফোন ধরেছিলেন তিনি বলছেন- 
-ডেলিভারি ম্যানরা এলেই আপনাদের এসিটা পাঠানো হবে। 
ও প্রান্তে ভদ্রলোক তখন হাউহাউ করে কাঁদছেন। বলছেন- 
-আর ওই এসি কার জন্য পাঠাবেন। ওটা আপনাদের কাছেই রেখে দিন। আমার স্ত্রী আজ ভোর রাত্রে মারা গিয়েছেন। 

শো রুমের কর্মীরা স্তম্ভিত। যেন সেই শোকের ছায়া ভুলতে পারছেন না এখনও ।                                  

গরমে সবাই ব্যতিব্যস্ত। সহজেই মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। সম্পর্ক গুলোকে একটু সময় দিন। নইলে আপনার অবহেলার উপলব্ধি আপনি যতক্ষণে করবেন ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যাবে। সাবধানে থাকবেন এই উত্তাপে। মনের উত্তাপটা বাড়িয়ে রাখুন। বাইরের উত্তাপ বাড়ুক ক্ষতি নেই ভিতরের আগুনটা জিইয়ে রাখুন।

Sunday, March 3, 2024

ছোট বুনো বিড়ালদের নিয়ে 'চিতা প্রজেক্ট' এর ৭ বিজ্ঞানীর গবেষণায় উঠে এল বাংলার রাজ্য প্রাণী সংরক্ষণের গুরুত্ব

 



জ বিশ্ব বন্যপ্রাণ দিবস। গতকাল কথনের ফোন এল। কথন বন্দ্যোপাধ্যায়, আমার প্রাক্তন সহকর্মী উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুযোগ্য পুত্র। কুনো অভয়ারণ্যে থাকে ও। প্রাণী বিজ্ঞানী। ওর সঙ্গে কথা বলার পরই ভাবলাম এই ব্লগটা লেখা দরকার। 


ফিশিং ক্যাট বা মেছো বিড়াল

 

"ভারতের বাস্তুতন্ত্রে ছোট বিড়াল প্রজাতির প্রাণীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি বাস্তুতন্ত্রে এরা শিকারের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে। আর এর ফলে পুষ্টির স্থানান্তর সহজ হয় আর গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থলগুলি সুরক্ষিত রাখে। এই সব 'স্মল ক্যাট'দের পরিবেশগত তাৎপর্য গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, এই প্রজাতিগুলি সংরক্ষণের নিরিখে খুবই কম মনোযোগ পায়। বৃহত্তর মাংসাশী বাঘ, সিংহ, লেপার্ড বা চিতার ওপর ফোকাস অনেকটাই বেশি। তাদের পাশাপাশি এদের অবস্থা সম্পূর্ণ এবং তীব্রভাবে বিপরীত।" 



কথাগুলো বলছেন সাতজন প্রাণী বিজ্ঞানী। মধ্যপ্রদেশের কুনো পালপুর চিতা প্রজেক্টে ওঁরা যুক্ত, শুরুর সময় থেকে। কথন বন্দ্যোপাধ্যায়, কৌশিক ব্যানার্জি, মারিয়া ভিট্টোরিয়া মাজামুতো, সুমন কোলে, জন এল কোপরোস্কি, কামার কুরেশি ও যাদবেন্দ্রদেব ঝালা ।  এই সাত বিজ্ঞানী ৯টি স্থানীয় ফেলিড (felids) বা অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের বন্য বিড়ালের উপরে তাঁদের রিসার্চ শুরু করেন। তাদের অবস্থা, বাসস্থান, সমস্যা আর চোরাশিকারের কারণে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কাজ শুরু হয়। 


এদের মধ্যে ছিল 

১ ক্যারাকল Caracal, 

২ ডেজার্ট ক্যাট desert cat, 

৩ ফিশিং ক্যাট fishing cat (পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য প্রাণী)

৪ জঙ্গল ক্যাট jungle cat

৫ রাস্টি স্পটেড ক্যাট rusty spotted cat

৬ ক্লাউডেড লেপার্ড clouded leopard

৭ লেপার্ড ক্যাট leopard cat

৮ মার্বেল্ড ক্যাট marbled cat

৯ গোল্ডেন ক্যাট golden cat


 এই নয়টি স্থানীয় ভারতীয় ছোট বিড়ালের ওপরে বিজ্ঞানীরা তাঁদের কাজ শুরু করেন। ওই বিড়ালগুলির সংরক্ষণের অবস্থা মূল্যায়ন করে, উন্নততর প্রজাতি সংরক্ষণের জন্য ডেটা একত্রিত করেন। বিশ্বব্যাপী ছোট মাংসাশী প্রাণীর সংরক্ষণের নিরিখে এদের সংযোগ স্থাপন করেন বিজ্ঞানীরা। এই কাজ বেশ ক্টহিন ছিল। কারণ বিগত ৫০ বছরে এদের সম্বন্ধে তথ্যের ব্যাপক অভাব ছিল। আর এই সমস্যা বিজ্ঞানীদের জন্যে   পদে পদে বাধা হয়ে ওঠে। এর ফলে প্রাথমিকভাবে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ যে ইকোলজিক্যাল ডায়নামিক্স তার কোনও তথ্যই পাচ্ছিলেন না বিজ্ঞানীরা।  


তাই অন্য পথে কাজ শুরু হয়। সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই 'ছোট বিড়ালদের' বাসস্থানের পরিবেশ, জলবায়ু, মানুষের সঙ্গে বাসস্থান ভাগের ফলে তৈরি সমস্যা, বড় মাংসাশী প্রাণীর উপস্থিতি, এদের বাসস্থানের টোপোগ্রাফি আর গাছপালার ধরণের ওপরে ভিত্তি করে কাজ শুরু করেন বিজ্ঞানীরা। ওই সাত বিজ্ঞানী দেখেন বন আইনের কিছুটা কড়াকড়ির কারণে ১৯৯৭ থেকে চোরা শিকারের বাজারে এই ৯ বিড়ালের চাহিদা কিছুটা কমেছে।  কিন্তু সমস্যা আরও ব্যাপক হয়েছে। 


এদের মধ্যে অধিকাংশই তাদের বাসস্থান মানুষের সঙ্গে ভাগাভাগি করে থাকে। যেমন আমাদের রাজ্য প্রাণী ফিশিং ক্যাট বা মেছো বিড়াল। 

তাই মানুষের সঙ্গে  এদের সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ফ্যাক্টর। রোজ বাড়ছে মানুষের জনসংখ্যা, বাড়ছে শিল্প, আর তার ফলে এদের বাসস্থান সংকুচিত হচ্ছে। তাই বিজ্ঞানীরা এদের সংরক্ষণে পরিবেশগত তথ্যের প্রয়োজনীয়তা দৃঢ়ভাবে তুলে ধরেন।  বিশেষ করে জনসংখ্যা, শিকার-শিকারীর সম্পর্ক এবং মানুষের কারণে এদের আবাসস্থল পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়াগুলি নিরীক্ষণ করেন। এই ফ্যাক্টরগুলিকে সংরক্ষণগত কৌশলগুলির মধ্যে একত্রিত করার পক্ষে সওয়াল করেন। 





এ বিষয়ে নিজেদের গবেষণার শেষে ওই বিজ্ঞানীরা বলছেন  বিশ্বব্যাপী ছোট বিড়াল বা  ফিলিডের (felids)সফল সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে প্রয়োজন এদের জন্য রাজনৈতিক স্তরে দেখভাল ও প্রতিশ্রুতি। আর এদের বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক সমর্থন ও সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা। এই কাজ যুদ্ধকালীন তৎপরতায় না হলে এরা বিপন্ন থেকে বিলুপ্ত হতে আর দেরি নেই। 


সারা দুনিয়ার বাস্তুতন্ত্রে এদের, এই ছোট বিড়ালদের ভুমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাই এদের সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে যেকোনও সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন ওই বিজ্ঞানীরা। 

Saturday, February 4, 2023

লাল শালু 'বীরন্ন' সাম্রাজ্য


এটা একটা ২ বছরের পুরনো লেখা 

পুরনো চাল নাকি ভাতে বাড়ে! 

