সত্যজিৎ রায়ের আত্মজীবনীমূলক লেখা যখন ছোট ছিলাম অনেকেরই পড়া। সত্যজিতের ছোট কাকা সম্ভবত সুবিনয় রায় ছিলেন ভোজন রসিক ও বিলাসী। মুখে খাবারের গ্রাস নিয়ে বত্রিশবার চিবোতেন। প্রতিটি খাবারের স্বাদ ডায়রিতে নোট রাখতেন। তো সেই বই তে তাঁর চা বিষয়ক একটি মজার লেখা আছে। মানে এক একরকম চা খেয়ে সেই চা দের চরিত্র বিশ্লেষণ। আগে সেটাই দেখি তারপর মূল লেখায় আসছি।
সত্যজিৎ বলছেন
" ছোটকাকা পেটুক না হলেও খেতেন খুব তৃপ্তি করে। রোজ এবারই ওবাড়ি গিয়ে চা খাওয়ার ব্যাপারটা ছিল একটা বিশেষ ঘটনা। ডায়রিতে এর উল্লেখ থাকত , তবে মামুলিভাবে নয়। যে চা -টা খেলেন তার একটা বিশেষণ , আর ব্রাকেটের মধ্যে সেই বিশেষণের একটা ব্যাখ্যা চাই।
একমাসের ডায়রি থেকে বারোটা উদাহরণ দিচ্ছি। ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে --
১) নৃসিংহভোগ্য চা (ভৈরবকান্তি-জনক ,হুহুঙ্কার প্রসাদক ,জোরালো চা )
২) বৈষ্ণবভোগ্য চা (নিরীহ , সুমিষ্ট , সুকোমল ,অহিংসক চা )
৩) বিবেকানন্দভোগ্য চা ( কর্মযোগস্পৃহাবর্ধক , বাগবিভূতিপ্রদ , তত্ত্বনিষ্ঠার অনুকূল উপাদেয় চা )
৪) ভট্টাচার্যভোগ্য চা ( বিজ্ঞতাবর্ধক ,গাম্ভীর্যপ্রদ , অনুগ্র ,হৃদ্য চা )
৫) ধন্বন্তরিভোগ্য চা ( আরোগ্যবর্ধক ,আয়ুষ্য ,রসায়নগুণ-সম্পন্ন চা )
৬) পাহারাদারভোগ্য চা (সতর্কতাবর্ধক , উত্তেজক , তন্দ্রনাশক চা )
৭) মজলিসী চা (মসগুল-মসগুল ভাবোদ্রেককারী চা )
৮) কেরাণিভোগ্য চা ( হিসাবের খাতা দেখায় উৎসাহবর্ধক , বাদামী স্বাদু চা )
৯) হাবিলদারভোগ্য চা ( হিম্মতপ্রদ , হামবড়াভাবের প্রবর্তক চা )
১০) জনসাধারণভোগ্য চা ( বৈশিষ্টহীন ,চলনসই চা )
১১) নারদভোগ্য চা ( সঙ্গীতানুরাগবর্ধক , তত্ত্বজ্ঞানপ্রসাদক , ভক্তি-রসোদ্দীপক চা
১২) হনুমানভোগ্য চা ( বিশ্বাসযোগ্যতাবর্ধক , সমস্যা-সমুদ্রলঙ্ঘনের শক্তিদায়ক , বিক্রমপ্রদ চা ) "
ছোট থেকে যতবার যখন ছোট ছিলাম পড়েছি এই জায়গায় এসে হাসি চাপতে পারি নি। কী পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ !!! কাজেই চা নিয়ে কিছু বলতে গেলেই ওই লাইনগুলো আগে খেলে যায় মাথায়।
আজ আবার একটা পুরোনো প্রকাশিত লেখা দিচ্ছি। লেখাটা লিখে আরাম পেয়েছিলাম। হুবহু তুলে দিলাম
এক কাপ চায়ে আমি...
