Saturday, March 10, 2018

টান টান, টাই টান, বা টাকাপয়সার টানাটানি, সবই আসলে টাটা

মুম্বাকা শহর একটা ওয়াইড শট। ক্রেন মুভমেন্ট শুরু। কাট টু একটা ট্যাক্সির ভিতর। চেনা ক্যাটরিনা, পরিচিত তোতলা রণবীর।             ক্যাট --- হোটেল        আগাপাশতলা
                                           ট্যাক্সি চালক --- হুইচ আগাপাশতলা ?
                                                       ক্যাট --- কিতনি আগাপাশতলা ?
                                           ট্যাক্সি চালক --- ১০০ টোটাল ইন মুম্বাকা নেশন
                                                    রণবীর --- নো নো ৯৮
                                                       ক্যাট --- আই হোপ হি ইস জোকিং রাইট !
                                                     রণবীর --- জেইসে বিকানির কি গলি গলি মে হ্যায় বিকানিরী ভুজিয়াওয়ালা ওই সে মুম্বাকা কে হর এক মোড় পে হ্যায়                                 হোটেল আগাপাশতলা
আগাপাশতলা ভিরমি খাওয়ার জোগাড় অভিনেত্রী সহ গোটা হলের দর্শকদের। আসলে বাঙলার থেকে দূরে বড় হলেও বাঙলার থেকে ভৌগোলিক দূরত্বে কাজকর্ম করলেও পরিচালক অনুরাগ বসুর বাঙালিয়ানা মজ্জায় মজ্জায় লোহিত রক্ত কণিকায়। অনুরাগ এর প্রতিটি কাজ এ ( মানে সিনেমায়) হয় পরিষ্কার নয়তো প্রচ্ছন্ন ভাবে থেকে যায় বাঙালিয়ানা। হোটেল আগাপাশতলা , টিকটিকি স্টেশন, শুন্ডি আসলে সেই গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজোর ই প্রয়াস। ছবি তে ছুটে আসে ছেলে বেলার সবুজ ট্রেন যার বাদামি ধোঁয়ার পিছনে হারিয়ে যাই সাদা বেগুনি বগি গুলো।
মনে হয় আমাদেরও অমন একটা শৈশব ছিল যখন দিনগুলো সহজেই, কত সহজেই রঙিন হত। একটা হাঁসের ডিমের কুসুম রঙা সূর্য ছিল। একটা শীতের কমলালেবুর মতো বিকেল ছিল। একটা চার ছক্কা বাউন্ডারিতে সুনীল ছিল। একটা স্ট্যাম্প ওড়ানো বোলিং এ কোথাও কপিল ছিল। সাদা কালো টিভির মাঝে নুক্কড় আর বুনিয়াদে ভরসা ছিল। পাওয়ার কাটের লোডশেডিং এ গা ছমছমে একানড়ের কানে চড়া গল্প ছিল। শৈশবের মজাই হল লো অ্যাঙ্গেল শট এ দুনিয়া দেখার মজা। সবকিছুই বড় লাগে। বিশাল লাগে। দারুন লাগে। সহজেই রোমাঞ্চ জাগে। তাইতো শিশু বালক ছাগল ছানার মত অবিরাম ছটফটে। বালিকা প্রজাপতির মত রঙিন পাখনায় উড্ডীন। অদেখা টিম্বাকটু বা ঝুমরিতালাইয়া র খোঁজে সর্বদা Busy Without Business.