বড় বড় জুঁইফুলসাদা ভাত রুপোর কাঠি 

হলুদ জাফরানরঙা ভাত সোনার কাঠি 

এক বীরন্ন রূপকথা 

বাতাস বিরিয়ানভি  


পথেই হবে যে পাত চেনা

চলতে চলতে মানুষ চালাক হয় কি না জানা নেই, কিন্তু চালক হয় আর চালু হয়। চালের দানা আর চুলোর আগুন খুঁজতে খুঁজতে চালু হয়। চালু মানে ইজি, চালু মানে জীবনে বা হোয়াটসঅ্যাপের স্ট্যাটাসে “অ্যাভেলেবেল” হয়। চুলোয় জ্বলতে থাকা আগুনেরও তো চাই চালের দানা। তাই চালু পথ গন্তব্য বেঁধে দেয়। পাতের যোগানে পথেই নামে যে রোজ, তার জীবন আর সেই পথের বাঁকেই অজান্তে কোথাও হয়ে যায় পাত চেনা। প্যারডিতে সলিল গেয়ে ওঠেন “পথে এবার নামো সাথি পথেই হবে যে পাত চেনা”। আমার শহর

কলকাতায় তো আসলে লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য কোল পাতা। যারা সকালে উঠে এ শহরে আসেন আর রাত্রে বহুদূর মফস্বলের বাড়িতে ফেরেন। রোজকার লোকাল ট্রেনের অ্যাম্বার আলোমাখা কালো জানলা, শেষরাতে কুকুর জাগা পাড়া আর ফাঁকা প্ল্যাটফর্মের শূন্যতা। তাঁরা যেন নিজভুমে পরবাসী। এ শহরেও তাঁরা কি বহিরাগত? এ তত্ব, এ শব্দ খাটে না এই মলিন ম্যাড়ম্যাড়ে শহরটার ক্ষেত্রে। এ শহর যেন ক্ষয়িষ্ণু রক্তাল্পতায় ভোগা এক একাকীনি মা। যিনি পাত পেড়ে ভাত বেড়ে তার সন্তানদের জন্য বসে আছেন। হাতের হলুদ মোছা আঁচলে মুখ মুছে। মুখে হাসি নিয়ে। আর তার সন্তানরা? তাদের কথা তো জানা। তাঁরা আছেন তাই এ শহর বাঁচে।

এ শহর অন্নপূর্ণা। প্রতিদিন নবান্নের প্রত্যাশায় আগুন জ্বলে এই শহরের উনোনে উনোনে। কখনও পলান্ন, কখনও ‘বীরান্ন’ বেড়ে বসে আছে তার নিত্যদিনের জীবন সংগ্রামে কখনও জিতে বা কখনও হেরে যাওয়া সংগ্রামী সন্তানদের জন্য। জীবনের বীর আমজনতার জন্য। আজ সেই বীরান্নের গল্প। যার কৌলীন্য ম্লান হয়ে গেলেও প্রলোভন প্রশ্নাতীত। পড়ে যাওয়া জমিদার বাড়ির মতই যার দম্ভ। ইত্তিহাসের মতই গৌরবান্বিত যার অতীত। শহর কি মফস্বলে একটা মাংসের দোকানের আশেপাশেই তার মন্দির, ঠেক,আড়ত বা যা খুশি বলতে পারেন। দূর থেকে লাল শালু বাঁধা হাঁড়ি যেন গ্ল্যাডিয়েটর অ্যারিনার যোদ্ধার হাতের লাল কাপড় আর আমার আপনার উন্মত্ত ক্ষুধা যেন ক্ষ্যাপা ষাঁড়। ফুঁসছে কখন বেরিয়ে এসে ‘আক্রমণ’ বলে হামলে পড়বে ওই একটা থালা ভরা সেদ্ধ চাল,আলু,ডিম আর মাংসের পারাবারে। পার পাবে না কেউ! এমন মিঠা আতর, কেওড়া জল মেশানো ঘ্রান আসছে। এক এক বার করে বিশাল ঢাকনা হাঁড়ির মুখ থেকে সরছে আর ভক ভক করে বাতাসে মিশে যাচ্ছে সেই ঘ্রান। 


আমাদের লড়াইয়ের ঘাম অশ্রু, দূষণ ডিজেল, গ্রিন হাউজ বাতাসে ভারি সুন্দর লাগছে আউধি পাখওয়ানের খসবু। বাতাস ভারী হচ্ছে। বাতাস বিরিয়ানভি হচ্ছে। মেহফিল জমছে। আমাদের হেরে যাওয়া, লড়াই করা, ঘেয়ো কুকুরসম জীবনে যেন এক লহমায় টপাটপ মোমের বাতি জাগছে। জীবনের ঝাড়বাতিটা ঝাড়পোঁছ হচ্ছে রসনার আলো জ্বলবে বলে।

এ শহর খালি পেটে ফেরায় না কাউকে। পকেটের মাপ অনুযায়ী থালা ভরে ভাত বেড়ে দেয়। ক্ষ্যাপা পরশ পাথর খোঁজে ট্রামের লাইনে আর বিড়বিড় করে বলে “দানে দানে পে লিকখা রহতা খানেবালওঁ কা নাম।“ আর আমার আপনার মত কিছু মানুষের রস ও রসনায় ভর করছেন নবাব ওয়াজেদ আলি শাহর রহেমত। আমার আপনার খেটে খাওয়া শহর, লড়তে লড়তে হার না মানা শহর, ঘাম মুখ ধুয়ে রুমালে গাল মুছে প্যাকেটের আবরণ সরাচ্ছে। টালিগঞ্জ পাড়ার সহকারী টেকনিসিয়ানটি আজ টিফিন আনে নি, লাঞ্চে প্রোডাকসান বিরিয়ানি খাওয়াবে বলে। যদিও সহ অভিনেত্রিটি আগামিদিনে লিড রোল পাওয়া ও রোগা হবার বাসনায় শুকনো শসাতেই লাঞ্চ মেটাবেন। শপিং মলের সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করা মহিলা, যার হাতের শাঁখা পলা আর তার সঙ্গের শার্ট প্যান্টটা বড় বেমানান কিংবা ছোট অফিসের আরও ছোট ক্ষয়িষ্ণু কর্মী, যার তিন দিন অফিস ঢুকতে লেট হলে একদিনের পারিশ্রমিক মালিক কাটবেই আর তাতেই তার মুখ কালো। সেসব মুখে হঠাৎ হাজার ভোল্টের আলোর ঝিলিক। হলুদ, সাদা চালের আস্তরণ সরছে, যেন সোনার কাঠি আর রুপোর কাঠির ছোঁয়া লেগে চকমকি হচ্ছে। প্রকাশিত হচ্ছে সেই ‘পট মিল’ যার প্রতিশ্রুতিতে অনেক মানুষকে অপহরণের টোপও তৈরি করা যায়। বিরিয়ানি! ঝটপট সাবাড় সমস্তটা ।


কলকাতার বিরিয়ানি পাক্কি বা পাক্কা বিরিয়ানি। ঢাকায় কাচ্চি বাঁ কাসসির চলটাই বেশি। বিরিয়ানি বিশেষজ্ঞ বা খাবার বিশারদরা যদিও বলেন বিরিয়ানি হয় গরুর মাংসেই। বাকিসব মাংস মিশ্রিত ভাতই নাকি পোলাও! বাংলাদেশে মোরগ পোলাও আসলে আমাদের চিকেন বিরিয়ানিরই নামান্তর। কোনও চিনা যেমন কলকাতার পথ চলতি সার্বজনীন চাইনিজ খেয়ে চিনতে পারবেন না ওটার চিন দেশে জন্ম, তেমন কলকাতার বিরিয়ানিও সময়ের প্রয়োজনে, চাহিদার যোগানে নিজের রূপ পরিবর্তন করেছে। তাই কলকাতার বিরিয়ানির নিজস্ব স্বাদ যেন স্বতন্ত্র। যেন ভৌগলিক নিশান উড়িয়ে স্বমহিমায় আসীন তার সিংহাসনে। শুধু মাটন, চিকেনেই থেমে নেই এই বিরিয়ানি। ডিম বিরিয়ানি, আলু বিরিয়ানি এমনকি পনির বিরিয়ানি পর্যন্ত পাওয়া যায় বাজারে। আয়তন অনুযায়ীও বিরিয়ানির হেরফের এ শহরের সিগনেচার। মুম্বাইয়ে কাটিং চায়ে পাওয়া যায় বলে যারা নাক সিটকান তাঁদের অবগতির জন্য সবিনয়ে বলি আমার আপনার শহর ‘হাফ প্লেট’ বিরিয়ানিও অফার করে। পুরানো দিল্লীর দরিয়াগঞ্জের যে মসজিদটি আছে তার আশেপাশে ওজন করে পাওয়া যায় কাবাব ও বিরিয়ানি। সেই সংস্কৃতিও এখন ধীরেধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে কলকাতায়। বিরিয়ানির চালের ব্যবহারেও এসেছে এক উল্লেখযোগ্য বদল। খুব একটা জনপ্রিয় না হলেও বাসমতীর জায়গায় গোবিন্দভোগ চালের বিরিয়ানি পাওয়া যাচ্ছে শহরের বেশ কটি ছোট বড় রেস্তোরাঁয়।