প্রকাশিত হয় হ্যাংলা হেঁশেল সংখ্যা ৩১ এ
বিভাগ : পথেই হবে পাত চেনা
প্রকাশকাল : মে ২০১৫
কোন পথে যে পাত পাড়া আর কোন পথে পাতকুয়ো তার জরিপ করতে করতেই জিন্দেগি পার হয়ে যায়। হু হু করে উল্টো দিক থেকে ছুটে আসা হয় বিমের আলোয় সরে যায় সময় ,নড়ে যায় গন্তব্য। গতি কমিয়ে আমার লো বিম অফ দিই। আসুন সময় , মেপে নিন আমায়। আমার সবটা দিয়ে থামালাম চাকাগুলো। এটাই আমার গন্তব্য ! সত্যিই কি তাই ? আসলে এখন যেটা গন্তব্য বলে ভাবছি দুদিন বাদে সেটা পিছনে ফেলে এগিয়ে যাব অন্য আস্তানায়। এরই নাম জীবন , এটাই পথ। একটা পদক্ষেপ থেকে আর একটায় হেঁটে যাই , ভেসে যাই , উড়ে যাই। এ চলা অনন্ত অবিরাম। চলেছি , চলেছি চলেই চলেছি। চলতে চলতে চালাক হয়েছি কিনা জানি না চালু হয়েছি। ঠিক ওই রাস্তার পাশের অবহেলায় পড়ে থাকা চা-এর দোকানের মতো ভাঁড়ে মা ভবানী বা গরম চায়ের ছ্যাঁকা খেয়ে সূচের ছিদ্র খুঁজেছি। ছোটবেলায় বাড়িতে বাবা মা চা থেকে বহুদূরে হরলিক্স , ভিভা , বোর্নভিটা , মলটোভার কাপে কয়েদ করে রেখেছিল। বোনকে তো এমন থ্রেট দেওয়া হয়েছিল যে ,'চা খেলে মা মরে যায় ' !! শৈশবের সেই শঙ্কা সারা জীবন আমার ছোট বোনকে নটি ( No Tea )-র দলে , মানে না-চা-র দলে রেখে দিল। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর কলেজ ক্যান্টিনের গোপালদার হাতে প্রথম স্বাদ পেলাম অমৃত পেয়ালার ! তারপর কত চলেছি আর ক্লান্তির প্রহরগুলোতে চার্জ আপ করেছে চা। এ এক অদ্ভুত পানীয়। শহর বা মফঃস্বলের তামাম আনন্দঘন মুহূর্ত থেকে স্বজনবিয়োগের অশ্রুসজল ব্যাথার প্রহর -- সবটা জুড়ে রয়েছে চা। কত শবের সঙ্গে শ্মশানযাত্রী হয়েছি। তার মধ্যে বেশিরভাগই পরিচিত বা আত্মীয়দের। কিন্তু বিশ্বাস করুন ওই করুণ আবহতেও যখন দেখি বড় পিসেমশাই আর সেজ জ্যাঠার মধ্যে কে শ্মশানবন্ধুদের চা খাওয়াবে তাই নিয়ে হুড়োহুড়িটা রীতিমতো প্রতিযোগিতার পর্যায়ে চলে গেছে তখন অবাক হয়ে মৃত্যুর নির্মোক ছেড়ে জীবনমুখিতায় ফিরি। মৃতের ফুলমালা , খাট ,খৈ-এর দোকান গভীর রাতে খোলাতে হলেও বাজি ধরে বলতে পারি বারুইপুর থেকে বজবজ , বাটানগর থেকে ব্যারাকপুর বা আসানসোল থেকে আদ্দিস আবাবা শ্মশানের সামনের চায়ের দোকান খোলা থাকবেই। শুধু কলকাতা জুড়ে চা নিয়ে যে উন্মাদনা তা নিয়ে গোটা একটা বই লেখা হয়ে যেতে পারে। পার্ক স্ট্রিটে T3 ( The Tea Table) এখন নেই কিন্তু অক্সফোর্ড বুক স্টোরের ওপর চা-বার (CHA BAR) আর দক্ষিণাপনে প্রখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ত্ব ডলি বসুর Doly's Tea চা বিলাসী কলকাতার পপুলার ডেস্টিনেশন।