যা বলছিলাম তার থেকে ভেসে দূরে চলে এলাম। বোধহয় বয়স এর দোষ। কথাহীনতায় রোজনামচা , কথাহীনতাই অভ্যেস হতে হতে কথা বলতে গেলেই নীরবতার অন্ধকারে জোনাকির মত ছুটে আসে কথারা। ছোটবেলায় মানুষ শব্দ শেখে। শব্দ খোঁজেও। অজানা শব্দ পেলে মানে জানতে চায়। কিছু মানে পায় কিছু পায় না। উত্তর পায় "বড় হও সব জানবে "
সত্যি কি জানা যায় ? পাওয়া যায় শব্দার্থ। সেই কোন আলো আঁধারির স্মৃতির সময় থেকে বিদায় অভিবাদন জানিয়ে এসেছি। টাটা। কতবার। কতজনকে টাটা বলেছি। টাটা করেছি। টাটা আসলে কী? সিনেমার জগ্গা জাসুস তো তাও শতেক হোটেল আগাপাশতলার মধ্যে আসল হোটেল আগাপাশতলা খুঁজে পেল কিন্তু আমার বেলা ? ক্যা হ্যায় ইয়ে টাটা কা মসলা ? ইংরেজি হাই ৫ এ টাটার মজা নেই আছে উদ্দামতা। টাটা করার মধ্যে বিষাদ বিষাদ মুখমন্ডলে মেঘ মেঘ চোখে অশ্রু মাখা হাসি নিয়ে প্রতীক্ষা আছে। আছে যেতে নাহি দিব র টান। আর সেই অদৃশ্য আকর্ষণেই বোধহয় ফিরিয়ে আনে প্রিয় মানুষ টিকে। ফিরিয়ে আনে ফিসপ্লেট খোলা রেলপথ বাঁচিয়ে , ব্রেকফেল রাজপথ এড়িয়ে , দুর্যোগের জলপথ মাড়িয়ে। ফিরিয়ে আনে এটিসি হারানো বৈমানিক কে , দিকভ্রষ্ট নাবিককে , জীবন যুদ্ধে মার খাওয়া সাধারণ আটপৌরে নাগরিককে।
সিধু গুগুল জ্যাঠার কাছেও টাটার মানে গুডবাই। শুধুই কি একটা ইন্টারজেকশন বা ধন্বাত্মক অব্যয়?
দাশরথী থাকিলে বলিতেন, "জন্ম যদি তব বঙ্গে তিষ্ঠ ক্ষণকাল! পাগল না হাফপ্যান্ট? বাঙলায় বাস করে টাটা কে অব্যয় বলছ? ওনলি স্কাই ইজ দ্য লিমিট ফর টাটা। মানে কিন্তু শুধু টাটা স্কাই না। ওরে সিঙ্গুরে সিঁদুরে মেঘ দেখোনি বাপু! টাটা অনুঘটক ছাড়া অমন রাজনৈতিক বিক্রিয়া সম্ভব! বিক্রিয়ার আগের লাল রঙের বাঙলার মাটি দুর্জয় কখন রঙ বদলে সবুজ হয়ে মা আর মানুষের হাত ধরে নিল। টাটা ঝামেলা বুঝে মুখ গুঁজল গুজরাতে। বিক্রিয়ায় অবিক্রিত টাটা অতএব টাটা অনুঘটক। " ওরে দাশু ওটা অবিক্রিত নয় অবিকৃত। দাশু বলত," যাহাই সর্বাধিক বিকৃত তাহাই সর্বাধিক বিক্রিত। আনন্দে বাজারে ঘোরো কাগজটাগজ দেখোনি? চলি আমার এখন টাটা চলছে।" টাটা চলছে? মানে? " আরে টা টা, টাকাপয়সার টানাটানি"।
তবে সে যাই হোক হজবরল বুলন্দ ভারতে টাটা কিন্তু এক উজ্জ্বল উচ্ছল ছবি। মণিবন্ধে শুধু সময়ের তালে তাল রাখাই নয় সে যেন অহঙ্কার, আঙুলে হীরক ছটার চোখ ধাঁধানো দ্যূতিতে এক উপাখ্যান। সর জমীন এ আসমান তার ব্যাপ্তি। কৃষিপণ্য, সার, পণ্য পরিবহন, অটোমোবাইল, মোবাইল ফোন ও পরিষেবা, ওষুধপথ্য, হোটেল হাসপাতাল, ইমারতি দ্রব্য থেকে এরোস্পেস রিসার্চ, মিডিয়া, মার্কেটিং, তথ্য প্রযুক্তি সব ক্ষেত্রে টাটার জয়জয়কার। খাবারে স্বাদের চাবিকাঠি নুন তাও টাটা সাম্রাজ্যের অবদান। সকালের চা দিয়ে আমাদের টাটারোজনামচা শুরু।