আসলে খিদে যে বড় বালাই। যে বুঝেছে সেই সম্মান করে পাতকে। সেই পাত পেড়ে ভাত বাড়ে। ক্ষুন্নিবৃত্তির চেয়ে বড় সভ্যতা বোধহয় আর কিছু নেই। সিরাজ, আমিনিয়া, আরসালান, জিশানের সম্ভ্রান্ত অন্দরমহলে ঢুকতে যাদের পিছনে টেনে ধরে ফুটো পকেট আর জীবনের হাজারো কষ্টকর আর্থিক প্রতিবন্ধকতা তাঁদের জন্যই ওই লাল শালু ঢাকনা দেওয়া টং টং ধবনি। কলকাতার নতুন অফিসপাড়া সেক্টর ফাইভে এ লাঞ্চ আওয়ারে গেলে দেখবেন যেন ধর্মতলার ফুটের সেল চলছে। একজন যুবক হাঁকছেন “শুধু ষাট শুধু ষাট” তো তার সহকারী তরুণটি “ষাট শুধু ষাট শুধু”। এক অনাবিল ক্যাকোফোনি ধ্বনিত হচ্ছে। আহ্বানের রোমাঞ্চকর সে কোরাস গীতি যেন হ্যামলিনের বাঁশি! গুটিগুটি পায়ে তথ্য প্রযুক্তি প্রকৌশলীরা আসছেন ঝুপস গুলিতে। পরিষ্কার পরিবেশে এই কোভিডোত্তর কলকাতায় ধোঁয়া ওঠা সেদ্ধ চালের ফাঁকে ফাঁকে দেখা দিচ্ছে চিকেনের লেগ পিস , মাটনের সিনা, পাঁজরা, পিছলি রানের অংশ বিশেষ। মুখেই মিলিয়ে যায় এমন চন্দ্রমুখি আলু এক চামচে ক্ষতবিক্ষত। আহ জীবন! তুমি এত কিছু রেখেছ এখনও আমার জন্য!


সময়ের সাথে সাথে বাংলায় বিরিয়ানি ক্রমে ক্রমে তার কৌলিন্য হারিয়েছে। একটা সময় যখন সারা শহরে বিরিয়ানি বলতে পার্ক সার্কাস বা আমিনিয়া, সিরাজই বুঝত বাঙালি তখন বিয়েবাড়ির ভোজসভায় শো স্টপারের ভুমিকায় অবতীর্ণ হত বিরিয়ানি। বিরিয়ানি কাটার মিস্ত্রী মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সিরাজ বা আমিনিয়া থেকে আসত বিয়েবাড়িতে। সে মিস্ত্রী শুধু কেটেই খালাশ। রান্নার দায় তার থাকত না। আজ সেই কুলীন খাদ্য তার অবস্থান থেকে অনেকটা নেমে এসেছে। সে পতন খুব একটা কম নয়। একেবারে সটান পথেই নেমেছে সে। পথে নেমে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। 

তাই তো এনআরসি (NRC)ও সিএএ(CAA) র প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক যখন অবরুদ্ধ হয় তখন সংবাদ শিরোনামে ছবি আসে – পথ জুড়ে তোড়জোড় হচ্ছে বিরিয়ানি রান্নার। প্রতিবাদের ভাষার সাথে কোথাও বিরিয়ানি মিলে মিশে একাকার। অবরোধকারিদের তুলতে এসে পুলিশও পুরো থ। এ কেমন প্রতিবাদ? একদিকে শয়ে শয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি অন্যদিকে অবরোধকারিরা রীতিমত আলু কেটে, পিঁয়াজ কেটে, চাল সেদ্ধ করে বিরিয়ানি রান্নার তোড়জোড় করছে! কোথাও রাজ সিংহাসন থেকে নেমে এসে মানুষের সাথে মিলেমিশে গেছে এই জনগণমন তান্ত্রিক খাবার। 

তীব্র মহামারিতে যখন দিশাহীন মানুষ। জীবন গিয়েছে থেমে, চলে গেছে জীবিকা, আর্থিক নিরাপত্তাও বিপন্ন। তখনও মানুষের পাশে এসে তার জীবনের লড়াইয়ে হাতটা ধরেছে বিরিয়ানিই। ঘটনাস্থল মুম্বই। গত আট বছর ধরে মুম্বইয়ের বেশ কটি পাঁচতারা হোটেলে সেফ হিসেবে কাজ করেছেন অক্ষয় পার্কার। কোভিড আবহে কাজ হারিয়ে দিশেহারা অক্ষয় হেরে যান নি, দমেন নি। দাদরের শিবাজি মন্দির এলাকায় রাস্তার পাশে খুলেছেন ‘পার্কার বিরিয়ানি হাউজ’। পাঁচতারা হোটেলের স্বাদ ছড়িয়ে দিয়েছেন অলিতে গলিতে। খুলে গেছে সিমসিম! অক্ষয় ভেজ, আণ্ডা আর চিকেন বিরিয়ানির থালা সাজিয়ে দিচ্ছেন শহরবাসীদের। আধ প্লেট ৬৫ টাকা আর পুরো থালা ১৪০ টাকা দিয়ে চেটেপুটে খাচ্ছে 'আখখা মুম্বই'। অক্ষয় অর্ডার পাচ্ছেন পার্টি অর্ডারও। ভেজ বিরিয়ানি প্রতি কেজি ৮০০ টাকা আর নন ভেজ প্রতি কেজি ৯০০ টাকা। বাড়ির একমাত্র উপার্জনকারী অক্ষয় বিরিয়ানির হাত ধরে পায়ের তলায় মাটি পেলেন।

রাস্তার বাজে বিরিয়ানিরা

রাস্তার ভাল বিরিয়ানি অনেক রয়েছে। তবে যাদের জন্য বদনাম হয় পথের বিরিয়ানি তাদের হেঁশেলের উপকরণের খোঁজ একটু নেওয়া যাক এবার। চাল আধ সেদ্ধ করে রাখা হয়। তারপর মাংস হলুদ জলে সেদ্ধ করে রাখা হয়। এরপর পামোলিন তেলে মাংস কিছুটা রান্না করে বেরেস্তা (আগে থেকে ঝুরো ঝুরো করে কাটা পেঁয়াজ ভাজা), বিরিয়ানি মশলা আর ঘি ছড়িয়ে চাপা দেওয়া হয়। রাস্তার বিরিয়ানির সবচেয়ে বড় সমস্যা বা হেলথ হ্যাজার্ড হল পামোলিন তেল আর হলুদ কামধেনু রঙ। কেশরের বদলে এই ইণ্ডাস্ট্রিয়াল রঙ ব্যবহারের ফলেই রিস্ক বাড়ে ক্যান্সার সহ বহু জটিল স্নায়বিক রোগের আর পথের বিরিয়ানিও আমজনতার কাছে হয়ে ওঠে ভিলেন।


কেন বিরিয়ানি এত জনপ্রিয়

কলা আর কাঁঠাল এর মধ্যে কলা কেন জনপ্রিয় এ কথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। কলা খাওয়ায় কোনও ঝামেলা নেই। চটপট খোলো আর ঝটপট খাও। একই কথা বিরিয়ানির ক্ষেত্রেও হয়ত খাটে। একটি নির্ঝঞ্ঝাট সম্পূর্ণ খাবার। ঝোল পড়ে যাওয়ার সমস্যা নেই, কাঁটা বাছার অসুবিধা নেই। হাতটা টিস্যুতে মুছে অল্প জলে ধুয়ে নিলেই হ’ল। কোথাও যেতে যেতে গাড়িতেও খাওয়া যায়। সাথে সাইড ডিস কিছু না হলেও দিব্যি চলে। তাই তো পাতুরির চেয়ে বিরিয়ানি এত জনপ্রিয়। তাছাড়াও ডাব চিংড়ি কিংবা ইলিশ ভাপার একটা মিল এর তুলনায় একটা বিরিয়ানি দামেও সস্তা। এটাও বিরিয়ানির জনপ্রিয় হওয়ার একটা বড় কারন। একই পরিমাণ প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট আর ফ্যাট একসাথে বাজারের অন্য খাবারের তুলনায় অপেক্ষাকৃত সস্তায় পাওয়া যায় বিরিয়ানিতেই। তার ওপর এতটুকু সম্ভ্রম না কমিয়ে অপেক্ষাকৃত সস্তায় নবাবী খাবার বলতে তো বিরিয়ানিই আছে। কাজের মাঝে বা কাজ করতে করতে বিরিয়ানি খাওয়া যায় অনায়েসেই। তাই এককালের কুলীন পাখওয়ান তার কৌলীন্য হারিয়ে হয়ে জনতার দরবারে হয়ে উঠেছে জনপ্রিয় ফাস্ট ফুড।


কলকাতা বা তার আসেপাশে ফুটের বিরিয়ানির এপিসেন্টার বা হটস্পট

ডালহৌসি, স্টক এক্সচেঞ্জ এলাকার অফিস পাড়ার বিরিয়ানি। কেন্দ্র, রাজ্য সরকারি কেরানি থেকে বড়বাবু সবাই নিয়ম করে খদ্দের। বাদ যান না বেসরকারি চাকুরে কিংবা চাকরি প্রার্থীরাও।

মেটিয়াব্রুজ এলাকায় লাইন দিয়ে বিরিয়ানি খাওয়া একটা দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। মেটিয়াব্রুজের রাস্তার বিফ বিরিয়ানি যেকোনোও কুলীন বিরিয়ানিকে টেক্কা দেবে।

মমিনপুর, খিদিরপুর ওয়াজেদ আলি শাহের এলাকা অতএব এখানকার বিরিয়ানি তো প্রণম্য।

পার্কসার্কাসের সাত মাথার মোড় আর বিরিয়ানির সংযোগ যেন সাত পাকে বাঁধা। কুলীন আরসালান, আমিনিয়া, জিসানের পাশাপাশি হাজারো হাজি সাহেব পথ আলো করে, গন্ধ মম করে বসে আছে। পার্কসার্কাসে পথে ঘাটে কারনে অকারনে বিরিয়ানি বানানো যেন অর্ডার অফ দ্যা ডে। 

এই অঞ্চলে ভাল গোস্ত বিরিয়ানি বা গরু বিরিয়ানি পেতে লাল মসজিদের পাশে আর উল্টো দিকের ইটিং হাউজ গুলোয় ঢুঁ মারুন।

বিফ বিরিয়ানি ভাল পাওয়া যায় রাজাবাজার এলাকায়। আর মেটিয়াব্রুজ অঞ্চলেও।

সেক্টর ৫ কলকাতার নতুন অফিস পাড়া। ওয়েবেল মোড় আর এসডিএফ এলাকার দর্মার ঝুপড়ি দোকান। প্রচলিত নাম ‘ঝুপ’। সেখানকার কেজিএন বিরিয়ানি ভাল বিরিয়ানির নতুন ঠিকানা।

নিউটাউন ফুড জোনে ঝুপসের বিরিয়ানি অ্যাপের মাধ্যমে অর্ডার পায়। বিক্রিও হয় হুহু করে। এখানকার আজহার বিরিয়ানি বেশ জনপ্রিয়।

ফুলবাগানের রাজ বিরিয়ানিও বেশ স্বোয়াদিষ্ট।

ওয়েলেসলি এলাকার হাণ্ডি বিরিয়ানি জিভে জল আনে।

টিপু সুলতান মসজিদের নীচে মঞ্জিলাত এর বিরিয়ানির মেজাজটাই আলাদা ।

রাসবিহারী অ্যাভিন্যুয়ে সমর দার বিরিয়ানি। সমর কয়াল রোজ ১৫০ থেকে ২০০ হাফ এবং ফুল প্লেট বিরিয়ানি তৈরি করেন। প্রিয়া সিনেমার উল্টো দিকের ফুটপাথে বসছেন ২০ বছরের বেশি সময় ধরে। শুধু বিরিয়ানিই বিক্রি করেন। চিকেন, মটন এবং আলু বিরিয়ানি।

লেক গার্ডেনসের অন্নপূর্ণা বিরিয়ানির বেশ নামডাক। অর্ডার দিয়ে প্যাকেট হাতে পেতে বেশ সময় লাগে।

বারুইপুরের আসমা বিরিয়ানি একটা সময় ফুট থেকে শুরু করে আজ ব্র্যাণ্ড। চিকেন, মটন আর বিফ বিরিয়ানি পাওয়া যায়।

যেমন ব্র্যাণ্ড হয়েছে ব্যারাকপুরের দাদা বৌদির বিরিয়ানি। ৫ মিনিটে ১০০ প্যাকেট বিরিয়ানি বিক্রির রেকর্ড এই দোকানের। দিনের যে কোনও সময় গেলে অর্ডার দেওয়ার জন্য লাইন দিতেই হবে আপনাকে।

ব্যারাকপুরে একটু বাইরেই আছে ডি বাপির বিরিয়ানি। এলাকায় বেশ নামডাক এনারও।

ব্যারাকপুরের ঢাকা বিরিয়ানির প্রলোভন এড়ানো অসম্ভব।

জগদ্দলের বহু দোকানের ফুটের বিরিয়ানিরও আশেপাশে বেশ নামডাক।

কল্যাণী এলাকায় সম্রাট বিরিয়ানি, সোনালী বিরিয়ানি, ঘোষ দার বিরিয়ানি বিখ্যাত।

বোম্বে রোডের অঙ্কুরহাটি এলাকায় জাতীয় সড়কের দুপাশে পরপর রয়েছে বেশ কিছু রাস্তার বিরিয়ানি স্টল।

দ্বিতীয় হুগলী সেতু থেকে নেমে আন্দুল রোড ধরে আলমপুর পর্যন্ত গেলে দুপাশে বেশ কয়েকটি রাস্তার বিরিয়ানি। তারমধ্যে মুসকানের বিরিয়ানি গভীর রাত অবধি জেগে থাকে।


কাউয়া বিরিয়ানি আসলে কী কাকের মাংস?

কাউয়া বিরিয়ানি আসলে ‘কাউয়া’ বা কাকের মাংস দিয়েই বানানো কিনা তা প্রমাণ সাপেক্ষ। তবে কম দামে মুরগীর জোগান দেয় বিভিন্ন পোলট্রি ফার্ম। সে ক্ষেত্রে কোনও রোগ বা মড়কে মুরগী মারা পড়লে বা স্বাভাবিক ভাবে মরা, মৃত মুরগী দিয়ে বানানো হয় সস্তার বিরিয়ানি। জলের দরে কিনে তা দিয়ে লাভের কড়ি ভালই কামান কাউয়া বিরিয়ানি ওয়ালারা।


ভাগাড় কাণ্ড ও বিরিয়ানি 

২০১৮ র এপ্রিল মাসের শেষ দিকে এক ভোরবেলা বজবজের একটি ভাগাড়ের কাছে একটি গাড়ির চাকা কাদায় আটকে যায়, স্থানীয় বাসিন্দারা দেখেন গাড়িটি থেকে বেশ কিছু প্যাকেট নামানো হচ্ছে। পচা মাংসের কটু গন্ধ পেয়ে স্থানীয় মানুষজন গাড়িটিকে আটকে রেখে পুলিশকে খবর দেন। পুলিশি জেরায় ধৃতরা স্বীকার করে শুধু বজবজেই নয় কলকাতার বেশ কিছু ভাগাড় থেকে মৃত পশু ও পাখিদের দেহাবশেষ ও মাংস কেটে নিয়ে তার সাথে রাসায়নিক মিশিয়ে হিমায়িত করে তারপর সেসব মাংস তারা চালান করত কলকাতার বহু নামি ও বেনামী হোটেল, রেস্তরাঁতে। স্বভাবতই সেই মাংসর বিশাল একটা অংশ আসত রাস্তার পাশের বহু বিরিয়ানির দোকানে। এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই রোজই সংবাদের শিরোনামে উঠে আসে খাদ্য দপ্তরের রেইডের ঘটনা। সাথে মিডিয়ার কভারেজ দিনের আলোর মত পরিষ্কার করে দেয় শহরের খাবারের হাল ও চালচিত্রটা। একের পর এক নামজাদা রেস্তোরাঁতেও অভিযান চালায় রাজ্য খাদ্য দফতর। সংবাদপত্র আর টেলিভিশন চ্যানেল গুলোতে হেড লাইন নেয় পচা গলা পশু ও পাখির মাংসের ছবি। কলকাতার একটি কোল্ড স্টোরেজ থেকে উদ্ধার হয় দুই মেট্রিক টন হিমায়িত পচা মাংস। 

তবুও আমজনতা বা শহরবাসীর রাস্তার বিরিয়ানি খাওয়ার অভ্যাসকে বন্ধ করতে পারেনি ভাগাড় কাণ্ডের আতঙ্ক। সাময়িক মন্দার পর আবার গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে লাল শালু বিরিয়ানি সাম্রাজ্য। আসলে সস্তা খাবারের যোগান আর আকাশ জোড়া অভাব যখন পাশাপাশি বাস করে তখন আতঙ্কের বাতাবরণকে যখন তখন উপেক্ষা করা যায়। ভাগাড়ের ইতিহাস বোধহয় তা ই শিখিয়েছে এই আদ্দিকালের শহরকে।

খাবারের পাতে ধর্মের ছদ্মবেশে রাজনীতির আস্ফালন ও বিরিয়ানি

 ২০১৯ জুন মাসের প্রথম দিকে এই শহর দেখল অদ্ভুত এক ঘটনা। যা ইতিপূর্বে এই বাংলা দেখে নি কখনও। চারপাশে ঘটে চলা অসহিষ্ণুতার প্রেক্ষিতে এই ঘটনা মারাত্মক ইঙ্গিতবাহী। একটি ব্যাক্তিগত উদ্যোগে কিছু মানুষজন কলকাতায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জনজাতির খাবার নিয়ে আয়োজন করে একটি খাদ্য উৎসবের। গরু, ছাগল, শুয়োর ও মাছের বিভিন্ন পদ দিয়ে সাজানো ওই উৎসবের নাম রাখা হয় ‘বিফ ফেস্টিভ্যাল’। উদ্দেশ্য পাকস্থলির উৎসব যাপনের মাধ্যমে সামাজিক সম্প্রীতির উদযাপন। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই খবর প্রচারিত হতেই জামার আস্তিন গুটিয়ে মারমুখি হয়ে ওঠে তীব্র ধর্মীয় ভাবে গোঁড়া কিছু সংগঠন। অনুষ্ঠানটির আয়োজকদের উদ্দেশ্য করে কটূক্তিতে ভরে যায় সামাজিক মাধ্যম। ঘটনার তীব্রতা এমন হয়ে পড়ে যে ‘বিফ ফেস্টিভ্যালে’র নাম বদলে ‘বিপ ফেস্টিভ্যাল’ করতে বাধ্য হয় আয়োজকরা। তাতেও ক্ষান্ত হয় না ধর্মান্ধ সমাজ রক্ষকরা। 

অনুষ্ঠানের আয়োজকদের কাছে আসে প্রায় ৩০০টিরও বেশি হুমকি ফোন। আয়োজকদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অনুষ্ঠানটি বাতিল করবার। এই বিপ ফেস্টিভ্যালের বন্ধ হয়ে যাওয়া এ শহরের খাদ্য সংস্কৃতিতে ধর্মীয় সংগঠনের রক্তচক্ষু ও প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক অনুপ্রবেশের নিরিখে নিঃসন্দেহে একটিযুগান্তকারী ঘটনা। ভবিষ্যৎই বলবে কোন যুগের সূচনা করল এই ঘটনা।

সার্বজনীন খাবার, এ শহর কাউকেই খালি পেটে ফেরায় না

বাংলায় খাবারের পাতে মাংসের জাত কোনও দিনই ধর্মের নিক্তিতে মাপা হয় নি। এ শহর খাবারের স্বাদ, গুণগত মান এবং দামকেই গুরুত্ব দিয়ে রসনা বিলাসে মেতেছে। অপেক্ষাকৃত কম রেস্তওয়ালা, গরীব গুর্বো মানুষ জন কেও এ শহর বিমুখ করে নি। রাজপথ থেকে রাজ দরবার সর্বত্রই বিরিয়ানির অবাধ পদচারনা। ব্রিগ্রেড কাঁপানো রাজনীতির অলিন্দেই হোক কি ইডেনে শীতের রোদে উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকা স্কোর বোর্ডকে একধারে রেখে বিরিয়ানির মোড়ক খুললেই বাঙালির আর থাকে 'না লাজ লজ্জা, ঘোচে সাজসজ্জা' এক অমোঘ টানে বিরিয়ানির ঘ্রাণে সে মন্ত্র মুগ্ধের মত আবিষ্ট হয়ে পড়ে। 

এ শহরে সব চাওয়া পাওয়া মেটে না সবার। কারও কারও দিনের শেষে ম্লান মুখ কাকেশ্বর কুচকুচের মতই অন্ধকার হাতে ধরা শুধই পেন্সিল। তবুও সেই রোজকার জীবনের সংগ্রামে বীর মানুষগুলোর জন্যই তো সাদা হলুদ ভাতের ফাঁকে আলু, ডিম, আর মাংসের আহ্বান। তবুও তো আর পাঁচটা দিনের সাদামাটা ভাতডালতরকারী জীবনে বীর বেশে বিরিয়ানির পদার্পণ সাদাকালো জীবনটাকে এক লহমায় রঙিন করে তোলে। এ হেন অন্ন তো বীর অন্নই বটে। আমরা যদি বিরিয়ানিকে তাই আদর করে “বীর অন্ন” বলে ডাকি তা কি খুব ভুল হবে?

Sunday, September 11, 2022

ওঁদের জীবনের ম্যাজিকে হার মেনেছে ৯/১১

সহজ কিছু বিষয়। রোজকার জীবনে ঘটে যাওয়া জীবনের দৈনন্দিন কিছু যাপন। কিছু আপাত হতাশাব্যাঞ্জক ঘটনার ছদ্মবেশে আশীর্বাদ এসেছিল ওঁদের জীবনে। ১১/০৯/২০০১ হতে পারত ওঁদের জীবনের শেষ দিন। অথচ ওঁরা বেঁচে গেছেন জীবন নামক এক অদ্ভুত ম্যাজিকের ভোজবাজিতে। আজ ওঁদের গল্প। নাকি গল্প হলেও সত্যি! 

ঘটনাঃ১ মায়ের ডাক

২০০১ এর ১১ সেপ্টেম্বর। 
হলি উইন্টার ও তাঁর কলেজের বন্ধুরা একটি গেট টুগেদার পরিকল্পনা করেন। উইন্টার, সেই সময়ে ডেনভার শহরে থাকতেন, ১১ই সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে ছিল সেই সারপ্রাইজ গেট টুগেদার। কলেজে হলি উইন্টারের দুই প্রিয় বন্ধু, যাঁরা শিকাগো এবং নিউ ইয়র্ক সিটিতে থাকতেন তাঁদের গেট টুগেদার। পরিকল্পনা ছিল দুই বন্ধু আগের রাতে নিউ ইয়র্কে উড়ে গিয়ে ঠিক সকাল ৮টায় অপর বন্ধুর টুইন টাওয়ারের অফিসে শ্যাম্পেন এবং ক্যাভিয়ারের প্রাতঃরাশ নিয়ে হাজির হবেন।
হলি উইন্টার

উইন্টারের মা নিউইয়র্কের আপস্টেট অঞ্চলে থাকতেন। উইন্টার তাঁর মাকে এই খবর জানাতে তিনি বলেন যে তিনি তিনি মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে ডেনভার যাচ্ছেন। অনেক অনুরোধেও উইন্টারের মা সেই ট্রিপ বাতিল করেন না। ফলে বাধ্য হয়েই নিজের সারপ্রাইজ পিকনিক বাতিল করেন হলি উইন্টার। তবে তাঁর শিকাগোর বন্ধু চলে যান নিউইয়র্ক। সারপ্রাইজ ব্রেকফাস্টের পরিকল্পনাও সফল হয়। দুই বন্ধু সকাল ৮টায় ফোনও করে তৃতীয় বন্ধু, হলি উইন্টারকে।  তাঁরা বেশ কিছুক্ষণ হাসি ঠাট্টা মশকরা করে কথা বলে ফোনে। আর তারপরই মারাত্মক সেই ঘটনা। অদ্ভুত ভাবে উইন্টার বেঁচে গেলেও তাঁর দুই বন্ধুকে কেড়ে নেয় ৯/১১র নাশকতা হামলা। 


ঘটনাঃ২ ছুটির ছন্দে বাঁচল প্রাণ

দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা ব্রেন্ডা ক্রিস্টেনসেন পাবলিক রিলেশন ব্যবসার জন্য প্রতি বছর ম্যানহাটনের টুইন টাওয়ারে তার বার্ষিক মিডিয়া সফর রাখতেন। ক্লায়েন্ট, সম্পাদক এবং সাংবাদিকদের সাথে অনুষ্ঠিত হত এক সপ্তাহব্যাপী সাক্ষাতকার। কোনও দিন এর অন্যথা হয় নি। 

ব্রেন্ডা ক্রিস্টেনসেন  

শুধু ২০০১এ এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়। সেই বছর তিনি ছুটিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সে বছর ম্যানহাটনের ডাউনটাউনে না থেকে, ক্রিস্টেনসেন জ্যামাইকায় তার বৌদির সঙ্গে দেখা করে নিউ অরলিন্সের একটি হোটেলে রাত কাটিয়েছিলেন। পরের দিন এই খবর পেয়ে তিনি আঁতকে ওঠেন। 


ঘটনাঃ ৩ অকারণ দেরি, ভাল

জেমস স্টেফুরাক

জেমস স্টেফুরাক শেয়ার ট্রেডিং করতেন। তাঁর সকালের মিটিংয়ের জন্য রোজই সকাল ৯টার মধ্যে টুইন টাওয়ারে পৌঁছতে হত। কিন্তু ১১ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে অদ্ভুত ভাবে ধীর লয়ে দিন শুরু হয় জেমস স্টেফুরাকের। তিনি তাঁর প্রতিদিনের শিডিউল থেকে প্রায় ২০ মিনিট লেটে চলছিলেন। আর তারপর যখন টেলিভিশন অন করেন তখন দেখেন বীভৎস সেই ঘটনা। আজও ভাগ্যকে আর তাঁর দেরি হওয়াকে ধন্যবাদ দেন জেমস। এখন জেমস বিবাহিত এবং চার সন্তানের পিতা।  

ঘটনাঃ ৪ সম্পর্কে ভাঙন অভিশাপ নয় 

ক্রিস্টাল ব্রাউন

ক্রিস্টাল ক্লিয়ার কমিউনিকেশনের সিইও এবং প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টাল ব্রাউন-টাটাম ২০০১ এ বিয়ে করেন। ওই বছরের জুনে তাঁর নিউ ইয়র্ক সিটিতে বসবাস করার পরিকল্পনা ছিল। টুইন টাওয়ার টু-তে কর্মরত মরগান স্ট্যানলি ডিন উইটারের কাছ থেকে চাকরির প্রস্তাবও ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তিনি এমন কিছু বিষয় আবিষ্কার করেন যাতে তিনি বিবাহের সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসেন।। যখন ৯/১১ হয়েছিল, তখন তিনি আতঙ্কে অসাড় হতে যান। কারণ সব যদি ঠিকঠাক থাকত তাহলে সেই মঙ্গলবার ওয়ার্ল্ড ট্রেড টাওয়ার 2-এ তাঁর কাজ করার কথা। একটি ভাঙা সম্পর্ক এভাবেই  একটি আশীর্বাদের মোড়কে জীবন বাঁচিয়েছিল ক্রিস্টাল ব্রাউনের। 

ঘটনাঃ ৫ গাড়ি খারাপ-ভাল

জর্জ কিথের নতুন বিএমডব্লিউ ১০ সেপ্টেম্বর ২০০১ অপ্রত্যাশিতভাবে ফার্স্ট গিয়ারে চলে যায়। ম্যানহাটনের ডাউনটাউনে সকাল ৮টায় মিটিংয়ে যাওয়ার আশা নিয়ে তিনি পরের দিন সকাল সাতটায় গাড়ি সারাতে ডিলারশিপে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেন। সাতটায় বিএমডব্লিউ ওয়ার্কশপে গিয়ে দেখেন মেকানিক নেই। মেকানিক্স আটটার আগে আসবেন না।

জর্জ কিথ 

তাই  তিন মিনিটের মেরামতের জন্য এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় জর্জ কিথকে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টাওয়ার টু-এর ৭৩ তলায় মিটিংয়ে যাওয়ার জন্য তিনি যখন গাড়ি সারিয়ে রওনা হন। তখন এক্সপ্রেসওয়েতে থিকথিকে জানজট। একটা প্লেন হিট করেছে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। দ্বিতীয় বিমানটি উড়ে যায় তাঁর মাথার ওপর দিয়ে। ট্রাফিক জ্যামে আটকে রেডিওয় খবর শুনতে শুনতে দেরি করে আসা মেকানিককে মনে মনে ধন্যবাদ দেন জর্জ। 

ঘটনাঃ ৬ স্মোকিং সেভস লাইফ

গ্রিয়ার এপস্টেইন, তখন দ্বিতীয় টাওয়ারে মরগান স্ট্যানলির একজন এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর। তিনি সকাল সাড়ে সাতটায় অফিসে আসেন।  ইমেল চেক করে কিছু স্টাফ মেম্বারদের সঙ্গে দেখা করে ৪৩ তলায় ক্যাফেটেরিয়ায় যান। কফি সহযোগে ব্রেকফাস্ট করে ৮টা ৪০এ,  একজন সহকর্মীর কাছ থেকে একটি কল পান যিনি পরামর্শ দেন যে তাঁরা সিগারেট খেতে খেতে পরবর্তী বৈঠকের জন্য প্রস্তুতি নেবেন৷
গ্রিয়ার এপস্টেইন

সেই মত গ্রিয়ার সিগারেট কেস নিয়ে লিফটের দিকে রওনা দেন। নিচের তলায় পৌঁছানোর সাথে সাথে লিফট  লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে।  ততক্ষণে প্রথম  টাওয়ারে বিমান হানা হয়ে গেছে। তিনি দেখেন টাওয়ারের গায়ে একটি বিশাল গর্ত। তারপর শুধু হাহাকার আর আর্তনাদ। চোখের সামনে দ্বিতীয় প্লেনটিও হামলা চালায়। হয়ত গ্রিয়ার এপস্টেইনও ৩০০০ মৃতের মধ্যে একজন হতেন। কিন্তু অদ্ভুতভাবে তাঁকে বাঁচিয়ে দেয় একটি স্মোকিং ব্রেক। 

ঘটনাঃ ৭ হাতছাড়া ট্রেন বাঁচাল জীবন
৭ সেপ্টেম্বর ছাঁটাই হন লরা সোরোকফ গেলম্যান। তারপর থেকে রোজ তিনি চাকরির খোঁজে পোর্ট এলাকায় যেতেন। সকালে তাঁর যাতায়াতের সময়ে তিনি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার স্টেশন থেকে পোর্ট অথরিটির পাতাল রেলে চড়তেন।  ১১ সেপ্টেম্বর  সকালেও ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের পাশে বেকারত্বের অফিসে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি।  কিন্তু ভিড়ের জন্য সেদিন ট্রেনে উঠতে পারেন নি। আর এতেই প্রাণ বেঁচে যায় লরার। 



  
  


Saturday, August 20, 2022

স্মৃতি অফ জয়ঃ বন্ধু বাইলেন - সংবাদ প্রতিদিনের ক্রোড়পত্র 'রোববারে' প্রকাশিত



২৩ জুন ২০০৮ । '৮৩-র বিশ্বকাপজয়ী সদস্যরা একযোগে এর আগে কোনও ঘরোয়া পার্টিতে মিলিত হননি। পার্টি হচ্ছে দিল্লির 'সুন্দর নগর'-এর ৩৯ নম্বর ঠিকানায়। যে-বাড়ির মালিক কে,দেব। আর,ইনিই কি '৮৩-র কাপজয়ী ক্যাপ্টেন কপিল দেব নন? এই একান্ত আড্ডায় মিডিয়াকে স্বাগত জানানো হয়নি। কিন্তু ঘটনাচক্রে আমি পেরেছিলাম মোচ্ছবের অংশীদার হতে। আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন খোদ কপিল দেব! 

আমাদের স্কুল বয়সে রেডিও-ই ছিল দূরের জানলা। তাও সেটা সব সময় সহজলভ্য ছিল না। 'মারফি মিনিব্য ডিলাক্স'-এর ব্যাটারি কমে গেলে বা ঝড়-জলে সিগন্যাল ডিস্টার্বড হলে রেডিও শোনার মজাটাও কিরকিরে হয়ে যেত। তখন ধারাবিবরণী শোনার চেয়ে পাড়ার খেলার মাঠই বেশি ডাকত। যেহেতু বেড়ে ওঠার রেলওয়ে কলোনিটা কলকাতা থেকে অনেক দূর, জেলায়- তাই খবরের কাগজ যখন হাতে এসে পৌঁছত, তখন বোধহয় পরের দিনের কাগজ অর্ধেকটা ছাপা হয়ে যেত। আমাদের নিস্তরঙ্গ জীবনযাপনে ঢিল মেরে যেত শেষ বিকেলে হাতে পাওয়া সংবাদপত্রের শিরোনাম। '৮৩-তে ভারতের বিশ্বকাপ জেতার 'সেলিব্রেশান' নেহাতই 'নাদান বয়স' আর ভৌগলিকভাবে আলোকবৃত্তের অনেক বাইরে থাকায় ভালভাবে আঁচই করতে পারি নি। 

কিন্তু জীবন আচমকা কত কী দেয়!

২৫ বছরের একটা টাইম ল্যাপ। 

কাট টু ২৩ জুন ২০০৮। দিল্লির 'সুন্দর নগর'-এর ৩৯ নম্বর বাড়ির বাইরের রাস্তা। বাড়িটার নাম-ফলকে লেখা মালিকের পরিচয়-- কে, দেব। আমার সঙ্গী রেডিওর বদলে ক্যামেরা। রিপোর্টার দেবাশিসের সঙ্গে সেই পড়ন্ত বিকেলে পায়চারি করছি। আজ একটা ফাটকা খেলছি আমরা। ৮৩'-র বিশ্বজয়ী দলের 'সাপোর্ট স্টাফ'-দের কানাঘুষোতে আড়ি পেতে পাওয়া একটা 'টিপ'(Tip)- কে 'লক্ষ্যভেদ' করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। দেবাশিস বলছে-'১৯৮৩-র ২৫ জুন ওয়ার্ল্ড কাপ জেতার পর থেকে টিমমেট-রা একসঙ্গে কোনও পার্টি করেনি। আজ এই বাড়িতে ২৫ বছরের তুলে রাখা সেই পার্টি! ভাবতে পারছিস? ছবি পেলে কী স্টোরি হবে! আনবিলিভেবল!' তখন ওর রক্তচাপ মাপলে পারদ স্ফিগমোম্যানোমিটারের স্কেলের উচ্চসীমায় ঠোক্কর খাচ্ছে দেখা যেত হয়ত! দুপুর থেকে এই একই কথা বারবার বলে চলেছে। 

বিকেল ধীরে ধীরে সন্ধ্যের হাত ধরে রাতের কাছাকাছি যেতে চাইছে। ইতিমধ্যে সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের কেউকেটা দু'-তিনটে চ্যানেলের ডাকসাইটে কয়েকটা চেনামুখের আনাগোনা দেবাশিসের চোয়াল শক্ত করে দিচ্ছে বারবার। বিড় বিড় করে বলতে শুরু করল- ' কেঁচে গেল রে! এক্সক্লুসিভ থাকল না স্টোরিটা।' এরই মাঝে একটা চ্যানেল 'ওবি ভ্যান' পাঠাবে কি না জানার জন্য প্রতিনিধিকে ফোন করল। এপার থেকে- ' সারজি ইয়ে ইনলোগোঁ কি প্রাইভেট পার্টি হ্যায়। বিসিসিআই, স্পন্সর্স কোই ভি অ্যালাউড নেহি হ্যায়, তো মিডিয়া ক্যায়সে অন্দর যা পায়েগি?' ওপার থেকে কী নির্দেশ এল বুঝে ওঠার আগেই ময়দান ফাঁকা। বাকিরাও মহাজনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জুনের সেই সন্ধ্যায় মার্চ করল।

সন্ধ্যের পড়ে-যাওয়া আলোয় মরে যাওয়া আশা আর দেবাশিসের চোখ- দুটোই একসঙ্গে উজ্জল হয়ে উঠল। খোঁজখবর সিদ্ধ চোখ ততক্ষণে দেখে নিয়েছে ৩৯ নম্বর বাড়িটার ভিতরে জ্বলে-ওঠা নরম মোমের আলোগুলো। যারা হাজার বাতির ঝলকানিতে অনায়াস, তাদের নিশিযাপনের 'ট্রেলার' এর আভাষ পেয়ে 'দিল' তখন 'মাঙ্গে মোর'।

ধীরে ধীরে দিল্লির সন্ধ্যে সাবালিকা হচ্ছে। আর বাড়িটার সামনে এক একটা সম্ভ্রান্ত গাড়ি এসে দাঁড়াচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে আসছেন সৈয়দ কিরমানি, দিলীপ বেঙ্গসরকর, সুনীল গাভাসকর, কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত, শ্যাম্পেন হাতে কীর্তি আজাদ। একটা করে ছবি হচ্ছে, দেবাশিসের হাসি চওড়া হচ্ছে। এরপর এসে দাঁড়ানো গাড়ি থেকে নাম্লেন '৮৩র ফাইনালের লাস্ট ল্যাপের 'গোল্ডেন বয়' মহিন্দর অমরনাথ, সস্ত্রীক। এদিকে ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে আজকের 'এক্সট্রা টাইম'-এর 'ডেটলাইন' পেরল। 'ফিড' পাঠিয়ে আজকের বুলেটিনে এই খবরটা ধরানো যাবে না। আর অ্যাসাইনমেন্ট-টায় যা সময় লাগবে, মনে হচ্ছে ততক্ষণ খাবারের সব দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। বিস্কুট খেয়েই আজকের রাতটা কাটাতে হবে। ওদিকে ৩৯ নং বাড়িটার স্নিগ্ধ রোশনাইয়ে উজ্জ্বলতা জোগাতে আগমন হয়েই চলেছে 'ভিভিআইপি' অতিথিদের। সন্দীপ পাটিল, বলবিন্দর সান্ধু, রজার বিনি আর মদন লাল। হঠাৎ মা-র কথা মনে পড়ল। 

নিতান্ত বোতল খাওয়ার বয়সে রেডিও চালিয়ে গানের ষড়যন্ত্রে আমাকে ঘুম পাড়াত মা। একবার নাকি বোতলে দুধ শেষ, আর রেডিওতে গান শেষে শুরু হয়েছে ক্রিকেট-ধারাবিবরণী। বহু দূর কোনও ক্রিজে আউট হয়েছেন ব্যাটসম্যান মদন লাল। কমেন্ট্রেটরের গলায় হা- হুতাশ- 'অউর ইয়ে মদনলাল আউট!' রেডিওটার ধারে  পাশে থাকা শ্রোতাদের হতাশাব্যাঞ্জক চিৎকার ছোট্ট 'আমি'-টাকে বিচলিত করে এক অদ্ভুত উল্লাস দিয়েছিল। আধা-বোধের সেই দিনগুলোয় 'আউট' শব্দের অর্থভ্রমে কাচের ফিডিং বোতল মাটিতে ফেলে ভাঙা কাচের ওপরে নাকি শুরু করেছিলাম  তুড়ুক নাচ। মুখে চিৎকার, 'মদনলাল আউত মদনলাল আউত।' পরে মনে হয়েছে ভাঙা কাচের মধ্যে না বুঝে নেচে আমার চারপাশে সেদিন না-জানি কত গব্বর সিং তৈরি করেছিলাম। হাফপ্যান্ট থেকে ফুলপ্যান্ট হওয়া কৈশোরে এই ক্যাবলামির ঘরোয়া ধারাবিবরণীতে শৈশবে জড়িয়ে থাকা নিতান্ত গুরুত্বহীন এই ঘটনায় কতবার যে আমাকে বিব্রত,লজ্জিত করেছেন মদন লাল। 

সম্বিত ফিরে পেলাম এক পরিচিত কণ্ঠের ডাকে- 'আপ এক হেল্প করেঙ্গে?'

উঁচু লোহার গেটটা থেকে বেরিয়েছেন কালো হাইনেক টি-শার্ট আর জেড ব্ল্যাক জিনস পরা 'পামোলিভ কা জওবাব নেহি' হাসিওয়ালা লোকটা। কোলে লোমশ দুধ-সাদা পোষ্য সারমেয়। আড়ষ্টতা নিয়ে এগিয়ে গেলাম। বললাম- টেল মি স্যার হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ? ক্যাপ্টেন দেব ব্ললেন-'অন্দর সাবলোগ পার্টিমে হ্যায়। আপ থোড়া উনকি ভিডিও শ্যুট কর দেঙ্গে?' 

বলে কী লোকটা? অনুরোধ? কী বলব একে? এ কি মেঘ না চাইতেই আকাশ ঝেঁপে বৃষ্টি? না কি সূর্যোদয়ের আগে ঝকঝকে রোদ? সম্মতি দিতেই আবার বললেন-'লেকিন এক বাত, কিসিকো ডিস্টার্ব মত করনা আপ।' 

বাড়ির মালিকের সঙ্গে গেট পার করে লালচে মার্বেল পাতা ড্রাইভওয়ে পার করে ফুল দিয়ে সাজানো লনটায় যখন ঢুকলাম, তখন অদ্ভুত এক সাম্রাজ্য সেখানে। ভারতের ক্রিকেট-রংবাজির শুরুয়াতের নায়করা বসেছেন নিজস্ব মজলিসে। সঙ্গত দিচ্ছে 'সুন্দর নগর' এর সুন্দরতম এই বাড়ি। আর বাড়ির মেহমান নওয়াজ মালিক। রুচিবোধ, পরিমিতিবোধ আর আন্তরিকতা মিশিয়ে এক স্বপ্নিল প্রতীক্ষার শেষে দাঁড়িয়ে আজ সাফল্য উদযাপন করছে এই বাংলোর প্রতিটা ইট,কাঠ, ঘাস,পাতা,আলো,বাতাস।  মৃদু গান বাজছে। শ্যুট শুরু কি করব? উত্তেজনায় বুকে একশো হাপরের টান। কানে বাজছে,' কোই ভি অ্যালাউড নেহি হ্যায়, তো মিডিয়া ক্যায়সে অন্দর যা পায়েগি?' মনের মাথায় মনে-মনে থাপ্পড় মেরে ঠাণ্ডা করলাম। পুরো অ্যামবিয়েন্সটা ক্যামেরাবন্দী করব চেষ্টা করছি। সব শব্দ, সব বর্ণ। হতাশ লাগছিল, সুগন্ধগুলোকে কেন যে ক্যাপচার করার কোনও উপায় নেই! ঘাসে ঢাকা ছোট্ট লনটাতে 'বাফেট কাউন্টার'। মাথায় পাগড়ি পরা শেফ-রা ব্যস্ত খাবার পরিবেশনে। রকমারি স্যালাড, স্টার্টার, মেইনকোর্স পার করে আসছে সুমিষ্ট ডেজার্ট। মাঝে মাঝে 'নহবত'-এর পুতুল মিনিয়েচার। সত্যিই তো, কাপ জেতার সানাইটা এত-দিন একসঙ্গে শোনা হয়ে ওঠেনি এঁদের। কাঠের গুঁড়ি দিয়ে বানানো টুল-চেয়ার। ব্যালকনিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মহারথীরা নৈশভোজে ব্যস্ত। আবহ-র পর এবার প্রত্যেক নায়কদের 'অলগ অলগ ক্লোজ আপ' নিতে হবে। শট ডিভিশনের আবদারটি স্বয়ং কপিল পাজি-র। অতএব ক্লোজ-আপ পর্ব শুরু। 


সেই পার্টির এক্সক্লুসিভ ছবি 

ডিনার তখনও ভেরি মাচ অন। মৃদু শাসন কানে ভেসে এল-'ডোন্ট এভার শ্যুট, হোয়েন সামওয়ান ইজ ইটিং!' বক্তা সুনীল মনোহর গাভাসকর। কী সত্যি,অথচ সহজ কথা! খাওয়ার সময় ক্যামেরার শাসন তো একপ্রকার 'পানিশেবল অফেন্স!' আজও কথাটা সযত্নে মেনে চলি। এদিকে খোশ-আড্ডায়, ঠাট্টায়, বিগত ইতিহাস, বিগত ঝগড়া, বিগত সাফল্যের সতীর্থরা বলছে- ' বন্ধু কী খবর বল, কত দিন দেখা হয় নি!' 

অটোগ্রাফ নিচ্ছেন কপিল দেব 


এই জমায়েত তো কত দিন আগে হওয়ার! এই সাফল্য শ্যাম্পেনে চুমুক তো এক প্রজন্ম আগে দেওয়ার কথা! অনেকগুলো ব্যস্ত বছর পার করে আজ ওঁরা মুখোমুখি একসঙ্গে। ফ্রেমে বাঁধানো এক শিল্পীর আঁকা রম্যচিত্র হাতে ক্যাপ্টেন। অটোগ্রাফ করাচ্ছেন সহকর্মীদের ওই ছবিটির ওপর। কারণ ছবির বিষয়-কাপ হাতে তিনি। কপিলের বাড়ির দোলনায় কীর্তি আজাদ তখন মৃদু দুলছেন আর স্মিত হাসছেন। '৮৩র দলে না থাকলেও অজয় জাদেজাও উপস্থিত হাসিমুখে। এবার শেষের শুরু। বিদায় নেওয়ার পালা। 'হোস্ট' যেন তাঁর ব্যবহারে সবাইকে বলতে চাইছেন, এটা তোমাদের সব্বার বাড়ি, তোমাদের একসঙ্গে পেয়ে আমি পঁচিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া যুদ্ধজয়ের জন্য ধন্যবাদ দিতে চাই। আর মেহমানরা যেন বলে যাচ্ছেন,'হাম সাথ সাথ হ্যায়'। আগামীকাল কাকভোরে গোটা দল উড়ে যাবে হিথরো। সেখান থেকে লর্ডসের ব্যালকনিতে। ২৫ বছর পর, ২৫ জুন ২০০৮ আবার ওঁরা লর্ডসে। আবার ওই দলটা। ওটা কপিলের ইন্ডিয়া।

আমারও ঝাঁপ বন্ধ করার পালা। কপিলের সেক্রেটরি নাম-ধাম, কোন হোটেলে আছি, কীভাবে ভিডিও ফুটেজটা সংগ্রহ করবেন জেনে নিলেন। ক্যাপ্টেন এসে বললেন 'আপ ডিনার জরুর করকে যাইয়েগা।' আবদার করে বলে বসলাম- আপনার একটা 'বাইট' পেলে খুব ভাল হয়। রাজি হয়ে গেলেন। গেটের বাইরে অপেক্ষারত সহকর্মী দেবাশিস সেন-কে ডেকে আনা হল। সারা হল অনেক না বলা কথায় ভরা সাক্ষাৎকার। তারপর পার্টির হোস্টের তত্বাবধানে এক 'উমদা' ডিনার। 'হরিয়ানার হ্যারিকেন'-এর সৌজন্য আর আতিথেয়তার ঝড়ে উড়তে উড়তে তখন আমরা ভাসছি সাতওয়া আসমানে!

পরে অনেক ভেবেছি। স্পন্সরমুখী, বিপণনমুখী 'সব কুছ বিকতা হ্যায়'- মার্কা 'মেড ইন ইন্ডিয়া'-য় এই পার্টিটাও নিশ্চয় দারুণ একটা 'কমোডিটি' হতে পারত। কিন্তু হতে হতে দিলেন না কপিল দেব ও তাঁর কমরেডরা। কেন গোপনীয়তার মোড়কে আদরে মুড়ে রাখা হল এই সম্মেলন? আসলে ওঁরা হয়ত এখনও বিশ্বাস করেন, পৃথিবীতে এমন অনেক কিছু আছে যেগুলো সযত্নে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে হয়। 'দোস্তি' শব্দটারও একটা সুন্দর মানে পেলাম। আর দেখলাম, এই সব কিছুর নায়ক যিনি, তাঁর নায়ক হয়ে ওঠার নেপথ্যের মানুষগুলোর সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়া, সম্পর্ক। যার জোরে তিনি এই তথাকথিত প্রচারের লোভ সংবরণ করার শক্তি পেয়েছিলেন সেদিন। এটা করতে অদম্য দম লাগে। যে দম-এর নাম কপিল দেব নিখাঞ্জ। আমাদের পোড়া দেশে যার চওড়া হাসিতে অভয় পেয়ে আসমুদ্রহিমাচল এক স্বপ্ন দেখতে-দেখতে কখন যেন একটা খেলাকে ধর্মে পরিণত করে ফেলল।

আমরা যারা আশির দশকে বড় হয়েছি, তাদের মিডল স্ট্যাম্পে কপিল আর বাউন্ডারিতে সুনীল। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং, টেলিমিডিয়া, ঝিনচ্যাক জীবনযাত্রা থেকে 'মিলো দূর' থাকা আমাদের কৈশোরের ভারত। ফেলুদা,ডাকপিওন,চুইংগাম,কলিংবেল,ফুলন দেবী, দূরদর্শন, অল ইন্ডিয়া রেডিও ভরা আমাদের জীবনে '৮৩ ছিল চেটেপুটে, চুষে-চিবিয়ে খাওয়া একমাত্র তৃপ্তির নাম। 

এসব শুনে আমার এক বিশ্বনিন্দুক বন্ধু ব্লল-'ধুস,সব নিউমারোলজি, বুঝলি? আসলে ৮ আর ৩ হল ১১। ভারতীয় ক্রিকেটে ১৯৮৩ আর ২০১১ বিশ্বকাপের বছর। শেষ দুটো সংখ্যা ১১। আর এবারও ১১। এবারও তাই হবে।' 

আমি বললাম, ১ আর ৫ যোগ করলেও ১১ হয়? চ্যাংড়ামি হচ্ছে!

ও বলল - 'তোরা না পেশাদার অবিশ্বাসী! আরে এবার একে-পাঁচে ১১ নয়, এটা হল ১১ নম্বর বিশ্বকাপ। এবারেও মেন ইন ব্লু, টিম ইন্ডিয়া।'

শুনে ভাই বলল-'কিস্যু ফলো করো না! ট্যুইট-এ ক'জন ফলোয়ার তোমার? হ্যাসট্যাগ ওন্ট গিভ আপ (#won'tGiveUp) শোনোনি?' ভ্যাবলা মুখে ক্যাবলা হয়ে বসে গেলাম ডিজিট্যাল মার্কেটিং চোস্ত 'ট্যুইটার কিং' ভাইয়ের সামনে।