জলপাইগুড়ি থেকে জয়নগর কত হরিদা ,মানু ভাই , রায় জি ,পাঁড়ের হাতে যে চা খেয়েছি তার শেষ নেই। আর দোকানে যদি পুরুষের বদলে প্রৌঢ় মহিলা থাকেন তাহলে অনায়েসেই মাসির আপ্যায়নে প্রজাপতি ,লেড়ো বা মেরি বিস্কুটের সঙ্গে কাচের গ্লাসে বা মাটির ভাঁড়ে কত ঝোড়ো প্রহর ফুস করে উড়ে চলে যায়। বেকার বয়েসে আমাদের আড্ডা ছিল হরিদার দোকানে। অপরিসর, ম্লান আলোমাখা মফঃস্বল রেল শহরে চারটে বেঞ্চ অপেক্ষা করে থাকত আমাদের আড্ডার সাক্ষী হতে। শুক্রবার , শুক্রবার হাট বসত। আর হাট শেষ করে যখন হাটুরেরা বাড়ি ফিরত তখন ভাঁটিখানায় ভিড় বাড়ত। তারপর মাতালদের চিৎকারে কান পাতা দায় হত। একবার এক কপাল পর্যন্ত নেশা করা মাতাল কী কুক্ষণে যেন হাজির হল হরিদার দোকানে। আর যায় কোথায় !! সবাই মিলে সেই লোকটাকে সাত - আটটা ছানার জিলিপি আর চা বলে এক কাপ জিলিপির রস খাইয়ে ছাড়ল। ছাড়ল কোথায় ! চা ভেবে সেই রস খেয়ে সেই চাতালরূপী মাতাল মাঝরাত অবধি পড়ে রইল হরিদার দোকানের সামনে। পরে ভেবেছি এরকম প্রতারণা না করলেই বোধহয় ভাল হত।
ঘুম চোখে উঠে চা -এর চাহত এ আঁকুপাঁকু করত হো চি মিন সিটিতে। দুধ চা বিরল ভিয়েতনামে। চা বলতে যা পাওয়া যেত তা হলদেটে ঠান্ডা ট্যালটালে এক পানীয়। দিন ১৫র ভিয়েতনাম সফর শুধু ওই প-চা জিনিসটার জন্যই বিরস কেটেছিল। আমার চা নিয়ে আদিখ্যেতার জন্য আর এক চায়ের সঙ্গে পরিচয় হল লেহ শহরের বাইরে সে TSE তে ( এই সে তে 'দিল সে ' সিনেমার টাইটেল সং এর শুটিং হয়েছিল ) লবজুং নোমাঙ্গ এর বাড়িতে। শুধু চা এর জন্যই সে এক ঢালাও আয়োজন। গরম জল, নুন ,মাখন আর চা পাতার মিশ্রণ সুদৃশ্য বাঁশের খোলে পিস্টনের ওপর নিচ করে তৈরি হয় গুটিগুটি চায়ে বা গুড়গুড়ি চায়ে। পোর্সেলিনের নক্সা করা পেয়ালায় সুন্দর তিব্বতি টুলে রাখা টিকোজি ঢাকা পিরিচ থেকে সেই চা ঢালতে ঢালতে বাদশাহী মেজাজ চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
এরকমই চলার পথে একটা ঘটনা বলার লোভ সংবরণ করতে পারছিনা। তখন আমি মেদিনীপুরে। একটি বেসরকারি ন্যাশনাল চ্যানেলের চিত্রগ্রাহক। ছোট আঙারিয়া কাণ্ডের সপ্তাহখানেকের মধ্যে নির্বাচনী আধিকারিকরা গ্রামে ঢুকছেন , সাথে আমরাও। লোকজন ক্যামেরা দেখে দৌড়ে পালাচ্ছে ঘরের ভিতর। পড়ে থাকছে ভাত ডাল মাখা থালা। এরকম অবস্থায় ছবি করে কাজ মিটিয়ে দেখি গ্রামের এক প্রান্তে একটা ছোট্ট ঝুপড়ি। তার বারান্দায় একটা মাটির উনোন। বুঝতে বাকি রইল না ওটাই গ্রামের রাজনৈতিক মত বিনিময় কেন্দ্র -- চায়ের দোকান। হাঁকডাক করতে ভয় ভয় চোখে একজন বেরিয়ে এল। অনেক অনুরোধ , উপরোধ , অনুনয়, বিনয় করে ছবি না তোলার প্রতিশ্রুতি দিতে সে গুড়ের চা খাওয়ানোর আশ্বাস দিয়ে বলল - ' একটু আসি পাঁচ মিনিটেই ফিরব। ' পনেরো কুড়ি মিনিট পরে পাশের ঝোপ থেকে শুকনো কাঠকুটো এনে মাটির উনুন এ আঁচ দিয়ে , জলে গুড় মিশিয়ে চা জাতীয় কিছু একটা সেই মিশ্রনে ফুটিয়ে গ্লাসে ছেঁকে দিয়ে বলল - "বাবু কবে সব ঠিক হবে ?" উত্তরটা দিতে পারিনি। অনেক কিছুই করা হয় নি। জানা হয়নি। রাখা হয় নি অনেক প্রতিশ্রুতিই। কাপ আর ঠোঁটের ব্যবধানটা রয়েই গেছে চরাচর জুড়ে , জীবন জুড়ে। তবে প্রাণের আরাম আনা ক্লান্ত শরীরকে চাঙ্গা করা চা পরিবেশনকারী অবহেলার সরাইখানাগুলো যেন বেঁচে বর্তে থাকে। বাঙালির স্বাস্থ্যের আর প্রতিবাদের র(Raw) চা এর পাশে যেন সগর্বে বাঁচে দুধ চিনি মেশানো প-চা টাও।
সেদিনই একটা হাসপাতালের আউটডোরে বসে আছি দেখি একটা কিশোর বয়সী ছেলে চায়ের কেটলি হাতে হুঙ্কার দিচ্ছে - " উপরওয়ালানে শোনে কে লিয়ে জিন্দেগি দিয়ে হ্যায় ! দুনিয়াওয়ালোনে খাটনে কে লিয়ে মজবুর কিযে হ্যায়। " সবাই চনমন করে উঠল। এই মুন্না এদিকে এক কাপ লিকার দে !!
সত্যজিৎ বলছেন
" ছোটকাকা পেটুক না হলেও খেতেন খুব তৃপ্তি করে। রোজ এবারই ওবাড়ি গিয়ে চা খাওয়ার ব্যাপারটা ছিল একটা বিশেষ ঘটনা। ডায়রিতে এর উল্লেখ থাকত , তবে মামুলিভাবে নয়। যে চা -টা খেলেন তার একটা বিশেষণ , আর ব্রাকেটের মধ্যে সেই বিশেষণের একটা ব্যাখ্যা চাই।
একমাসের ডায়রি থেকে বারোটা উদাহরণ দিচ্ছি। ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে --
১) নৃসিংহভোগ্য চা (ভৈরবকান্তি-জনক ,হুহুঙ্কার প্রসাদক ,জোরালো চা )
২) বৈষ্ণবভোগ্য চা (নিরীহ , সুমিষ্ট , সুকোমল ,অহিংসক চা )
৩) বিবেকানন্দভোগ্য চা ( কর্মযোগস্পৃহাবর্ধক , বাগবিভূতিপ্রদ , তত্ত্বনিষ্ঠার অনুকূল উপাদেয় চা )
৪) ভট্টাচার্যভোগ্য চা ( বিজ্ঞতাবর্ধক ,গাম্ভীর্যপ্রদ , অনুগ্র ,হৃদ্য চা )
৫) ধন্বন্তরিভোগ্য চা ( আরোগ্যবর্ধক ,আয়ুষ্য ,রসায়নগুণ-সম্পন্ন চা )
৬) পাহারাদারভোগ্য চা (সতর্কতাবর্ধক , উত্তেজক , তন্দ্রনাশক চা )
৭) মজলিসী চা (মসগুল-মসগুল ভাবোদ্রেককারী চা )
৮) কেরাণিভোগ্য চা ( হিসাবের খাতা দেখায় উৎসাহবর্ধক , বাদামী স্বাদু চা )
৯) হাবিলদারভোগ্য চা ( হিম্মতপ্রদ , হামবড়াভাবের প্রবর্তক চা )
১০) জনসাধারণভোগ্য চা ( বৈশিষ্টহীন ,চলনসই চা )
১১) নারদভোগ্য চা ( সঙ্গীতানুরাগবর্ধক , তত্ত্বজ্ঞানপ্রসাদক , ভক্তি-রসোদ্দীপক চা
১২) হনুমানভোগ্য চা ( বিশ্বাসযোগ্যতাবর্ধক , সমস্যা-সমুদ্রলঙ্ঘনের শক্তিদায়ক , বিক্রমপ্রদ চা ) "
ছোট থেকে যতবার যখন ছোট ছিলাম পড়েছি এই জায়গায় এসে হাসি চাপতে পারি নি। কী পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ !!! কাজেই চা নিয়ে কিছু বলতে গেলেই ওই লাইনগুলো আগে খেলে যায় মাথায়।
আজ আবার একটা পুরোনো প্রকাশিত লেখা দিচ্ছি। লেখাটা লিখে আরাম পেয়েছিলাম। হুবহু তুলে দিলাম
এক কাপ চায়ে আমি...
প্রকাশিত হয় হ্যাংলা হেঁশেল সংখ্যা ৩১ এ
বিভাগ : পথেই হবে পাত চেনা
প্রকাশকাল : মে ২০১৫
কোন পথে যে পাত পাড়া আর কোন পথে পাতকুয়ো তার জরিপ করতে করতেই জিন্দেগি পার হয়ে যায়। হু হু করে উল্টো দিক থেকে ছুটে আসা হয় বিমের আলোয় সরে যায় সময় ,নড়ে যায় গন্তব্য। গতি কমিয়ে আমার লো বিম অফ দিই। আসুন সময় , মেপে নিন আমায়। আমার সবটা দিয়ে থামালাম চাকাগুলো। এটাই আমার গন্তব্য ! সত্যিই কি তাই ? আসলে এখন যেটা গন্তব্য বলে ভাবছি দুদিন বাদে সেটা পিছনে ফেলে এগিয়ে যাব অন্য আস্তানায়। এরই নাম জীবন , এটাই পথ। একটা পদক্ষেপ থেকে আর একটায় হেঁটে যাই , ভেসে যাই , উড়ে যাই। এ চলা অনন্ত অবিরাম। চলেছি , চলেছি চলেই চলেছি। চলতে চলতে চালাক হয়েছি কিনা জানি না চালু হয়েছি। ঠিক ওই রাস্তার পাশের অবহেলায় পড়ে থাকা চা-এর দোকানের মতো ভাঁড়ে মা ভবানী বা গরম চায়ের ছ্যাঁকা খেয়ে সূচের ছিদ্র খুঁজেছি। ছোটবেলায় বাড়িতে বাবা মা চা থেকে বহুদূরে হরলিক্স , ভিভা , বোর্নভিটা , মলটোভার কাপে কয়েদ করে রেখেছিল। বোনকে তো এমন থ্রেট দেওয়া হয়েছিল যে ,'চা খেলে মা মরে যায় ' !! শৈশবের সেই শঙ্কা সারা জীবন আমার ছোট বোনকে নটি ( No Tea )-র দলে , মানে না-চা-র দলে রেখে দিল। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর কলেজ ক্যান্টিনের গোপালদার হাতে প্রথম স্বাদ পেলাম অমৃত পেয়ালার ! তারপর কত চলেছি আর ক্লান্তির প্রহরগুলোতে চার্জ আপ করেছে চা। এ এক অদ্ভুত পানীয়। শহর বা মফঃস্বলের তামাম আনন্দঘন মুহূর্ত থেকে স্বজনবিয়োগের অশ্রুসজল ব্যাথার প্রহর -- সবটা জুড়ে রয়েছে চা। কত শবের সঙ্গে শ্মশানযাত্রী হয়েছি। তার মধ্যে বেশিরভাগই পরিচিত বা আত্মীয়দের। কিন্তু বিশ্বাস করুন ওই করুণ আবহতেও যখন দেখি বড় পিসেমশাই আর সেজ জ্যাঠার মধ্যে কে শ্মশানবন্ধুদের চা খাওয়াবে তাই নিয়ে হুড়োহুড়িটা রীতিমতো প্রতিযোগিতার পর্যায়ে চলে গেছে তখন অবাক হয়ে মৃত্যুর নির্মোক ছেড়ে জীবনমুখিতায় ফিরি। মৃতের ফুলমালা , খাট ,খৈ-এর দোকান গভীর রাতে খোলাতে হলেও বাজি ধরে বলতে পারি বারুইপুর থেকে বজবজ , বাটানগর থেকে ব্যারাকপুর বা আসানসোল থেকে আদ্দিস আবাবা শ্মশানের সামনের চায়ের দোকান খোলা থাকবেই। শুধু কলকাতা জুড়ে চা নিয়ে যে উন্মাদনা তা নিয়ে গোটা একটা বই লেখা হয়ে যেতে পারে। পার্ক স্ট্রিটে T3 ( The Tea Table) এখন নেই কিন্তু অক্সফোর্ড বুক স্টোরের ওপর চা-বার (CHA BAR) আর দক্ষিণাপনে প্রখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ত্ব ডলি বসুর Doly's Tea চা বিলাসী কলকাতার পপুলার ডেস্টিনেশন।
ময়দানে অবসরের সান্ধ্য চা |
জলপাইগুড়ি থেকে জয়নগর কত হরিদা ,মানু ভাই , রায় জি ,পাঁড়ের হাতে যে চা খেয়েছি তার শেষ নেই। আর দোকানে যদি পুরুষের বদলে প্রৌঢ় মহিলা থাকেন তাহলে অনায়েসেই মাসির আপ্যায়নে প্রজাপতি ,লেড়ো বা মেরি বিস্কুটের সঙ্গে কাচের গ্লাসে বা মাটির ভাঁড়ে কত ঝোড়ো প্রহর ফুস করে উড়ে চলে যায়। বেকার বয়েসে আমাদের আড্ডা ছিল হরিদার দোকানে। অপরিসর, ম্লান আলোমাখা মফঃস্বল রেল শহরে চারটে বেঞ্চ অপেক্ষা করে থাকত আমাদের আড্ডার সাক্ষী হতে। শুক্রবার , শুক্রবার হাট বসত। আর হাট শেষ করে যখন হাটুরেরা বাড়ি ফিরত তখন ভাঁটিখানায় ভিড় বাড়ত। তারপর মাতালদের চিৎকারে কান পাতা দায় হত। একবার এক কপাল পর্যন্ত নেশা করা মাতাল কী কুক্ষণে যেন হাজির হল হরিদার দোকানে। আর যায় কোথায় !! সবাই মিলে সেই লোকটাকে সাত - আটটা ছানার জিলিপি আর চা বলে এক কাপ জিলিপির রস খাইয়ে ছাড়ল। ছাড়ল কোথায় ! চা ভেবে সেই রস খেয়ে সেই চাতালরূপী মাতাল মাঝরাত অবধি পড়ে রইল হরিদার দোকানের সামনে। পরে ভেবেছি এরকম প্রতারণা না করলেই বোধহয় ভাল হত।
ক্যানিং স্ট্রিটের এক প্রাচীন টি বয়লার |
মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারির নলেন গুড়ের দার্জিলিং চা |
সেদিনই একটা হাসপাতালের আউটডোরে বসে আছি দেখি একটা কিশোর বয়সী ছেলে চায়ের কেটলি হাতে হুঙ্কার দিচ্ছে - " উপরওয়ালানে শোনে কে লিয়ে জিন্দেগি দিয়ে হ্যায় ! দুনিয়াওয়ালোনে খাটনে কে লিয়ে মজবুর কিযে হ্যায়। " সবাই চনমন করে উঠল। এই মুন্না এদিকে এক কাপ লিকার দে !!
মন বলে চাই চাই চা ই গো |
No comments:
Post a Comment