যত ট্রাক রাস্তায় চলে বেশিরভাগই টাটা। ট্রাক বলতেই পঞ্জাবি ড্রাইভার আর আসি টাটা আবার দেখা হবে, বা Ok TATA Fir Milenge, কখনও O TATA K কখনও আবার রাত্রে ডায়পার ব্যবহার করতে বললেও ধাবমান বাণীতে টাটার বানান ঠিক। Use Diper at Night OK TATA যেন জীবন নদীর সাঁতার কাটা ক্লান্ত এক পথিক বা প্রেমিককে আশ্বাস দিয়ে কালো পিচে চাকায় রুটির গন্ধ নিয়ে ছুটে চলেছে সে চালক, অন্ধকার রাতে। আলো ফুটলেই আসবে গন্তব্য , তারপর ঘর। তার আগে হাতে সময় কই! আসি ভাই টাটা।
এটা নাকি বলা হয় মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে জীবনের ঝাঁকি দর্শন করে মানুষ। পথ দুর্ঘটনায় ট্রাক চাপা পড়ে যার নটে গাছ মুড়োল তার কাছে আসি TATA তো পুনর্জন্মের প্রলোভন। তার ঝাঁকি দর্শনে তো ফিরবেই ফড়িং, বটের চারা, বুনো শালিক, নিদেনপক্ষে একটা খুচরো নগন্য চড়াই, পিঁপড়ে বা শ্যওলা। যে কোন রূপে আবার মৃত্যুর আগল ভেঙে ফিরে আসতে চাই। তাইতো যাই। টাটা তো আসলে যাওয়া নয় ফেরার প্রতিশ্রুতি  অঙ্গীকার।
শোনা যায় একবার কোন এক ইওরোপীয় হোটেলে ঢুকতে বাধা পান এক ভারতীয়। সেই হোটেলের দোরগোড়ায় ছিল এক বিজ্ঞপ্তি Dogs and Indians are not allowed inside সেই পরাধীন ভারতীয়  মনস্থ করেন এক প্রাসাদোপম হোটেল বানিয়ে উপহার দেবেন দেশের মাটিতে দেশীয় মানুষজনকে। তিনি আর কেউ নন জামসেটজি নাসেরওয়ানজি টাটা। প্রত্যয়ী প্রতিভাবানেরা বোধহয় এমন ই হন। কোন বিরোধ, ঈর্ষা, কলহের পাঁক তাদের স্পর্শ করতে পারেনা। তাঁরা নিজেদের লক্ষ্যে স্থির, অবিচল।
 গুজরাতের এক জরাথ্রুষ্টিয় পুজারি পরিবারে জন্মগ্রহণ করে ভারতের উজ্জ্বল অঁত্রপনিয়ে হয়ে ওঠা তাঁর জীবন ভারতীয় ইতিহাসে এক মহীরূহের মত। সাকচির আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামের যাঁর ছোঁয়াতে টিসকো হয়ে ওঠা তাঁর নিজের নাম একটা নামের গণ্ডি ছাড়িয়ে একটা ব্রান্ড একটা কালচার হয়ে ওঠা কোন রূপকথার চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়। সেই মানুষ বটগাছটির ১৭৯তম জন্মদিন সদ্য পেরোল। যদিও টাটা শব্দের অর্থ বিদায় বোধক কিন্তু আমাদের কাছে তার অর্থ আরও ব্যাপক আরও গভীর। যাকে ভেঙে খান খান করার ক্ষমতা কোন ২৬/১১র নেই।
আজকের মত টাটা।



No comments: