Monday, October 18, 2021

আমি এবং আমার স্ত্রী এবারের পুজোয় নতুন জামা কিনলাম না - কেন?




পুজো কেমন কাটল আপনাদের? তৃতীয় তরঙ্গের আশঙ্কার মধ্যে এবারের দুর্গোৎসব। পুজোর কটা দিনের পর করোনার সংক্রমণ কিছুটা বেড়েছে। তারমধ্যেই আমরা বাঙালির সেরা উৎসবের উদযাপনটা করে নিলাম। এবারের দুর্গাপুজোয় আমি আর আমার স্ত্রী কোয়েল কোনও নতুন জামা কিনলাম না। বিষয়টা এরকম নয় যে কেনার জন্য অর্থের সঙ্গতিতে কোনওরকম অসুবিধা ছিল। দুজনের দুটি নতুন বস্ত্র কেনবার সামর্থ পরম করুণাময় ঈশ্বরের আশীর্বাদে ছিল। কিন্তু একটা লেখা এমনভাবে নাড়া দিয়ে গেল যে নতুন বস্ত্র কেনার ইচ্ছেই করল না। সেই প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। এবারে আমরা দারুণ পুজো কাটিয়েছি। 

বাড়ির ছোট আর বড়দের জন্য সামান্য কিছু প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে বেরোলাম। ইচ্ছে ছিল কোনও শপিং মল নয় ছোট দোকান থেকে কিনব যতটুকু প্রয়োজন। গড়িয়াহাটের দোকানে দোকানে ঘুরছি। বহুদিন বাদে ছোট শপিং কমপ্লেক্স গুলো খুলেছে। মানুষগুলো, যারা দোকান দিয়েছেন লড়াই করছেন। অসম লড়াই একটা। অনলাইন শপিং পোর্টালের সঙ্গে লড়াই, বড় ব্র্যান্ডের সঙ্গে লড়াই, ঝাঁ চকচকে শপিং মলের সঙ্গে লড়াই। মূল রাস্তা থেকে অনেকটা ভিতরে, কম সুবিধা প্রাপ্ত, নন এসি, অনেকটা আমাদের এই মফস্বলে বড় হওয়া দম্পতির ছোটবেলায় দেখা দোকানের মত লড়াকু মানুষগুলোর কাছেই গেলাম 'পূজা শপিং' এ। সম্বোধনেই আন্তরিকতার ফারাকটা স্পষ্ট। কর্পোরেট 'স্যার-ম্যাডামের' পরিবর্তে "দাদা আসুন বৌদি বসুন কী দেখাব?"। 

লাভলি মিষ্টি শ্রাবণী রাহুল 

এরই মাঝে আমার মেয়ের বয়সী এক মেয়ে আর তার বন্ধু আমাদের দিকে এগিয়ে এল। দুজনের মধ্যে বড় যে ষে এগিয়ে এসে হাতের পঞ্চবটী ধুপের গোছা দেখিয়ে বলল "নাও না গো একটা"। আমরা বরাবর ওই ধুপটার জন্য মুখিয়ে থাকি গড়িয়াহাট গেলেই। অন্য শিশুটি ছুট্টে চলে গেল অন্য খদ্দেরের আশায়। ধুপ কিনে আমার স্ত্রী বাচ্চাটির সঙ্গে কথা বলা আরম্ভ করলেন। জানা গেল, ওর নাম লাভলি আর বছর পাঁচেকের পুঁচকেটার নাম মিষ্টি। দূরে মিষ্টি দোকানের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে। ডাকলাম এই মিষ্টি শোন। অপরিচিত কেউ ওর নাম ধরে ডাকছে এটায় ওরা বোধহয় অভ্যস্ত নয়। দুজনের থেকেই ধুপ কিনলাম। আমাদের প্রিয়জনদের  জামাকাপড়ের সঙ্গে ওই ধুপগুলোও উপহার দেব ঠিক করেছিলাম। কেনাকাটার পর বাড়ি ফিরব এমন সময়ে দেখা হল আবার লাভলি আর মিষ্টির সঙ্গে। ওরা ওদের দিদি শ্রাবণীকে নিয়ে ঘুরছে।

লাভলি বলল- "আবার তোমাদের সঙ্গে দেখা"।

 "দিদি দ্যাখ এই কাকু আর কাকিমাটা আমাদের থেকে কত গুলো ধুপ কিনেছে জানিস"!

কোয়েল শ্রাবণীর থেকেও ক'টা ধুপ নিল

শ্রাবণী- "আমাদের জন্য তোমাদের কতগুলো টাকা ফালতু নষ্ট হয়ে গেল, তাই না"!

বাইরে ঝড় উঠেছে। বাড়ি ফেরার তাড়া। তার মধ্যেই ওদের সঙ্গে অল্প গল্প করলাম আমরা। লাভলি, মিষ্টি, শ্রাবণী আর রাহুলের মত বাচ্চাগুলো গড়িয়াহাটার ফ্লাইওভারের তলায় বাবা মায়ের সঙ্গে থাকে। আমি টিভি নাইন বাংলার একটা ভিডিও শ্যুটে গিয়ে ওদের মত অনেক বাচ্চাকে দেখেছি লক ডাউনের সময়ে। সে কথা ওদের বলতেই ওরা বলল "একদিন তোমরাও খাওয়াবে আমাদের"? 

বিজ্ঞাপনের ভাষায় শিশু আর শ্রমিকের মধ্যে দূরত্ব রাখা যায় না এ শহরের ফুটপাথগুলোয়। পার্ক সার্কাস আর পার্ক স্ট্রীটের বেলুন বিক্রেতা সাবানা, করিশ্মা আর গড়িয়াহাটের লাভলি মিষ্টি শ্রাবণী আর রাহুলরা মিলে মিশে যায়। আমাদের শহরের শ্রমিক শিশুরা দূরত্ব চায় না। মর্যাদা চায়। শ্রমিকের মর্যাদা। শিক্ষা চায়। একটু মানুষের মত বাঁচতে চায়। এই শহরে, এই দেশে শিশুশ্রম আছে। ঘোরতর ভাবেই আছে। কর্পোরেট চাইলেও আছে না চাইলেও আছে। সংস্কৃতি মনস্ক বাঙালি চাইলেও আছে না চাইলেও আছে। শিশু আর শ্রমের মধ্যে দূরত্ব ঘোচাতে চাইলে শ্রমিক শিশুদের পরিবারের খাদ্যের জোগানকে সুনিশ্চিত করতে হবে আগে। এই শহরে বড়বড় পুজোয় কোটি কোটি টাকা ফুঁকে যায়! স্রেফ ফুঁ দিয়ে উড়ে যায়। আর ধুপের ফেরিওয়ালা শিশুরা সুগন্ধ বিক্রি করে!   


গারমেন্ট লাইফ আর রিসাইকেল - পৃথিবীর জন্য জরুরী 

পুজোর ঠিক আগে সেপ্টেম্বরের শেষদিকে একটা লেখা পেলাম সোশ্যাল মেসেজিং এ । লেখাটি লিখছেন রুপান্তরণ ফাউন্ডেশনের স্মিতা সেন। এই লেখাটি পড়ে আমরা, মানে আমি আর আমার স্ত্রী মনস্থ করলাম এবার পুজোয় চাই না আমাদের দুজনের নতুন জামা।  


স্মিতার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত আলাপ নেই। ওনাকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ওনার পোস্ট করা সোশ্যাল মিডিয়ার সেই বার্তা হুবহু তুলে দিলাম নীচে। অত্যন্ত মুল্যবান এবং দামী কিছু সময়োপযোগী কথা স্মিতা লিখছেন-    

সামনেই উৎসবের মরসুম। উৎসব মানেই নতুন জামাকাপড় কেনা। ছোটবেলায় পুজোর সময়ের অতি পরিচিত আলোচনা ছিল কার কটা জামা হল। আজকাল অনলাইন কেনাকাটার দৌলতে সারা বছরই জামাকাপড় বিক্রি হচ্ছে। কেউ কেউ আবার মন ভালো রাখতে শপিং করেন, যেটা বেশিরভাগ সময়ই জামাকাপড়। নতুন জামা  সারাবছরে কতগুলো কিনব এবার বোধহয় হিসাব করার সময় এসে গেছে। একটু সহজ করে বলার চেষ্টা করছি।  

পরিসংখ্যান বলছে ১৫ বছর আগে আমরা যে পরিমাণ পোশাক ব্যবহার করতাম, এখন করছি তার দ্বিগুণ। ফলে এখন ফ্যাশন থেকে সৃষ্ট বর্জ্যের পরিমাণও অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ। আগে মানুষ একটা পোশাক যে পরিমাণ ব্যবহার করত, এখন তার শতকরা ৪০ ভাগও করে না। এখন একটা পোশাকের গড় আয়ু দুবছর দুমাস। আর সেটি গড়ে ৭ থেকে ১০ বার পরা হয়। আমরা এমন একটা বিশ্বে বাস করছি, যেখানে প্রয়োজনের তুলনায় বহুগুণ বেশি পোশাক উৎপাদন করা হয়। গার্মেন্টসের জঞ্জালে ভরে উঠেছে পৃথিবী। 

আপনি ভাবছেন, আপনার টাকায় আপনি ফ্যাশন করবেন। তাতে সমস্যা কোথায়? সমস্যা আছে। একটা সুতির টি-শার্ট বানাতে যে পরিমাণ কাপড় লাগে, সেটির জন্য প্রয়োজনীয় তুলা উৎপাদন করতে ২০ হাজার লিটার জল খরচ হয়। বিশ্বে যত জল ব্যবহৃত হয়, তার শতকরা ২০ ভাগ খরচ হয়ে যায় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে। স্পিনিং, উইভিং, ডায়িং, ফিনিশিং, গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং, পোস্ট কনজিউমিং-প্রতিটা ক্ষেত্রে উৎপাদিত হয় বর্জ্য। পরিবেশদূষণের যত কারণ, তার মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে পোশাকশিল্প।  ইউনাইটেড ন্যাশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে ফ্যাশনশিল্পের জন্য গ্রিনহাউস গ্যাস এবং বর্জ্য নিঃসরণ বৃদ্ধি পাবে ৬০ শতাংশ। ২০৫০ সালের মধ্যে আমার-আপনার চাহিদা মেটাতে বর্তমানে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, তার তিন গুণ প্রাকৃতিক সম্পদের প্রয়োজন হবে। ক্লাইমেট চেঞ্জ কিন্তু আর বইয়ে পড়ে ভুলে যাওয়ার বিষয় নয়। অতিবৃষ্টি, অতিগরম, সাইক্লোন, দাবানলের খবরে আমরা টের পাচ্ছি এবার ক্লাইমেট চেঞ্জ বিষয়টা আমাদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। প্রশ্ন হল আমি, আপনি, আমরা - সাধারণ মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষরা কি করতে পারি?

প্রথমত, ‘গার্মেন্ট লাইফটাইম’ বাড়ানো। মানে এক পোশাক বেশি দিন পরা। পোশাকের আয়ু বাড়ানো। যদি নতুন পোশাক না কিনে একটা পোশাক মাত্র ৯ মাস বেশি পরেন, তাহলেই ওই পোশাকের মাধ্যমে কার্বন উৎপাদন আর ওই পোশাকের পেছনে ব্যবহৃত অপচয় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।

পুরোনো পোশাক ফেলে না দিয়ে ‘ভ্যালু অ্যাড’ করুন। শাড়ি দিয়ে পর্দা, কুর্তি থেকে কুশন কভার, শার্ট দিয়ে ব্লাউজ, ফুলপ্যান্ট কেটে হাফপ্যান্ট - পৃথিবীকে এবার আপনার ক্রিয়েটিভিটি দেখানোর সময় এসেছে। রিসাইক্লিংয়ের সবচেয়ে ভালো উদাহরণ আমাদের কাঁথা। ভেতরের দিকে বেশি পুরোনো কাপড়, আর ওপরের দিকে কম পুরোনো কাপড়, শাড়ির সুন্দর পাড় ব্যবহার করে কি দারুণ নকশা বানাতেন আমার ঠাকুমা। এমনকি সুতোটা পর্যন্ত পুরোনো শাড়ি থেকে বের করা হত। আমাদের হাতে টাকা আসায় এই প্রয়োজনীয় ভ্যালুগুলো হারিয়ে ফেলছি। নিজেদের পারদর্শিতা না থাকলে অন্য কারোর সাহায্য নিয়ে রিসাইক্লিং করি। 

পরিমিতিবোধের সাথে পোশাক কিনুন। দরকারে কেনাকাটা করুন, ক্যালেন্ডার দেখে নয়। "পুজোয় কটা জামা হল?" এই প্রশ্ন করা সত্যিই অনুচিত। 

(এই অংশটি স্মিতা সেনের ফেসবুক পোস্ট থেকে নেওয়া)

একবার রিসাইকেল্ড পোশাক নিয়ে হিডকোর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর শ্রী দেবাশিস সেনের সঙ্গেও কথা হয়েছিল বেশ কয়েক মাস আগে। প্রশাসনিক কর্তা শ্রী সেন নিজের কাঁথা স্টিচের জ্যাকেট দেখিয়ে একটা কথা বলেছিলেন আজও পরিষ্কার মনে আছে , " দেখুন এই জামাটা আমি বাই চান্স নয় বাই চয়েস পরেছি"। এই বাই চয়েস পুরনোকে নতুন করে পরার মানসিকতাই বোধহয় বাঁচাতে পারে পৃথিবীকে। দরকার নেই বেশি কিছুর। আমি একটা সময়ে ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলিকে দেখেছি। এক শার্ট একাধিক অনুষ্ঠানে পরতে কোনও রকম অস্বস্তিতে পড়তেন না বাইশ গজের মহারাজ। সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা মানুষ গুলো বোধহয় নিজের কাজের মধ্যেই উদাহরণ রেখে দেন। আর একজন, প্রিন্সেস ডায়ানা। একাধিক বার গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে একই পরিধেয় 'রিপিট' করতেন লেডি ডায়ানা, যা ওই স্তরের মানুষজনদের মধ্যে বিরল। এভাবেই নিঃশব্দে কাজ করে চলেছেন কিছু মানুষ। আগামী দিনগুলোয় খাদ্যের সংকট, পানীয় জলের সংকট যাতে আমার আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঘিরে না ধরে তার জন্য চলুন না আজ থেকেই ভাবনা শুরু করি, কাজ করা শুরু করি।

   

Tuesday, September 21, 2021

তবু মনে রেখো - প্রসঙ্গ অ্যালঝাইমারস ডে


জ কথা তাঁদের নিয়ে। যারা মনে রাখতে পারেন না। "মনে রাখতে পারেন না" মানে ধরুন ব্রেকফাস্টে কী খেয়েছেন? ওষুধটা খেয়ে ফেলে যারা ভাবছেন ওষুধটা খেতে হবে। পুরনো স্মৃতি আসতে আসতে ফিকে হচ্ছে। কাকে কী বলেছেন? অমুক ব্যক্তি কে? তাঁর সঙ্গে কী ব্যবহার করা উচিত ? এরকম বহুবিধ দৈনন্দিন সহজ বিষয় গুলো যাঁদের কাছে মারাত্মক জটিল। ভুলে যাওয়ার একটা গহ্বরে যারা রোজ তিল তিল করে ডুবে যাচ্ছেন। আজ বিশ্ব অ্যালঝাইমার ডে World Alzheimer’s Day আর এই সেপ্টেম্বর মাসটা অ্যালঝাইমার সচেতনতার মাস। 

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের চারপাশ কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করে। বিনিদ্র রাত যাপন করি আমরা তাও বলতে পারিনা ইনসমনিয়ার কথা। শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে অঙ্গটা সেই মস্তিষ্কেরও যে সমস্যা হতে পারে এবং তার জন্য ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন। এই ছোট্ট বিষয়টা এই ২০২১ এও আমাদের অনেকের মাথায় ঢোকে না। আর ঢুকলেও সামাজিক অপমানের ভয়ে অনেকেই মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা নিয়েই জীবনযাপন করেন। রোজ ধীরে ধীরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে বাঁচেন ।

অ্যালঝাইমার একটা জটিল মানসিক অবস্থা। যে ক্ষেত্রে আক্রান্ত মানুষটির ব্যবহারিক জীবনে চিন্তাভাবনা, আচরণ এবং সামাজিক গুণাবলী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকে পরিস্থিতি। পরিসংখ্যান বলছে আমাদের দেশে প্রায় ২৪ লক্ষ মানুষ এই মুহূর্তে এই রোগে আক্রান্ত। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে অ্যালঝাইমার রোগাক্রান্তদের মধ্যে পাঁচটি মানসিক রোগের বা ডিজঅর্ডারের লক্ষণ দেখা যায়। অ্যামনিজ়িয়া, আফেজ়িয়া, অ্যাপ্রাক্সিয়া, অ্যাগনোসিয়া এবং অ্যানোমিক অ্যাফেজ়িয়া। তাঁরা সংক্ষেপে এই ৫টি রোগকে 5 A of  Alzheimer’s Disease বলে চিহ্নিত করেছেন। 

অ্যামনিজ়িয়া (Amnesia)- অ্যামনিজ়িয়ায় আক্রান্তরা স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন ক্রমশ। ধীরে ধীরে সমস্ত স্মৃতি লোপ পায়। যত সময় যায় ধীরে ধীরে কমতে থাকে স্মৃতির ভাঁড়ার। চেনা মানুষ এমন কি সন্তান সন্ততিকেও চিনতে পারেন না এই রোগে আক্রান্ত অনেক মানুষ। অ্যামনিজ়িয়া ২ ধরনের রেট্রোগ্রেড অ্যামনিজ়িয়া (Retrograde Amnesia) এবং অ্যান্টিরেট্রোগ্রেড অ্যামনিজ়িয়া (Anterograde Amnesia)। অনেক আক্রান্ত মানুষ চোখের সামনে যা ঘটছে তা ও মনে রাখতে পারেন না।

আফেজ়িয়া (Aphasia)- এই অবস্থায় আক্রান্ত মানুষটির ক্ষেত্রে যোগাযোগ স্থাপন, কথা বলা ভীষণ সমস্যার হয়ে পড়ে। বিশেষ করে কথাবার্তা বলা। কী বলবেন, তার জন্য কী শব্দ প্রয়োজন, কীভাবে সেই শব্দ উচ্চারণ করবেন তা অনেক সময়ে বুঝতে না পেরে মানুষটি হয় ডুবে যান নৈশব্দের অতলে নয়ত এলোমেলো কথা বলতে শুরু করেন, যে কথা বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক রহিত। এক তীব্র কষ্টকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন ওই ব্যাক্তি।

 অ্যাপ্রাক্সিয়া (Apraxia)- মোটর স্কিলগুলো আক্রান্ত হয় এই পরিস্থিতিতে। যার ফলে জলের গ্লাস ধরে মুখ পর্যন্ত তোলা, স্নান করা বা জামাকাপড় পরবার মত সহজ কাজ গুলো হয়ে ওঠে দুরুহ, কষ্টকর। আর তাই ধীরে ধীরে হাঁটা চলাও হয়ে যায় কম। আক্রান্ত ব্যক্তির পড়ে যাবার ঝুঁকি বাড়ে। সারাক্ষণের দেখভালের লোক অত্যন্ত প্রয়োজন এই ধরনের মানুষদের জন্য। 

অ্যাগনোসিয়া (Agnosia)- এই পরিস্থিতিতে আক্রান্ত হয়ত কিছুটা ঠিকঠাক কথা বলতে পারছেন কিন্ত অপর দিক থেকে তাঁকে যা বলা হচ্ছে তা বুঝতে প্রচণ্ড অসুবিধা হয়। অর্থাৎ তাঁর কমিউনিকেসন স্কিলের ক্ষেত্রে সিগনাল রিসিভ করতে অসুবিধা হয়। এর ফলে প্রায়শই দেখা যায় ওই ব্যক্তির শ্রবণশক্তি, ঘ্রানশক্তি, স্বাদ, স্পর্শের অনুভুতি এবং দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয় ক্রমশ। 

অ্যানোমিক অ্যাফেজ়িয়া (Anomic Aphasia)- এই পরিস্থিতিতে অ্যাফেজ়িয়ার লক্ষণগুলো ছাড়াও মানসিক আঘাত এবং কথা বলা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। মস্তিস্কের বাঁ দিক আক্রান্ত হয়। এই পরিস্থিতি ইঙ্গিত দেয় যে মস্তিস্কের কোষগুলি দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। 



আজ বিশ্ব অ্যালঝাইমার ডে উপলক্ষে রবীন্দ্র সেতু বা হাওড়া ব্রিজ রঙিন হবে নীল রঙে। অ্যালঝাইমার এন্ড রিলেটেড ডিজরডারস সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার কলকাতা চ্যাপ্টার আয়োজন করেছেন এই সচেতনতার। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলিকে অ্যালঝাইমারের সচেতনতায় এগিয়ে আসতে আহ্বান জানিয়েছেন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা এই রোগে আক্রান্ত মানুষ ও তাঁদের পরিবারের লড়াইয়ে শক্তি যোগাবে।










Friday, September 10, 2021

জয় করো এই তামসিরে - আত্মহত্যা কোনও সমাধান নয়


 অনেক দিন আগে কবীর সুমনের একটা অ্যালবাম বেরিয়েছিল - ঘুমোও বাউণ্ডুলে। সেই অ্যালবামে একটা গান ছিল- 

"থেমে যেতে যেতে 

একবার কোনও মতে

জোর করে যদি একবার 

হেঁটে যেতে

বেঁচে নিতে যদি একবার

বড় ভাল হত"।


আমরা রোজ মারা যাই , রাত্রে , সাময়িক, ঘুমের মধ্যে । রোজ আবার বেঁচে উঠি, জেগে উঠি সাময়িক মৃত্যু-ঘুম ছেড়ে। মৃত্যু চিরন্তন। মরণ তুঁহ মম শ্যম সমান। জন্ম নিয়েছে যে তার মৃত্যু আছেই। কাম ক্রোধ বা অন্য ষড় রিপু না থাকলেও জাগতিক প্রাণী বা উদ্ভিদের মৃত্যু এড়ানোর কোনও উপায় নেই। একটাই জীবন। একবারই খেলতে নামা। ক্রিজ ছেড়ে চলে যাব? কেন? 

আজ সারা দুনিয়া জুড়ে এই বিষয় নিয়েই কথাবার্তা হচ্ছে। আজ বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। করোনা আবহে আত্মহত্যার প্রবণতা আরও বেড়েছে মানুষের মধ্যে। বহু আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক এবং শারীরবৃত্তীয় কারণ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর অন্ধকারে। 

সমস্যা এতটাই জটিল হয়ে গেছে এই অতিমারি পরিস্থিতিতে যে শিনরিন - ইয়োকু র দেশ জাপানে এই মুহূর্তে আত্মহননের হার সবচেয়ে বেশি। জাপানিরা ভাল থাকার বিষয় তাঁদের দৈনন্দিন জীবন চর্যার মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়েছেন যুগ যুগ ধরে। তাহলে তাঁদের কেন এমন অবস্থা। আমাদের দেশে কৃষক, ছাত্রছাত্রী, এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের আত্মহত্যার হার বেড়েছে। বাদ যান নি ডাক্তার কিংবা শিক্ষকরাও। 

টেকনলজি আমাদের বেগ দিয়ে আবেগ কেড়ে নিয়েছে। আমরা সারাদিন অনলাইন থাকি । আপডেটেড থাকি। অথচ পাশের বাড়ির, পাশের ঘরের, পাশের বালিশের মানুষটার খোঁজ রাখি না। আর রাখি না বলেই আমরা অনেক আত্মহনন আটকাতেও পারি না। এই অবস্থায় তাই কথা বলাটা খুব জরুরী। আত্মহননের ইচ্ছা একটা মানসিক অবস্থা। যার থেকে আমাদের টেনে বার করে আনতে পারেন একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। তাই যিনি রোগী তাঁর পরিচিত, পরিবার বা বন্ধুদের উচিত ট্যাবু ভেঙে, লজ্জা সরিয়ে ডাক্তারবাবুর কাছে রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব নিয়ে যাওয়া। 

ইন্টারনেটে সার্চ করে রোগ সারাব, বা রোগীর কাউন্সেলিং করব ভাবাটা বোকামো। এটা একটা স্পেসালাইজড বিষয় তাই স্পেশালিষ্টকেই দরকার। আর নেটে অনেক হেল্প লাইন পাবেন। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আজ একটা প্রতিবেদন করলাম টিভি নাইন বাংলায়(TV9 Bangla)। সেই প্রতিবেদনে কিছু তথ্য নেবার জন্য হেল্প লাইনে (নাম বলছি না ) ফোন করলাম টানা দু দিন । কেউ ফোন ধরলেন না । অতএব নিজেই নিজের আলো হয়ে জ্বলে উঠুন। গোলাপ হয়ে ফুটে উঠুন। সমস্যাকে জয় করাই জীবন। সমস্যা না থাকলে মজা কোথায়?  মৃত্যু কোনও সমস্যার সমাধান নয়। বরং সমস্যাটাকে আরও কিছু মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে পালিয়ে যাওয়া। তাই চিয়ার্স টু লাইফ।  

রইল আজ আমার করা একটা ভিডিওর লিঙ্ক। 

দেখুন সেই ভিডিও


https://youtu.be/hUvPbgzMK0Y


Sunday, September 5, 2021

কে শিক্ষক?

অনেকটা শৈশববেলা তখন। রান্না করতে করতে পড়াত মা। গরম খুন্তি উঁচিয়ে বলত অমনোযোগী হলেই “দেব?” রুটির আটা মাখা সেই খুন্তিই শিখিয়েছে- মনযোগী হও। প্রণাম প্রাজ্ঞ খুন্তি

তারপর এলেবেলে ছেলেবেলা স্কুল। লাল নীল কমলা বাটিরা থরে থরে সেজে বসত। সেই স্কুলে টিফিন বেলা শিখিয়েছে- ভাগ করে খাও।

শহরের ইংলিশ মিডিয়াম। অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান মিস। হাতটা বেজায় মারকুটে। লেখা বেঁকে গেলেই ভয়। গাল লাল করে থাপ্পড় শিখিয়েছে- মানুষ আর পশুর মধ্যে পার্থক্য হল মানুষ লিখতে পারে।

সরকারী স্কুলের বাইরে তেঁতুল গাছ। পাড়তে পারতাম না টকফল। শৈশবের বন্ধু শিখিয়েছে- পাথরের অব্যর্থ নিশানা। আহা কি পরম পাওয়া !

রবিবার শিখিয়েছে- সোমবার স্কুল তাই দুদ্দাড় আনন্দে হও মশগুল ।

হুহু করা সাইকেল প্যাডেল শিখিয়েছে- গতির প্রথম পাঠ।

সহপাঠী শিখিয়েছে- কলেজ কেটে সিনেমা।

যৌবন শিখিয়েছে সিগারেট, সিগারেট শিখিয়েছে- পুড়ে হও খাক

বেকারত্ব শিখিয়েছে – টিউশনি টাকা দিয়ে দেখা সুমনের গান

সুমন শিখিয়েছে- আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি, কার তাতে কী ?

প্রেমিকা শিখিয়েছে অপেক্ষা আর ছেড়ে চলে যেতে হয়

দেহ শিখিয়েছে- জন্মের জন্য ছোট আর মৃত্যুর জন্য বড় হওয়ার খেলা

দেহকাম শিখিয়েছে- চুম্বন ব্যাকরণ, ঠোঁট জ্বালা থেকে যায় থেমে গেলে কম্পন

বন্ধু শিখিয়েছে- “পাতিয়ালা কীভাবে বানাই দেখ শালা” বা “বীজ থাকলে টানলেই ফাটবে”।

প্রথম বেতন শিখিয়েছে- ২ কিলো মটন কেনা সুখ

অসুখের বিল শিখিয়েছে- ফিট থাকা কতটা জরুরী

বন্ধুর ছদ্মবেশ শিখিয়েছে- বিশ্বাস করা পাপ ( ক্ষমা করবেন রবীন্দ্রনাথ)

টিভি শিখিয়েছে- দাগ অচ্ছা হ্যয়

মালিক শিখিয়েছে- পোষালে থাক না পোষালে যা ( অথচ মুখে কিছু বলে না)

শ্রমিক শিখিয়েছে- আমারই ঘামের বৃষ্টি নামে লাল সেলাম

হাত ছাড়া ট্রেন শিখিয়েছে- ৫ মিনিটের দাম

পথ শিখিয়েছে- ঘরের টান

আর ঘর শিখিয়েছে- পথের ক্লান্তি ভুলে কোলে তুলে নিতে

স্ত্রী শিখিয়েছে – পাশে থাকা

সন্তান শিখিয়েছে- পিতৃত্ব আর আবার কার্টুন দেখা

কার্টুন শিখিয়েছে- সহজ বাঁচতে সবাই পারে না।

বটগাছ শিখিয়েছে- শুধু ছায়া দিতে হয়

ঘাস শিখিয়েছে- নত হলেও শিকড় ছড়িয়ে দেওয়া চাই

শিকড় শেখালো – রবি ঠাকুর (যাঁদের জীবনে তিনি নেই তাঁরা রোদ্দুর রায়ের চেয়েও পচা কপালে)

সূর্য শেখালো- দিন

দিন শেখালো- হয় আনি খাই নাহয় “দিন না, দিন না ,‌ আমি তো খাপের লোক”

সমানে সমানে টক্কর দেওয়া প্রতিপক্ষ শিখিয়েছে- ঠিকঠাক থাক নইলে গিলে খাব সবশুদ্ধ

রাত শিখিয়েছে- ভৌ, জাগা কুকুরের মত অতন্দ্র প্রহরা

কুকুর শিখিয়েছে- আনুগত্য আর মায়া

মায়া শিখিয়েছে- বন্ধন হীন হতে

মুক্তি বোধ শিখিয়েছে- শূন্য, (মৃত্যুর পর কমলা আগুন )

মৃত্যু বোধ শিখিয়েছে- পুড়ে গেলে রক্তমাংসঘাম পুড়ে যায় সব বদনাম/ আমার দুর্নাম যেন না পোড়ে নিস্কাম অমরত্বের ঘোরে/ আমি যেন বেঁচে থাকি না।

প্রথাগত শিক্ষকদের অত্যন্ত হতাশ করেছি আজীবন। তাই তাঁদের দূর থেকে প্রণাম। আর এরাও তো শিক্ষক তাই এদেরও স্মরণ করছি আজ। শেষে দুটো প্রিয় লাইন।

“গুরু বলে কারে প্রণাম করবি মন?
ও তোর অতীত গুরু, পথিক গুরু, গুরু অগণন”

Wednesday, September 1, 2021

প্রাণঘাতী শিরোনাম সংরক্ষণের জন্য ঘাতক


গত সোমবার লেখা আমাকে বাঘা বোলো না ব্লগটা শুরুতেই একবার চোখ বুলিয়ে নিন কারণ এই পোস্টটা ওটার সঙ্গেই সম্পর্কিত। হাওড়ার ওই অঞ্চলে বাঘরোল সাইটিং(Sighting ) হওয়ার পর থেকেই। এলাকায় একটা উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। যে ঘটনায় মানুষের খুশি হওয়ার কথা ছিল তাতেই তাঁরা আতঙ্কিত! বহুকাল ধরে এই এলাকাগুলো বাঘরোলের প্রাকৃতিক হ্যাবিট্যাট(Habitat)। অর্থাৎ স্থানীয় ইতিহাস বলছে বন্যপ্রান আর মানুষের সহাবস্থান ওই এলাকায় যুগ যুগ ধরে রয়েছে। সংঘাত হয় নি।

তাহলে এখন কেন হচ্ছে? প্রথমত এর জন্য দায়ী অশিক্ষা। এই অশিক্ষা বলতে আমি কোনও স্কুল কলেজ বা ইউনিভার্সিটির শিক্ষার কথা বলছি না। প্রকৃতি লব্ধ জ্ঞান। তলানিতে এসে পৌঁছেছে আমাদের। প্রতিদিন প্রকৃতির সঙ্গে যোগ কমে যাচ্ছে আমাদের। ফলত আমরা জানি না কোনটা কী। আমাদের চারপাশে কী আছে, যার সঙ্গে যাদের সঙ্গে আমাদের নিবিড় যোগ যুগ যুগান্ত ধরে! 

ইন্টারনেটের গণতান্ত্রিকতা আমদের সুবিধা দিয়েছে ইনফরমেশন খোঁজার। একই সঙ্গে ইন্টারনেট অশিক্ষা ছড়ানোরও একটা উত্তম মাধ্যম। আপনার হাতে ডেটা আছে, মোবাইলে বাই ডিফল্ট একটা ক্যামেরা আছে যাতে ফোটো ও ভিডিও রেকর্ড হয়। অতএব মনের মাধুরী মিশায়ে তাহারে করুন রচনা!! 

এই কথা লেখার কারণ ওই দুটি গ্রামের মানুষকে "অজানা জন্তু" সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য দেওয়ার বদলে কিছু ইউটিউব মিডিয়া এলাকায় গিয়ে যা করলেন সেটাকে আর যাই হোক সাংবাদিকতা বলা যায় না। বন্যপ্রান সম্বন্ধে কাজ করতে গেলে প্রতিবেদন বিজ্ঞানভিত্তিক হওয়া উচিত। বিজ্ঞান দাঁড়িয়ে থাকে প্রাথমিক ৩ শর্তের ওপর পরীক্ষা, নিরীক্ষা এবং সিদ্ধান্ত। বন্যপ্রানের প্রতিবেদনও তাই হওয়া উচিত। এটা আমার মত। এবং আমার এই ধারণা তৈরি হয়েছে বর্তমান পৃথিবীতে হার্ডকোর ওয়াইল্ড লাইফ কভারেজ অনুধাবন করে। এটাই হওয়া উচিত। এটা একটা ষ্ট্যাণ্ডার্ড রীতি। 

সংরক্ষণ কর্মীরা প্রায়ই বলে থাকেন বন্য প্রাণ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে "মশলা" খবর বা " Sensational News" প্রাণঘাতী। সংরক্ষণের জন্য মারাত্মকও বটে। এক্ষেত্রে ওই গ্রাম গুলির মানুষ আতঙ্কিত। তাঁদের কাছে যাবার আগে অল্প একটু পড়াশোনা করতেই পারতেন সংবাদ কর্মীরা। বাঘ আর বাঘরোলের তফাতটা নিজে জানতেই পারতেন। তা না করে তাঁরা যেটা করলেন তা হল কেবল উত্তেজনা ক্যামেরাবন্দী করে সেই উত্তেজনাটিকেই আরও বাড়ালেন। এরপর গ্রামবাসীরা যদি নিরীহ ফিশিং ক্যাটটিকে বাঘ বা অজানা প্রাণী ভেবে আতঙ্কে, ভয়ে পিটিয়ে মারে তার দায় কে নেবে? 

একদিকে রাজ্যপ্রাণীটিকে নিয়ে নেই সরকারি মন্ত্রক স্তরে সচেতনতা প্রসারের উদ্যোগ, কম সুবিধাপ্রাপ্ত বন দপ্তরের কর্মী (অনেকটা ঢাল তরোয়াল বিহীন কেবল মনের জোর সর্বস্ব নিধিরাম সরদার ) আর কিছু বন্যপ্রান সংগঠন (যাঁদের ফান্ড নেই আছে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর উদ্যোগ), এই নিয়ে সংরক্ষণ (পড়ুন মোকাবিলা) চলছে আমাদের রাজ্য প্রাণীটিকে বাঁচানোর। IUCN তালিকায় যে লাল। মানে অবলুপ্তির প্রহর গুনছে। উল্টোদিকে সীমাহীন অশিক্ষা। 

Monday, August 30, 2021

বাজা তোরা রাজা যায়




ত্তেজনায় হাত পা কাঁপছিল সূর্যদার কথা শুনে। সূর্যদা আজকালের দপ্তরের কাজ সেরে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের অফিসে আসতেন বিকেল বিকেল। ২০০২ এর সেই বিকেলে এসে স্বভাবসিদ্ধ বড় বড় শ্বাস আর হাঁপানি সহযোগে সূর্যদা বললেন "চল আজ লালাদার বাড়ি যাব"। লালাদা মানে বুদ্ধদেব গুহ'র সানি টাওয়ার্সের বসতবাড়িতে ঢুকে চোখ টেরিয়ে গিয়েছিল। ছাদ থেকে মেঝে অবধি কাচের দেওয়াল। সারা ঘর জুড়ে সাজানো সুদৃশ্য শো-পিস আর বই। শোবার ঘরের খাটে, বিছানার মাঝ বরাবর বইয়ের তাক। বিছানার মাথার দিকেও তাই। লেখার বিশাল একটা টেবিল, যার সামনে রাখা চেয়ারটা গদিতে মোড়ানো। সেই চেয়ারে উঠে বসতে গেলে সিঁড়ির মত দুটো ধাপ বেয়ে উঠতে হয়। তখন মোবাইল ফোন এলেও তাতে ক্যামেরা আসে নি। সেলফি তো দূর অস্ত। 

একটা উজ্জ্বল কমলা রঙা পাঞ্জাবি পরে বসে ছিলেন লালা মিঞা। বড় একটা ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন সূর্যদা। সঞ্জীব খান আর আমি ক্যামেরা ট্রাইপডে ফেলে গোগ্রাসে গল্প শুনেছিলাম বুগু'র মুখ থেকে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে যখন রাত বাড়ল সুগন্ধী দিয়ে ধোয়া ঘরটা থেকে বেরিয়েছিলাম আমরা। 'মাধুকরী', 'কোজাগর', 'কোয়েলের কাছে', 'রুআহা', 'সোপর্দ', 'চান ঘরের গান', 'ওয়াইকিকি' আর 'ঋজুদা'র স্রষ্টা তখন তাঁর আতিথেয়তার ষোলকলা সম্পাদন করেছেন। বেশ কয়েকটা এপিসোড ধরে "তারাদের বেড়ানো" দেখিয়েছিলাম আমরা।

তার অনেকদিন পর। বন বিভাগের একটা ভিডিওর কাজ করছিলাম। রাস্তার বুলেভার্ডে গাছ লাগাচ্ছিল বন দপ্তরের আরবান ফরেস্ট্রি বিভাগ। ওই বিভাগের মৈত্রেয়ি দি গুহ স্যার বলতে অজ্ঞান। সব শুট সেরে একটা দিন রাখলাম "গুহ স্যারের" জন্য। ওয়াটারলু স্ট্রীটের অফিসে সময় দিলেন তথাগত। বুদ্ধ মানে তো তথাগতই! একটা সবুজ রঙের পাঞ্জাবী পরে পান জবজবে মুখে পরিচিত হাসি মাখিয়ে বসে আছেন তিনি। আমাদের স্ক্রিপ্টে ওনার জন্য ছিল বাংলা টপ্পা, আর দুলাইন কনজারভেশনের বার্তা। গান শেষ হতে জলখাবার আর চা এল। তারপর পান। তখন পুজো আর কিছুদিন বাকি। বাইরে উজ্জ্বল বর্ষা শেষের আলো। আর পুরনো ফাইলের মধ্যে বসে তাঁর দ্যুতি ছড়াচ্ছিলেন বুদ্ধদেব গুহ।

ময়দানের ইস্টবেঙ্গল কর্তা কল্যাণ মজুমদার রাশভারী মানুষ। কিন্ত লালাদার প্রসঙ্গ উঠলে আবেগে, সম্ভ্রমে গলে জল প্রাক্তন বিমান কর্তা ও সাহিত্যিক কল্যাণ মজুমদার। বুদ্ধদেব গুহ'র স্ত্রী ঋতু গুহ যখন প্রয়াত হলেন প্রায়ই কথা হয়েছে কল্যাণবাবুর সঙ্গে। প্রসঙ্গ বুদ্ধদেব গুহ। ভাঙছিলেন একদা শিকারি পরবর্তী জীবনে সংরক্ষণকামী মানুষটা। তারই মধ্যে একবার দেখা হল ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের অনুষ্ঠানে। প্রণাম করতে গেলাম, প্রতিবারের মত বললেন, "প্রণাম করো না, প্রণম্য মানুষ আর একশৃঙ্গ গণ্ডার দুটিই বিরল"। হাসিমুখটা আজ বড্ড মনে পড়ছে।

শেষ কথা। টিভি নাইন বাংলার সঙ্গে যুক্ত হবার পর, আমাদের দপ্তরে ঠিক হল বুদ্ধদেব গুহ'র ওপর একটা কাজ হবে। কবি রাহুল পুরকায়স্থ, বস কম, মেন্টর বেশি। রাহুল দার ফোন থেকেই কথা হল। ওপারে তিনি। সবে করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন। "কয়েকটা দিন যাক, তারপরে প্ল্যান করো"। আর হল না প্ল্যানটা। আজীবন লিখে এসেছেন মানুষ একলা বাঘের মত বাঁচবে। ভালবাসার প্রয়োজনে কাছে আসবে। জীবনকে সম্পূর্ণ অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শিখিয়েছেন যে শিক্ষক তাঁর নাম বুদ্ধদেব গুহ।

ভাবতে অবাক লাগে তাঁর অজস্র সৃষ্টি। বহু সৃষ্টি মারাত্মক সিনেম্যাটিক অথচ তাঁর জীবদ্দশায় কোনও প্রোডাকশন হাউজ এগিয়ে এল না তাঁর সাহিত্যকে সেলুলয়েডে রূপান্তরিত করতে। মাধুকরীর প্রেক্ষাপট বিশাল কিন্ত 'খেলা যখন', 'হলুদ বসন্ত' বা নিদেন পক্ষে ছোট গল্প 'টাটা' নিয়েও কি করা যেত না কোনও ছবি।

ছেলেবেলায়, নাদানির দিনে যখন পাড়ার লাইব্রেরীতে কার্ড করিয়ে নিয়মিত বই পড়তাম তখন আমরা একটা খেলা খেলতাম। মাধুকরীর কাস্টিং ডিরেক্টর হবার খেলা। আমাদের সেই সময়ে পৃথু ঘোষের চরিত্রে দুটি নাম আসত এক লেখক স্বয়ং আর দুই কমল হাসান, রুষা  রুপা গাঙ্গুলি, কুর্চি শাবানা আজমি। সেই সব খেলার সময় আজ অতীত যেমন অতীত স্রষ্টা স্বয়ং। ভালো থাকুন অমৃতলোকে বুদ্ধদেব গুহ। এক অভয়ারণ্য সবুজ শ্রদ্ধা। 




আমাকে বাঘা বোলো না !



তকাল দেরি করে বাড়ি ফিরেছি অফিস থেকে। বাইকটা তখনও থামে নি। ঘনঘন ফোন আসছিল। মোটর সাইকেল চালালে সাধারণত ফোন ধরি না। তাই বাড়ি পৌঁছে পকেট থেকে ফোনটা বার করলাম। দেখলাম গ্রামীণ হাওড়ার একজন নেচার অ্যাক্টিভিস্টের ৩টে মিসড কল। আমাকে না পেয়ে তিনি মেসেজ করেছেন, "ডোমজুড়ের করলায় বাঘের আতঙ্ক ছড়িয়েছে" মেসেজের নীচে একটা ভিডিও ক্লিপ। আবার তার নীচে আর একটা মেসেজ সহ ভিডিও "পাঁচলা বেলডুবিতেও আতঙ্ক ছড়িয়েছে"। আতঙ্ক মানুষজনের এমন অবস্থা তাঁরা ভয়ে পিটিয়েও মারতে পারেন প্রাণীটিকে। সেই অ্যাক্টিভিস্টকে ফোন করলাম। ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আমাদের রাজ্য প্রাণী ফিশিং ক্যাট (State Animal of West Bengal Fishing Cat )বা বাঘরোল। বন্ধুটিও সহমত। কিন্তু গ্রামবাসীদের বোঝায় কার সাধ্য! আগ বাড়িয়ে তাঁকে বললাম "আমাকে ওনাদের নম্বর দাও, কথা বলব"। আমার পাঁচ বছরের কন্যা সারাদিন পর বাবার দেখা পেয়ে তিড়িং বিড়িং করছে ফড়িং এর মত। তাকে বললাম, "মা একটা গুল্লু বাঘরোলকে দেখে সবাই বাঘ বলে ভয় পেয়েছে! ওঁদের সঙ্গে কথা বলে তোমার সঙ্গে খেলব। নইলে সোনাবাবাটাকে ওঁরা ভয় পেয়ে মেরে ফেলবে"। ও বলল, "কেন মারবে? ওরা তো ভাল"! 

সময় নষ্ট না করে প্রথম ফোন করলাম সমীর মল্লিককে। ওনার বাড়ির দাওয়ায় ঘুরেফিরে বেড়িয়েছে পূর্ণ বয়স্ক ফিশিং ক্যাট, রাতের অন্ধকারে। সিসিটিভি ক্যামেরায় পরিষ্কার ছবি এসেছে। উনি নিশ্চিত ওটা 'বাঘ' জাতীয় কিছু। মাথা ঠাণ্ডা রেখে বোঝাতে লাগলাম। ওই এলাকায় কোনও মতেই বাঘ আসতে পারে না। মাথার ভিতরে চলছিল -আজ থেকে ২০০ বছর আগে পার্ক স্ট্রিটেও বাঘ ডাকতো,আমরা এতই বুভুক্ষু যে সব খেয়ে ফেলেছি, উন্নয়ন আর নগরায়নের জোড়া চোয়াল দিয়ে চেবাতে চেবাতে এখন জিভটুকুই অবশিষ্ট পড়ে আছে। সমীর বাবুর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলে বাঘরোল নিয়ে করা আমার ভিডিও প্রতিবেদনের লিঙ্ক পাঠালাম। বললাম খেয়াল রাখুন প্রাণীটার। ওরা নিরীহ, মৎস্যভুক, লাজুক প্রকৃতির প্রাণী। সাধারণতঃ নিশাচর। উপায় না পেয়ে, বাসস্থান আর খাবারের সংকট দেখা দিলেই তবে লোকালয়ে আসে। ওটাকে মারবেন না। ও যে আমাদের রাজ্যপ্রাণী! পৃথিবীতে রোজ কমছে ওদের সংখ্যা। 

এরপর ফোনে ধরলাম আর এক আতঙ্কিত মানুষ লেনিন বসুকে। তাঁকেও বোঝালাম বললাম। তিনি আজও ফোন করেছিলেন। তাঁদের গ্রামে বন দপ্তর থেকে বন কর্মীরা এসে খাঁচা পেতে দিয়ে গেছেন। ওখানে গতকাল একটা পুকুর পাড়ে মাছের আশায় এসেছিল বাঘরোল। গ্রামের মানুষরা স্বস্তি পেয়েছেন। 
বাঘরোল সম্পর্কে ২টি কথা 

আইএউসিএন লাল তালিকায় সংরক্ষণের নিরিখে অতি সংবেদনশীল আমাদের রাজ্যপ্রাণী- বাঘরোল বা ফিশিং ক্যাট। ফেব্রুয়ারি মাস আন্তর্জাতিক ভাবে ফিশিং ক্যাট ফেব্রুয়ারি হিসাবে ঘোষিত হয়েছে। বাঘরোল, একমাত্র বৃহৎ মার্জার প্রাণী যা জলে ডুবে তার শিকার ধরে। বেড়াল জাতীয় প্রাণী সাধারণত জল এড়িয়ে চলে। অথচ এই বেড়ালের বেঁচে থাকার জন্য জলই হল অন্যতম শর্ত। এদের গায়ে লোমের দুটি পরত এবং অন্য বিড়ালদের তুলনায় দুটি চোখ কাছাকাছি হওয়ায় এদের শরীরের গঠনতন্ত্র আন্ডারওয়াটার হান্টিং এর জন্য অনুকূল। 

২ 
একদিকে উন্নয়ন, কৃষি আর নিবিড় মৎস্যচাষের জন্য রোজই ধ্বংস হচ্ছে প্রাকৃতিক জলাজমি। ফল স্বরূপ বাসস্থান আর খাদ্যের সংকটে পড়ছে বাঘরোল। প্রতি বছর ৩০% হারে হু হু করে কমছে ওদের সংখ্যা।  ওদের আবাসের ৯০% ই লোকালয় সংলগ্ন। আর অন্যদিকে ওদের সম্পর্কে নেই সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা। তাই ওদের বাঁচাতে গেলে মানুষের সাথে বাঘরোলের সহাবস্থান অত্যন্ত জরুরী।  পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া, হুগলি, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, আর উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে পাওয়া যায় ওদের। জলাভুমির বাস্তুতন্ত্রের শীর্ষ শিকারি। সে বাঁচলে তবেই ভারসাম্য রক্ষা হবে একটা বড়সড় ইকো সিস্টেমের।  তাই বাঘরোল সংরক্ষণের বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে স্থানীয় যারা নেচার অ্যাক্টিভিস্ট তাঁরা তাঁদের সীমিত সামর্থে যতাটা পারছেন অ্যাওয়ারনেস ক্যাম্পেইন চালাচ্ছেন। কিন্তু সরকারী দণ্ডমুণ্ডের কর্তা যাঁরা, মানে বন মন্ত্রকের তরফে সচেতনতা কোথায়? কোথায় হোর্ডিং-এ, ব্যানারে, কাগজে, টেলিভিশনে মানুষকে সচেতন করা অ্যাড ? যেসব জায়গায় বাঘরোলের বাসস্থান সেখানে কি  বন মন্ত্রক থেকে যথেষ্ট পরিমাণে সচেতনতা ছড়ানো হয়ে থাকে? মন্ত্রকের বরাদ্দ খাতের অর্থগুলো তাহলে ব্যবহৃত হয় কোন খাতে? এ প্রশ্নটা তো উঠবেই। স্থানীয় মানুষ বাঘ আর বাঘরোলের তফাৎ করতে পারছেন না মানে বন মন্ত্রকের তরফ এ কোনরকম উদ্যোগই নেই কি এলাকাগুলোয়? প্রশ্নটা তো উঠবেই। আর উত্তর কোনও কিছু আসবে না তাও জানা। তবুও প্রশ্নগুলো তোলা রইল। কেবলমাত্র ফিশিং ক্যাট ফেব্রুয়ারিতে পোস্টার ছাপিয়ে "সেভ ফিশিং ক্যাট" বললাম; আর বাকি সময়ে কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আর খুব কম সুবিধাপ্রাপ্ত বন বিভাগের কাঁধে দায় ঝেড়ে ফেলে দিলাম। এ কোন পথে হাঁটছে আমাদের রাজ্যের রাজ্যপ্রানীটির সংরক্ষণের চালচিত্র? কারণ সংরক্ষণ একটি লাগাতার প্রক্রিয়া আর তাতে হাল ছেড়ে দিলেই বিপদ! শুধু প্রাণীটিরই নয় মানুষেরও।  


বাঘরোল সম্পর্কে আরও জানতে ক্লিক করুন নীচের লিঙ্কে



Sunday, August 15, 2021

অ্যান্থেমঃ শুনলেই কান্না পায়!

স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা। আজ বিভিন্ন জায়গায় বারেবারে বাজল যে গান অর্থাৎ জাতীয় সঙ্গীত বা ন্যাশানাল অ্যান্থেম। তাকে নিয়েই আজকের কথা। জাতীয় ফুটবল এবং রাগবি দলের বেশ কয়েকটা ম্যাচে সুযোগ হয়েছিল খেলোয়ারদের জাতীয় সংগীত গাওয়ার মুহূর্তটা পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে ক্যামেরাবন্দি করবার। সেই সময়ে এবং অন্য সময়ে গ্যালারিতে বসে জাতীয় সংগীত বা কোন অনুষ্ঠানের শেষে ওই গানটা শুনলেই কেন জানিনা দুটো চোখ জলে ভরে যেত, আজও যায়।
মুশকিলটা হল কাজের সময়ে। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি ভারত আর ইরানের ম্যাচ শুরু হবে তার আগে টিম লাইন আপ হয়েছে। এবার শুরু হবে রবি ঠাকুরের গান। পাবলিক অ্যানাউন্সমেন্ট সিস্টেমে ঘোষণা STAND UP FOR NATIONAL ANTHEM OF INDIA. নাক ফোঁসফোঁস আমার শুরু। বুক দুরু দুরু, কাঁধে থাকা ক্যামেরাটা না কেঁপে যায়! কমান্ড আসছে প্যানেল ডিরেক্টরের। ওই সময়ে আমার শট ছাড়াও আরও ৫টা ক্যামেরার শট সুইচ হয়ে একটা মালা গাঁথা হবে। টিম লাইন আপের একপ্রান্ত থেকে শুরু করে মোলায়েম পদক্ষেপে এক একজন খেলোয়াড়কে দেখিয়ে আমি যখন ক্যাপ্টেনের কাছে এসে থামব তখন অবশিষ্ট পড়ে থাকবে জাতীয় সঙ্গীতের "জয় জয় জয় জয় হে"। ব্যাস এটুকুই মাথায়। বুকে টলটলে কান্না। আর মনে আর কিচ্ছু নেই... ব্ল্যাঙ্ক।
আমার ডান চোখটা ঢাকত ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডার আর বাম চোখটা খোলা বন্ধ করবার কারণে কোনওদিন জল বেরোত না। তারপর দুইদলের করমর্দন আর টস। একটা অদ্ভুত ঘোর তৈরি হত ম্যাচ শুরুর ওই মুহুর্তে। এত বিচ্ছিরি একটা ভাল লাগা যে তা বারে বারে কাঁদাত। কিছুটা অ্যড্রিনালিন আর বাকিটাকে কী বলে জানি না, দেশপ্রেম কিনা। তবে ওই একটা কাজের জন্য খেলার ক্যামেরা ওয়ার্কে হ্যান্ডহেল্ড না ব্যাগিক্যাম আজও আমার সেরা পছন্দের পজ়িশন। 

অন্য দেশের জাতীয় সঙ্গীত এর ক্ষেত্রেও একই সমস্যা হত। যেমন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত।  কারণ হয়ত ওই একই। রবীন্দ্রনাথ। "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি" এই গানটার "অঘ্রানে তোর আমের বোলের ঘ্রাণে পাগল করে"কানে ঢুকলেই তারপর থেকে শুরু হতো আমার ভেতরে তোলপাড়। বাংলাদেশের ফুটবলারদের অনেকে সেটা লক্ষ্যও করেছেন।  যদিও বহিঃপ্রকাশ থাকত না আমার।  কিন্তু যখন "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসিইইইইই"  দিয়ে শেষের স্ট্র্যাঞ্জা শেষ হত চোখে কেন জানিনা একফোঁটা জল চলে আসতই। বারেবারে হয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় হয়েছে, বিভিন্ন মাঠে হয়েছে, কারণ জানা নেই। অথচ ওই সময় কী কঠিন ভাবে মনকে সামলাতাম আমি! 

প্রায় এক রকম হত FIFA অ্যান্থেমের প্রথম ৫ সেকেন্ড। ওই গান প্রায় ২০০০ বারের মত শুনেও আজও শুনলে একই রকম দুরুদুরু হয়। 

কোনওদিন একচুলও ভুলচুক হয় নি আমাদের কারও। এটাই স্পোর্টস ব্রডকাস্ট ক্যামেরা ক্রিউতে কাজ করবার একটা শিক্ষা। সিনিয়রদের দেখে একটা পরম্পরাকে ফলো করে বড় হওয়ার অভ্যাস। সারা গ্যালারি যখন অ্যান্থেমের আবহে আবেগে ভাসে। আমরা তখন কনসেনট্রসনের চূড়ান্ত শিখরে। তখন আমরা সেই আবেগের ঘোড়ার লাগাম শক্ত হাতে ধরে তাতে সওয়ার হয়ে ভেসে যাই, হাওয়ার মত, হাসির মত, কুসুমগন্ধরাশির মত। আর আমার মত কিছু নাদান, বাচ্চাকাচ্চা ওই সব দেখে কিছুটা ভয়ে কিছুটা সম্ভ্রমে আর ভাললাগায় কেঁদে ফেলে, এই আর কি। 

Sunday, August 1, 2021

চাইছি তোমার বন্ধুতা- প্রসঙ্গঃ বাংলা বেসরকারি টেলিভিশন

" ব্যাক টু ব্যাক দো টি২০ ম্যাচ, হ্যাণ্ড হেল্ড ক্যামেরা পজিশন। দাদা আপ সে হো পায়েগা না?" ফোনে বলেছিলেন রমেশ সিনহা। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে আমাকে বুক করবার সময়ে। টানা ৪০ দিন সেবার কেটেছিল ৩৬টা ক্যামেরা ইউনিটের মাঝে। ডিরেক্টর অস্ট্রেলীয় টিম ফিনলে (Tim Finley)। পকেটে তাঁর অনেকগুলো ওয়ার্ল্ড কাপ আর প্রায় সব কটা আইপিএল ডিরেক্ট করবার  অভিজ্ঞতা। ডিওপি সাউথ আফ্রিকার মরিস ফরি (Marius Fourie)। সঙ্গে ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা, কানাডা আর জার্মানির একঝাঁক অভিজ্ঞ ক্রু মেম্বার। "দাদা আপ সে হ পায়েগা"র দোলাচল ভুলে টুর্নামেন্টের ২য় ম্যাচে মানে প্রথম দিনেই ওয়েল ডান বলে গেলেন রমেশ স্যার। ঢাকা, চট্টগ্রাম , সিলেট টৈ টৈ করে কেটে যাওয়া ৪০টা দিন আজও জীবনের অন্যতম সেরা অ্যাসাইনমেন্ট হয়ে থাকবে। 


রোজ ভোর ৬টায় ঘুম থেকে উঠে সাতটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট সেরে ক্রু বাসের জন্য অপেক্ষা করা। আর সেই বাসটার দরজা খুলে গেলে প্রতিদিন বাসটায় ওঠার সময়ে রোমাঞ্চ জাগত। যেকোনও প্রফেসনাল ক্যামেরাম্যানের স্বপ্নে থাকে ওরকম একটা বাসে সওয়ার হওয়ার। বাসটা স্টেডিয়ামে থামলেই যে যার কাজে লেগে যাবে। স্ট্যাম্প ক্যাম আর হক আই প্রথমে সেট হবে তারপর স্পাইডার ক্যাম। তারপর ড্রোন। ততক্ষণে একটা কফি নিয়ে ম্যানড ক্যামেরার অপারেটরদের সঙ্গে একটা মিটিং করবেন টিম আর মরিস। সেটা মিটিং কম মজাই বেশি। টিম মানুষটা বেশ মজার। বিশেষ করে ওনার জন্যই ক্রিকেট ব্রডকাস্টের প্রাথমিক জড়তাটা কেটেছিল। বয়স ষাট পেরিয়েছে। প্রথম জীবনে ছিলেন ক্যামেরাম্যান। প্রথম মিটিংয়েই বলেছিলেন। পর পর দুটো ম্যাচ এই কথাটা মাথায় ঢুকিও না। হ্যাব ফান। এণ্ড এনজয় দ্যা গেম। আর আমদের উদ্দেশ্যে মানে আমি আর টিটু র উদ্দেশ্যে বলেছিলেন হ্যাণ্ড হেল্ড ক্যামেরা অকারনে কাঁধে রাখলে আমি মাঠে গিয়ে হাঁটু ভেঙে দিয়ে আসব। রিল্যাক্স করবে, যতটা সম্ভব। বিশ্বাস করুন সব জড়তা কেটে গিয়েছিল। মিটিংয়ের পর মাঠে যে যার পজিশনে চলে যাবে। শুরু হবে ফ্যাক্টস চেক। অডিও, সুপার স্লো মোশান , আলট্রা স্লো মোশান, অ্যাগুমেণ্টেড আর ভার্চুয়াল রিয়েলিটি গ্রাফিক্স। আর তার দু ঘণ্টা পর ম্যাচ শুরু। ২টো ম্যাচের শেষে শুরু হবে "ডি রিগ"। ক্যামেরা ডিসমেন্টাল করে বক্সে প্যাক করে প্রায় কয়েক কিলোমিটার কেবল গুটিয়ে তারপর সব জিনিসপত্র আসত স্টেডিয়ামের নির্দিষ্ট একটা জায়গায়। নিজেদের কাজ শেষ করবার পর কাজ শুরু হত আমাদের। আমি অয়ন সৌমেন দা আর মরিস। সব ইউনিট আর কেবল মার্কিং করে তা লিপিবদ্ধ করে তবে আমাদের ছুটি হত। 

সব সবসময়ে মাতিয়ে রাখত ড্যানি মরিসন

হোটেলে ফিরে ডিনার পেটে পড়লেই ঘুম আসত। ছুটির দিনে সকালটা কাটত টিভি দেখে। বেশিরভাগ "গান বাংলা"ই দেখতাম। ওদের কর্ণধার তাপস মাঠে আসতেন। দেখা হত রোজই। নিজেও দারুণ মিউজিশিয়ান। তাছাড়াও দেখতাম খবরের সব চ্যানেল গুলো। অদ্ভুত এক সহাবস্থান বাংলাদেশের নিউজ মিডিয়াগুলোর। আমাদের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের সম্প্রচার সত্ত্ব বাংলাদেশে ছিল মাছরাঙা টেলিভিশনের আর গ্লোবাল রাইট ছিল ডি স্পোর্টসের। ম্যাচের প্রতিদিনের হাইলাইটস যখন অন্য চ্যানেল দেখাত তখন তারা স্পস্ট লিখত "সৌজন্য মাছরাঙা টিভি"। আমাদের এই বাংলায় দুটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা বিরল। তাছাড়াও দেখতাম একটি চ্যানেলে অন্য চ্যানেলের অস্তিত্ব স্বীকার করবার রেওয়াজ। বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে যাবার ফলে একাধিকবার দেখেছি বৈশাখী টিভির জন্মদিনে একাত্তর টিভি ফুলের বোকে পাঠাচ্ছে এবং সেটা খবর হিসাবে প্রচারিত হচ্ছে! ভাবুন বিষয়টা।আর আমাদের এখানে পরিবেশটা এমন যেন এবিপি আনন্দ ভাবে ২৪ ঘন্টা মঙ্গল গ্রহের বাসিন্দা। ২৪ ঘণ্টা মনে করে কলকাতা টিভি এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিতে থাকে, কলকাতা টিভির কাছে দূর কোনও নক্ষত্রের বাসিন্দা টিভি ১৮। অন্তত চ্যানেল গুলো দেখলে যেন তাই মনে হয়। তখন হোটেলের একাঘরে বসে বসে বারবার মনে হত কেন এমন আমাদের বাংলায়, পশ্চিমবঙ্গে, হয় না। 

দুই বাংলাতেই মিডিয়াকর্মীরা প্রতিদিন একসাথে কর্মক্ষেত্রে থাকে।  ওপার বাংলায় ওরা একসাথে রবার বুলেট আর পেট্রল বোমা বা ককটেল বোমা একসাথেই খেয়েছে । আর এখানেও আমরা লাঠি, টিয়ার গ্যাস বা  স্প্রিন্টার একসাথেই খাই। বন্ধুতা না থাকলে সেটা হয়? এই কিছুদিন আগে ধাপায় গিয়েছিলাম একটা স্টোরি কভার করতে। ধাপার শ্মশান। ওখানে গিয়েই মনে পড়ল আজকালের ফটোগ্রাফার রনি দার কথা। রনি দার নশ্বর দেহটা ওই চুল্লি থেকেই ধোঁয়া হয়ে বাতাসে মিশে গিয়েছিল। বন্ধুত্ব না থাকলে সেটা হয়? শুধুই কি ব্র্যাণ্ডিং। খুব অল্প দিনের সাক্ষাত তবু আজও মিডিয়া সিটির ৩ নম্বর লিফটটায় উঠলেই মনে পড়ে অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখটা। বড় অল্প দিনের মেহেমানরা সব আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। 



আজ এই পয়লা আগস্ট সেই খেদ একটু হলেও মিটল একটা ছোট্ট ছবিতে। এই ছবিটা ঐতিহাসিক একটা দলিল হয়ে থাকল পশ্চিমবাংলার বেসরকারি মিডিয়া ইণ্ডাস্ট্রিতে। দেখুন ব্রেকিং, এক্সক্লুসিভ, সবার আগে খবর ধরানোর লড়াইটা তো থাকবেই। সুস্থ প্রতিযোগিতা উৎকর্ষতা আনেই। তা বলে বন্ধুতা রাখতে দোষ কোথায়? আর বন্ধুতা থাকলে সেই বন্ধুতা স্বীকার করতেও দোষ কোথায়? সেলিব্রেশনের দিন আজ। কি তাই না? তবে দুঃখ একটাই সেটা স্বীকার করতে এতটা দেরি হল। আর আনন্দ একটাই অবশেষে বন্ধুত্বের জয় হল। 


Thursday, May 20, 2021

করোনা যুদ্ধের জন্য কতটা ক্ষতিকর কাকলি ফার্নিচার মিম

করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গে "আসলি হিরো"র নাম কিন্তু ফেসবুক (এবং হোয়াটসঅ্যাপ যা কিনা আদতে ফেসবুকেরই ভগ্নী সংস্থা)। লক ডাউনে সব যখন স্তব্ধ তখন অক্সিজেন, আরটিপিসিআর টেস্ট, অ্যাম্বুলেন্স, খাবার সংক্রান্ত নানান সুলুক সন্ধান (পড়ুন 'লিড') আসছে সোশ্যাল মাধ্যম থেকে। কোথায় সহজে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায়। কোথায় সেফ হোম কোথায় কে নেগেটিভ রিপোর্ট দেখলেই খাবারের থালা নিয়ে হাজির হবে। তার সমস্ত খোঁজ এখানেই। 

দিকে দিকে বহু মানুষ লড়ছেন। লড়ছেন স্বার্থহীন ভাবে। লড়ছেন অপরের জন্য। এটাই বোধহয় একটা অতিমারি বা কঠিন সময় দিতে পারে আমাদের। অন্যের জন্য প্রাণপাত করছে মানুষ। ফেলো ফিলিংস আজ আশা দেখাচ্ছে আমাদের, এই অস্থির সময়টা পার করবার জন্য ভরসা যোগাচ্ছে। তারই মাঝে এল কাকলি ফার্ণিচার। টাইমলাইনে সুনামী বয়ে গেল। হরি দা পাঁচ দা থেকে নামিদামী কেষ্ট বিষ্টু সবাই উদ্বেলিত সেই ফার্নিচারের বোকা বোকা মিমে। আর এখানেই একটু পিছিয়ে গেলেন ওই কোভিড যোদ্ধারা। 

কেন বলছি? আপনি হয়ত ভাববেন চারিদিকে মৃত্যু আর আতঙ্কের বিভীষিকা তার মধ্যে দু'দণ্ডের হালকা ছলে মনোরঞ্জন খারাপ কি!  মাথা ঠাণ্ডা করে, আপনার সব বিষয়ে (ভিখিরির চাদর থেকে রাতের আদর) পাণ্ডিত্যের গুগলনামা সরিয়ে শুনুন তাহলে।  

ফেসবুক বা ইউটিউব জাতীয় সোশ্যাল সাইট গুলো চলে একটা অ্যালগরিদম মেনে। কেমন সেই অ্যালগরিদম? তার কয়েটা ফর্মূলা আছে। 
এক) আপনি যা দেখেন মানে যে ধরনের কন্টেন্ট দেখেন(ছবি,পোস্ট বা ভিডিও ) সেই ধরণের কন্টেন্টই আসবে আপনার নিউজ ফিডে। 
দুই) আপনার বন্ধুরা যে ধরণের কন্টেন্ট দেখে তারও কিছুটা প্রতিফলিত হয়। 
তিন) আপনি যাঁদের ফলো করেন তাঁরা যে ধরনের কন্টেন্ট দেখে। 
আর
চার) যে সব কন্টেন্ট ব্যাবসায়িক ভাবে প্রোমোটেড হয় ।

এবার প্রথম তিনটে পয়েন্টের মধ্যে যে কোনটা নিয়ে যদি কথা বলা যায়, ধরুন আপনার নিউজ ফিডে কমিউনিটি হেল্প সংক্রান্ত পোস্ট আসছিল। আপনার মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ছিল অনেকের মধ্যে যাঁরা এগুলো জানতেন না, বা জানতে চান, সাহায্য করতে চান। একটা জনজাগরন তৈরি হচ্ছিল। এর মাঝে হঠাৎ 'কাকলি ফার্নিচার' এসে সেই কমিউনিটি হেল্পের চেইনটাকে নষ্ট করে দিল। খেয়াল করে দেখুন সাম্প্রতিক কালে রেড ভলান্টিয়ার, অ্যাক্টিভ ইউথ, নিউটাউন ফোরাম এণ্ড নিউজ, স্বপ্ন দেখার উজান গাঙ, কেডিস কিচেন বা আনাড়ি কিচেন দের পোস্ট আপনি কম দেখতে পাচ্ছেন। বেশী পাচ্ছেন কাকলি ফার্নিচার। 
অ্যালগরিদম ফারাক বোঝে না। আপনার ক্লিক বোঝে আপনি কী দেখছেন সেটা বোঝে। পারবেন কি এই দায়টা এড়াতে।

Monday, May 17, 2021

প্রকৃতির প্রতিশোধ

২০-০৫-২০ থেকে ঠিক ৩৬২ দিন পর আজ আবার একটা জাতীয় বিপর্যয়ের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দেশ। গুজরাতে তাণ্ডব চালাতে চলেছে ঘূর্ণিঝড় তাউট। আমফানের স্মৃতি এখনও টাটকা তাই আশঙ্কায় বুক দুরুদুরু। ইতিমধ্যে প্রিমাথ শুরু হয়ে গেছে কেরল, মহারাষ্ট্র আর কর্ণাটকে। 

এখনও মনে আছে ২০ মে ২০২০র সন্ধ্যে আর তার আগে ও পরের দিন গুলো। একটা আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেলের জন্য কাজ করছিলাম তখন। খুব সামনে থেকে দেখেছি তাণ্ডবনৃত্য ও তার দরুণ হয়ে যাওয়া ক্ষয়ক্ষতি। মহামারী পরিস্থিতি একে চালাচ্ছে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি তার মধ্যে প্রাকৃতিক তাণ্ডব। আমি অবশ্য তাণ্ডব না বলে প্রতিশোধই বলব। আমাদের দৈনন্দিন জীবন যত সময় যাচ্ছে প্রকৃতি বিমুখ হয়ে পড়ছে আর তারই প্রতিশোধ তুলছে প্রকৃতি। শুধু বাক্স বাক্স বাড়ি ঘরদোর। প্রকৃতিকে প্রায়োরিটি লিস্টে রাখে না কেউই। না জনগন না সরকার। তাই উন্নয়নের নামে সারা দেশ জুড়ে যথেচ্ছাচারটাই এখন দস্তুর। 

সবাই সহ্য করে প্রকৃতি সহ্য করে না। সে ঠিক তার নিজের ভারসাম্য বজায় রাখে। আর তাই এই প্রাকৃতিক রোষ!  মানুষ এই পৃথিবীটাকে নিজের করায়ত্ব করে ফেলেছে বলে যত আস্ফালন দেখাবে ততই বাড়বে এই ধরনের তাণ্ডব। নীরব দর্শক হয়ে ক্ষয় ক্ষতির হিসেব গোনা ছাড়া আর কিছুই করবার নেই এখন। অতএব এখন শুধু প্রতীক্ষা ডেথ টোল কত হয়, হাওয়ার বেগ কত হয়, কত দ্রুত উপকূলবর্তী মানুষদের নিরাপদ আস্তানায় নিয়ে যাওয়া যায়। 

মন থেকে চাই আর যেন মৃত্যুর নতুন রাজত্ব কায়েম না হয়। মানুষ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন। যদিও জানি ১১০ কিলোমিটার বেগে হাওয়ায় কী হতে পারে। তাউট নাকি ১৮৫ প্রতি কিলোমিটার বেগে আছড়ে পড়বে। তাই আশঙ্কাটা বাড়ছেই। 

Tuesday, May 4, 2021

"আমি অনেকদিন খেলতে যাই না"



প্রায় একটা বছরের বেশি হয়ে গেল আমরা ঘেঁটে গেছি। ভাইরাসের ভিমরুলে ভিরমি খেয়ে দিশাহারা হয়ে গেছি। মেলামেশা বন্ধ। আদানপ্রদান বন্ধ। মুখ নাক খুলে শ্বাস নেওয়া বন্ধ। সবচেয়ে বেশি কষ্ট ছোটদের। ওরা ওদের সামান্য প্রাপ্য, দাবী, আবদার গুলো কীভাবে স্যক্রিফাইস করছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আমার কন্যা সবে সাড়ে চার। সে এখনই বুঝতে শিখে গেছে বাবা দরজার বাইরে বেরিয়ে ফিরে এলে স্যানিটাইটাইজড না হলে কাছে আসতে নেই। নিজেকে বাঁধতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। 
তো তার ক্লাস হয় অনলাইনে। সেলফোন মনিটারে চোখ রেখে মাঝেমাঝে সহপাঠীদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। রোজ আমার স্ত্রীই ওকে নিয়ে বসেন অনলাইন স্কুলে। একদিন আমি বসলাম। মেয়ে আমার সেদিন খুব খুশি। সর্পের পঞ্চপদ দর্শন হয়েছে তার। ক্লাসে মন নেই। ম্যাডাম যা যা ইন্সট্রাকশন দিচ্ছেন কিচ্ছু শুনছে না। আমি তো গলদঘর্ম। অডিও অফ করে বকুনি দিলাম, "বী অ্যাটেনটিভ"! এরপর শুরু হল নতুন এক ঘটনা। আয়নার যেমনটা দেখা যায় তেমন লিখতে লাগল সে ইংরেজি বর্ণমালা। মানে মিরর ইমেজে B, C, D, J, K ইত্যাদি। আমার রাগ আরও বেড়ে গেল। চুপ থাকলাম। ক্লাসের শেষে ফোন বন্ধ করে তাকে খুব কড়া করে বকলাম। 
-আজ থেকে একদম কার্টুন দেখবে না
-টিভি চালানো বন্ধ, আর একদম খেলাও বন্ধ, কোথাও খেলতে যাবে না। 
- সে চুপ। মাথা নিচু করে চলে গেল। 
পাঁচ ছয় পা গিয়ে ঘুরে আমার দিকে হনহন করে এগিয়ে এসে চিৎকার করে বলল
-আমি অনেকদিন হয়ে গেল কোথাও যাই না, কারও সঙ্গে খেলতে যাই না। আমার কোনও বন্ধু নেই। 

আমার মাথাটা নিচু হয়ে গেল। সত্যিই তো ও তো আর খেলতে যায় না। কেন এরকম বললাম? এরপর শুরু হল ভয়। মেয়েটা আমার ডিসলেক্সিয়া আক্রান্ত হয়েছে নাকি? উল্টো লিখছে কেন? সারাদিন মাথায় ঘুরতে লাগল - আমি অনেকদিন হয়ে গেল কোথাও যাই না, কারও সঙ্গে খেলতে যাই না। আমার কোনও বন্ধু নেই। 
সন্ধ্যেয় বাড়ি ফিরে আমার স্ত্রীকে বললাম। সে বলল কোনও ডিসলেক্সিয়া নয় ওটা দুষ্টুমি। মেয়েকে ডাকলাম, "মাম্মাম চলো আমরা ছবি আঁকব " A  দিয়ে একটা তীর, B দিয়ে বল, C দিয়ে বেড়াল। D টা ইচ্ছে করে ওকে লিখতে দিলাম। ও আবার উল্টো ক্যাপিট্যাল D লিখল। আমি এবার না রেগে, হেসে বললাম, 
- এটা তো ভুল হয়ে গেল। এটা কি ডি হল? 
- বাবা এটাও ঠিক। এটা আসলে স্মল ডি। আমি ওপরের স্ট্যাণ্ডিং লাইনটাতো দিই নি। 
বলে উল্টোনো ডিএর ওপর একটা দাগ টেনে তাকে স্মল ডি করে দিল। 

আসলে ওরা যারা আমার মেয়ের সমবয়স্ক তারা সবচেয়ে বেশি মানসিক চাপের মধ্যে আছে। যে বয়সটায় ওদের চারপাশটা এক্সপ্লোর করবার সময়, সেই বয়সে ওরা বাধ্য হচ্ছে ঘরে বাঁধা হয়ে থাকতে। অথচ ওদের এই অসুবিধাটা বলে বোঝাবার মত শব্দ ওদের কাছে নেই। তাই ওদের এই কনফাইনমেন্ট, অ্যাগ্রেশন হয়ে বের হচ্ছে। কেউ চিৎকার করছে, কেউ ঘ্যানঘ্যান করছে কেউ বদমায়েসি করছে। মোদ্দা কথা ওরা ভাল নেই। আর কেউ চিন্তিতও নন ওদের নিয়ে। 

এশিয়ার বেশ কয়েকটা দেশে প্রিস্কুলার বাচ্চারা যাতে ভাল থাকতে পারে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল করোনার প্রথম তরঙ্গের সময়ে। তরঙ্গ কিছুটা স্তিমিত হলে খোলা হয়েছিল স্কুলও। খুব সম্ভবত মালয়েশিয়ার একটা স্কুলের ছবিও দেখেছিলাম খবরে। শারিরীক দূরত্ববিধি মেনে প্রতিটি শিশুর চারিদিকে স্বচ্ছ দেওয়ালের ঘেরাটোপ দিয়ে ক্লাস চলছে। ওরা তার মধ্যে দিয়ে বন্ধুদের দেখছে, কমিউনিকেট করছে, হাসছে খেলছে, আর সবচেয়ে বড় যে বিষয়টা "আমি একলা নই" এই অনুভূতিটা পাচ্ছে। 
আমাদের দেশে। এরকম যদি কোনও স্কুল করতে চায়, পরীক্ষামূলক ভাবেও। তাহলে। অবস্থাটা কল্পনা করুন একবার।

অতএব বিরাট কোহলিরা কেন খেলতে পারছে না আইপিএল তা নিয়ে না হয় আলোচনা হোক। তর্ক হোক। চায়ের কাপে, হোয়াটসঅ্যাপে মারামারি, মারকাটারি হোক । আর আমার আপনার ছোট্ট কচিকাঁচা গুলো তাদের বন্ধুদের দেখতে না পেয়ে, বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে না পারার কষ্টে গুমরে গুমরে মরুক ঘরের কোনে। তাতে কি আর এমন এল গেল? 

Disclaimer : এই লেখাটি শিশুমনের অত্যন্ত অন্তরীণ একটি বিষয় নিয়ে। এই লেখার উদ্দেশ্য কখনই করোনাবিধি ভঙ্গ করা না। করোনার তৃতীয় তরঙ্গ শিশুদের জন্য মারাত্মক। শিশুর সুরক্ষা সম্বন্ধে অবহিত থাকুন। সুরক্ষা বিধি মেনে চলুন। বাড়ির মানুষদের সঙ্গে বেশি করে সময় কাটান। কে বলতে পারে আজ আছি কাল হয়ত নেই।  


Saturday, April 17, 2021

তুমি আর আমি গিয়েছি যে সরে সরে



শুভ নববর্ষ। বেশ কিছুদিন বাদে আবার লিখতে বসলাম। গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের লাইন গুলো মনে পড়ছে। একটু বদলে নিলে হয়, পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে ইউ টিউব, ফেসবুক আর টুইটারে বন্দী হয়ে পড়েছে। বেশ কয়েক বছর নিজে ব্যাক্তিগত উদ্যোগে কণ্টেণ্ট তৈরি করতাম । এখন সেই কাজটাই দেশের একটি অগ্রগণ্য চ্যানেলের জন্য করি। আর সেই সুত্রেই কাজ করতে বেরিয়ে একজন খুব জনপ্রিয় কন্টেণ্ট ক্রিয়েটরের সঙ্গে আলাপ হল। 

তিনি এতটাই জনপ্রিয় যে নাম বললে যে কেউ চিনবেন। আর তাঁকে এই ব্লগে ট্যাগ করলে বা তিনি এই ব্লগটি শেয়ার করলে এই ব্লগটা ভাইরাল হয়ে  পড়বে। আপাতত আমি সে পথে যাচ্ছি না। তাঁর নামটা বলছি না। তা সে যাই হোক, তাঁর সঙ্গে পরিচয় হবার পর দেখলাম, মানুষটা তাঁর ভ্লগ জীবনের চেয়ে একদম আলাদা। ভিডিওতে মারাত্মক চোখা চোখা শব্দ, আক্রমণ শানানো বাক্য। কিন্তু বাস্তবে মানুষটা একদম অন্যরকম। বড় শান্ত, ম্রিয়মান বা বলা ভাল খুব একা। দামি বাড়ি, গাড়ি আছে বেড়াতে গেলেও স্পনসরশিপ আছে। কিন্তু নেই যেটা সেটা হল প্রাণ খুলে বাঁচা। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে নেই বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, নেই গণপরিবহনে যাতায়াতের স্বাধীনতা। যেন স্বেচ্ছায় আরোপিত জনপ্রিয়তার একটা মজবুত খাঁচায় বন্দী তিনি। হয়ত হাঁসফাঁস করে কিন্তু উপায় নেই এই খাঁচা ভেঙে এক মুহুর্তের জন্যও বেরোনোর। উপায় নেই সাইবার তারকা খচিত আকাশ থেকে বেরিয়ে এসে মুক্ত আকাশের দিকে চেয়ে মাথা তুলে একমুহুর্ত তাকানোর! 

 আসলে আমাদের এই সাইবার জীবন যাপন হয়ত এরকমই। যেটা দেখছি সেটা হয়ত দেখানো হচ্ছে। আমি সেটা নয়। আমি আসলে যা সেটা অন্য কেউ। আমি হঠাৎ যদি খুব ভাইরাল হয়ে পড়ি । তারপর দিন থেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খেতে পারব না, বা সিগারেট খেতে পারব না! কারন আমার সেই নিতান্ত সাধারন ছবিই হয়ত ভাইরাল কণ্টেণ্ট হয়ে ঘুরবে এই 'সাইবার কলতলায়'। আসলে আমিই আমার চারপাশে একটা কোকুন বানিয়ে তার মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। স্বআরোপিত একটা নির্মোকের জালে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলেছি। 

সাইবার সেই আঙিনায় আমরা সব্বাই এক কঠিন মানসিক অসহায়তায় ভুগছি। আপনি হয়ত মানুষটা শান্ত, নিরুপদ্রব কিন্তু কোনও বিষয় আপনার পছন্দ না হলে আপনার ভিতর থেকে বার হয়ে আসছে একটা অন্য মানুষ। যাকে অবদমিত করে রেখেছে আপনার দৈনন্দিন যাপন। আর সে বার হয়ে এসে কমেন্টের পর কমেন্ট করছে। তীব্র তার ঝাঁঝ। সেই তীব্রতার খতিয়ান পড়ে সেই কমেন্ট থ্রেডের মানুষটা আর আসল মানুষটাকে পাশাপাশি রাখলে চেনা যায় না। এমনই মাহাত্ম এই সাইবার উঠোনের। আসলে সাইবার গণতান্ত্রিকতা সব্বাইকে দিয়েছে অধিকার, বলবার, দেখানোর। আর সেই অধিকার অভ্যাস করতে করতে কখন সেটা সীমানা পার হয় সে খেয়াল থাকে না। বলতে বলতে যা খুশি বলা যায় যেন। যাকে খুশি বলা যায়। শালীনতা , শিক্ষা সব তাকে তুলে রেখে যেন বলা যায়। গলার রগ ফুলিয়ে কখনও কখনও "চোপ" বলেও প্রতিষ্ঠা করা যায় নিজের মত। 

আসলে আমরা বড্ড একা হয়ে গেছি। আমাদের আড্ডা নেই। অকারন ঝগড়া নেই। হঠাৎ হেসে ওঠা নেই। ঠাট্টা আজ তাই 'লেগ পুলিং' বা 'বুলিইং' হয়ে গেছে। আমাদের দৌড়ে বড্ড দেখনদারী এসেছে। পারলে প্রতি সপ্তাহান্তে সাইবার ডিটক্স করুন। অনেকেই এখন করছেন। ছুটিটা পরিবারের মানুষদের সাথে বা বন্ধুদের সাথে উপভোগ করুন। আর হ্যাঁ সেই আনন্দের মুহূর্ত গুলো থাক আপনার একান্তই ব্যাক্তিগত, সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য নয়। কোনটা গোপন আর কোনটা ওপেন ফোরামে রাখব চলুন সে অভ্যাস করা শুরু করি আপনি আমি সবাই। এই ১৪২৮ হোক আমাদের সংশোধনের বছর। 

Saturday, January 9, 2021

ওদের সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং শেখাতে হয় না



রোনা আবহে সামাজিক দূরত্ব বা দৈহিক দূরত্ব বজায় রাখা আমাদের ক্ষেত্রে দুষ্কর হয়ে পড়ছে। বারে বারে লকডাউন করে নানান রকমের প্রচার করে সরকার থেকে বেসরকারি সংস্থা সকলেই জোর দিচ্ছে দৈহিক দূরত্ব বা ফিজিক্যাল ডিসটেন্সিং বজায় রাখার জন্য। নিয়ম করা হচ্ছে। নিয়ম ভাঙলে শাস্তির বিধানও জারী হচ্ছে। তবুও আনলক এরপর আর লক ডাউনের আগে বাজারে ভিড় বাড়ছে। দূরত্ব বিধীকে শিকেয় তুলে মানুষ বাঁচার রসদ খুঁজছে। কিন্তু ভাবলে অবাক হবেন মানুষ ছাড়া বেশ কিছু সমাজবদ্ধ প্রাণী অসুস্থ হলে দৈহিক দূরত্ব বজায় রাখে। প্রকৃতি তাদের শিখিয়ে দেয় এই পাঠ ।


পিঁপড়ে, মৌমাছি, বানর, বনমানুষ, বাদুড় ও ইঁদুরের ক্ষেত্রে এ ধরনের আচরণ দেখে চমকে গিয়েছেন জীববিজ্ঞানীরা। এদের আচরণ এর অনেকগুলোই হয়ত মানুষের সঙ্গে মিলবে না কিন্তু অসুস্থতা দূরত্ব বজায় রাখার অভ্যাস যে প্রকৃতি থেকেই শেখা তা হয়ত বোঝা যাবে ।

ব্ল্যাক গার্ডেন অ্যন্ট বা কালো পিঁপড়েদের শ্রমিক পিঁপড়েরা অনেক সময় মেটারহিজিয়াম ব্রুনিয়ম ফাংগাসের দ্বারা আক্রান্ত হয় । ওই ফাংগাসে আক্রান্ত হওয়ার একদিনের মধ্যেই আক্রান্ত শ্রমিক পিঁপড়েটি দিনের অধিকাংশ সময়ই তার বাসার বাইরে কাটাতে থাকে। তাছাড়া কলোনির অন্যান্য পিঁপড়েদের সঙ্গেও তার যোগাযোগ সে কমিয়ে ফেলে ।


আমেরিকান ফাউলব্রুড ব্যাকটেরিয়া আক্রান্ত হয় মৌমাছির লার্ভা। আক্রান্ত লার্ভার গা থেকে দু'ধরনের ফেরোমোনের গন্ধ পাওয়া যায়। একটি স্বাভাবিক ফেরোমন অপরটি আক্রান্ত হওয়ার কারণে একটি বিশেষ ধরনের ফেরোমোন। এই মিশ্রিত গন্ধ যেই পূর্ণাঙ্গ শ্রমিক মৌমাছিরা পায় তারা তৎক্ষণাৎ ওই আক্রান্ত লার্ভা টিকে অপসারণ করে। তাকে তুলে নিয়ে মৌচাকের বাইরে ফেলে দেয় । আমেরিকান বুল ফ্রগের ব্যাঙাচিরা একটি ভয়ঙ্কর ফাঙ্গাস ইনফেকশন চিনে ফেলতে অসম্ভব পটু । ক্যানডিডা হিউমিকোলা নামক ওই ছত্রাকে আক্রান্ত ব্যাঙাচিদের সযত্নে এড়িয়ে যায় সুস্থ ব্যাঙাচিরা ।


ওয়েস্টার্ন লোল্যান্ড গরিলারা দলবদ্ধভাবে থাকে। তাদের দলের মহিলারা বারেবারে দল পরিবর্তন করে এক দল থেকে অন্য দলে যাতায়াত করে। ২০১৯ সালের একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে এই মহিলা গরিলাদের দল পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হল ইয়জ নামক এক ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ। ওই রোগাক্রান্ত গরিলাদের মুখে এক ধরনের ঘা হয়। ওই ঘা দেখেই মহিলা গরিলা পুরুষ সঙ্গীকে ছেড়ে সুস্থতর কোন দলে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ৬০০ টিরও অধিক গরিলার ওপর গবেষণা চালিয়ে প্রাণী বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। দেখা গিয়েছে ইয়জ ব্যাকটেরিয়া আক্রান্ত পুরুষ গরিলাদের থেকে সুস্থ মহিলা গরিলারা দূরে সরে গেছে। এতেই প্রমাণিত হয় যে গরিলারা বুঝে গেছে রোগটি সংক্রামক।


শিম্পাঞ্জিদের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে পোলিও আক্রান্ত শিম্পাঞ্জিকে একঘরে করে রেখে দেয় বাকি শিম্পাঞ্জিরা। আবার আক্রান্ত শিম্পাঞ্জিটি সুস্থ হয়ে গেলে তাকে দলে ফেরত নেওয়া হয়।


ম্যানড্রিল গীবনদের দিনের অধিকাংশ সময়ই কাটে একে অপরের লোম আঁচড়ে দিয়ে। দু'বছর ধরে ২৫ টি ম্যানড্রিল গীবনকে নিয়ে চালানো একটি নিরীক্ষায় দেখা গিয়েছে পরজীবী আক্রান্ত ম্যানড্রিল গীবনদের তাদের সঙ্গীরা ততটা আদর যত্ন করছে না।

ভ্যাম্পায়ার ব্যটের বেঁচে থাকতে গেলে প্রতিদিন অন্তত এক চামচ রক্তের প্রয়োজন খাদ্য হিসেবে। পরপর তিনদিন যদি ওই রক্তের জোগান না পায় ভ্যাম্পায়ার ব্যাট তাহলে তারা মারা যায়। এরা অত্যন্ত সামাজিক প্রাণী এবং একে অপরের খাদ্য বন্টন ও গা চুলকে দিতে সাহায্য করে। কিন্তু দেখা যায় যদি কোন ভ্যাম্পায়ার ব্যাট অসুস্থ হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে তাহলে সে নিজেকে অন্য বাদুড়দের থেকে আলাদা করে রাখে এবং তাদের সঙ্গে খাবার ভাগ করে খায় না।


২০১৬ য় ইঁদুরের উপর একটি পরীক্ষা করা হয়। ব্যাকটেরিয়ার লাইপো স্যাকারাইড একটি ইঁদুরের গায়ে ইনজেকশন দিয়ে তাকে রেডিও কলার পরিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। দেখা যায় ওই ইনজেকশন এর ফলে লাইপো স্যাকারাইডের প্রভাবে ইঁদুরটি অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং ওই অসুস্থ ইঁদুরকে তার দলের অন্য ইঁদুর রা দূরে সরিয়ে না দিলেও অসুস্থ ইঁদুরটি অন্য অসুস্থ ইঁদুরদের থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে।

ইউল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এর মতে প্রাণীরা শিকার ধরা ও শিকারি প্রাণীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাদের দৈহিক গঠনে নানা রকম পরিবর্তন ঘটিয়ে কালক্রমে অভিযোজিত হয়ে বিবর্তিত হয়েছে। একইভাবে রোগ সংক্রমণের ফলে দৈহিক ক্ষতি বা মৃত্যু আটকাতেও তাদের ব্যবহারের মধ্যে নানান রকম পরিবর্তন এসেছে। আমাদের যে অভ্যাস সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা ও আইন প্রশাসন জোর করে শেখায়, প্রাণী জগতে অনেক প্রাণীই শুধুমাত্র বাঁচার তাগিদে ও পৃথিবীতে অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে সেই আচরণ অভ্যাস করে আসছে যুগ যুগ ধরে।

কেমন আছো মন ?



শটা মাস প্রায় কেটে গেল করোনাকে সঙ্গে করে। আর দু মাস পরে একটা বছর ভাইরাসের সঙ্গে ঘর। পালা করে লক ডাউন আনলকের আবর্তে ধীরে ধীরে বাড়ির বাইরে পা রেখেছে নিউ নর্মাল ভারতবর্ষ। আর পা রেখেই দেখেছে অনেকটাই বদলে গেছে তার চারপাশ, চেনা রাস্তাঘাট, অফিস, বাজার, দোকানপাট সবকিছু। বদলে গেছে তার গ্রহণীয়তা, বদলে গেছে সম্পর্কগুলোও। বদলে যাওয়া এই দিনকালে অতিমারিতে যে হয়ত সে বেঁচে 

গেছে; কিন্তু কবলে পড়ছে এক নিঃশব্দ ভয়ঙ্কর মানসিক অবস্থার। লক ডাউনে অনেকের গিয়েছে চাকরি, অনেকের বেতন সংকোচন হয়েছে কিন্তু সংকুচিত হয়নি দৈনন্দিন খরচগুলো। তার ওপর বেড়েছে বৈ কমেনি কোভিডে সংক্রমণের আশংকা। এখন তো আবার নতুন স্ট্রেইনের চোখ রাঙানি। মানুষ গুটিয়ে গেছে নিজেরই বানানো খোলসের মধ্যে। ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করেছে দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা, দিশাহীনতা, মানসিক চাপ, উদ্বেগ, অবসাদ ও শেষ পর্যন্ত ভীষণ ভাবে আঁকড়ে ধরেছে আত্মহননের প্রবণতা।

সারা দেশে করোনার সংক্রমণ প্রায় ১কোটি ৪ লক্ষেরও বেশি।  করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দেড় লক্ষের মত। এই তথ্য যতটা না উদ্বেগজনক তার চেয়েও ঢের আশংকা হল লক ডাউনের ফলে বিভিন্ন সংস্থায় কর্মী সংকোচনের ফলে সৃষ্টি হওয়া বেকারত্ব, ব্যবসার ব্যাপক ক্ষতি, ক্ষেত্র বিশেষে ব্যবসায়িক সংস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়া, আর্থিক সঙ্কট, আর্থিক মন্দা আর সামান্যতম অসুস্থতায় চাপা মানসিক উদ্বেগ। এর ফলে এমন একটা অন্ধকার গুহার মধ্যে ঢুকে পড়েছে জনজীবন যে গুহার অন্য প্রান্তে নেই কোনও সঠিক আলোর দিশা। এই অনিশ্চয়তার দোলাচলে চরম আকার নিচ্ছে উদ্বেগ। দিল্লীর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা একটি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞদের মতে যে ব্যাক্তি অতিমারির আগে হয়ত মৃদু উদ্বেগে আক্রান্ত ছিলেন এই সাড়ে ১০ মাস সময়ের ব্যবধানে দেখা যাচ্ছে তারই মধ্যে তীব্র ভাবে দানা বেঁধেছে প্রচণ্ড উদ্বেগ প্রবণতা। আর উদ্বেগ যত বাড়ছে ততই বাড়ছে নিজেকে আঘাত করা বা আত্মহত্যার ঝুঁকি।

সারা দেশের কিছু তথ্য যা চিন্তা বাড়াচ্ছে সমাজ বিজ্ঞানী ও মনোবিদদের

গুজরাটের একটি অ্যাম্বুলেন্স সংস্থা যারা শুধুমাত্র আপাতকালীন এমারজেন্সি পরিষেবা দেন ও একই সাথে মনোরোগীদের একটি হেল্পলাইন চালান তাঁদের থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এপ্রিল, মে, জুন এবং জুলাই এই ৪ মাসে তাঁরা ৮০০টি আত্মহননের প্রচেষ্টা এবং ৯০টি আত্মহত্যার ঘটনার খবর পেয়েছেন। একই সাথে ওই সংস্থার থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী লক ডাউনের প্রথম ৫ মাসে তাঁরা ১৪২টি ফোন কল পেয়েছেন সেই সব অবসাদগ্রস্ত মানুষদের থেকে যারা তাঁদের জীবন শেষ করে দিতে চান।

বেঙ্গালুরুতে আবার করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট পজেটিভ এসেছে যে সমস্ত মানুষদের তাঁদের মধ্যে জমাট হতাশায় বেড়েছে আত্মহননের প্রবণতা।

ডিপ্রেশন বা অবসন্নতা এবং অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার বা ওসিডি তে আক্রান্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ৭০% 

পানিপথে নব বিবাহিত এক দম্পতি( আভেদ ও নাজমা ) গলায় দড়ি দিয়ে শেষ করেছে নিজেদের জীবন। অথচ মাত্র একমাস আগে বিয়ে করেছিল তারা।

বাড়ি ফিরে এসে উত্তরপ্রদেশের পরিযায়ী শ্রমিক রামবাবু ও ছোটকু কাজের জন্য হন্যে হয়ে ঘোরে। কে দেবে কাজ? অতএব জীবন শেষ করে ফেলে তারা।

উত্তরপ্রদেশেরই আর একটি ঘটনা মর্মান্তিক। লক ডাউনে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায় বিবেক নামক এক ব্যবসায়ীর। অভাব, দিশা হীনতা ও উদ্বেগে বিবেক তার স্ত্রী ও তিন সন্তানকে বিষ খাইয়ে মেরে নিজেও আত্মঘাতী হয়।

দেশের রাজধানী দিল্লিতে দুই ভাইয়ের ঝুলন্ত দেহ একটি গয়নার দোকানে পাওয়া যায়। তাদের সুইসাইড নোটে তারা লিখে গেছে ব্যবসায়ে চরম মন্দা ও ক্ষতি তাই আত্মহতার পথ বেছে নিল তারা।

ওড়িশায় ৫০ বছরের একজন মানুষের ভাইপো করোনা আক্রান্ত হয়। এই খবর শোনার পর তিনি নিজের আক্রান্ত হওয়ার আশংকায় একটি কুয়োতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এতটাই সুতীব্র হয়ে উঠেছিল উদ্বেগ ও মানসিক চাপ।

এই পরিস্থিতিতে সাধারণ জ্বর বা সর্দি কাশি হলেও রোগীদের মধ্যে দানা বাঁধছে করোনায় সংক্রমিত হওয়ার ভয় ও তার সাথে জড়িত সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ। বন্ধ রোজগারের পথ, বন্ধ ছাত্রদের শিক্ষা, ভবিষ্যতে সন্তানের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি, বিবাহের চিন্তায় অন্ধকারে ভারতবর্ষ। একই সাথে চিন্তা বাড়াচ্ছে ব্যাঙ্কের ইএমআই, প্রতি নিয়ত কমতে থাকা সঞ্চয়, একই সাথে গৃহবন্দী থাকার ফলে তৈরি হওয়া মানসিক চাপ।

আশার আলোও আছে

বড়দের হচ্ছে অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার আর গৃহবন্দীত্বে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ও আবেগ হচ্ছে আহত। তাই বিশেষজ্ঞ মনোবিদরা অভিভাবকদের বলছেন শিশুদের সঙ্গে সহমর্মিতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ হতে। বিভিন্ন সংস্থা তাদের কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য নানা রকম কার্যক্রম শুরু করেছে সেগুলিতে অংশগ্রহণ করতে।

মুম্বাইতে শুরু হয়েছে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির ওপর ৩০ দিনের একটি ক্র্যাশ কোর্স । উদ্দেশ্য যাতে সাধারণ ডাক্তারবাবুরাই মানসিক স্বাস্থ্যের প্রাথমিক চিকিৎসাটা দিতে পারেন।

দেখা যাচ্ছে ৩০% কোভিড আক্রান্তরা মানসিক ডিসঅর্ডারের শিকার হচ্ছেন তাই অরুনাচল প্রদেশ সরকার হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র গুলিতে মানসিক চিকিৎসার জন্য সাইকিয়াট্রির বিভাগ খুলেছে। সেখানে রোগীদের মৃদু অনিদ্রা, উদ্বেগ ও মানসিক চাপের লক্ষণ দেখা দিলেও হচ্ছে তার চিকিৎসা।

কেরালায় জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের উদ্যোগে চালু হয়েছে হেল্প লাইন। অবসন্ন মানুষ ফোন করলে তার প্রাথমিক কাউন্সেলিং করে তার এলাকার জেলা মানসিক স্বাস্থ্য অধিকর্তাকে দেওয়া হচ্ছে পরবর্তী চিকিৎসার দায়িত্ব।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল নিজের মধ্যে চাপ জমতে না দেওয়া। সুস্থ জীবনযাপন, পরিবারের ও বন্ধুদের সঙ্গে নিজের সমস্যা নিয়ে কথা বলা। এবং মানসিক চাপ, উদ্বেগ, আশংকা বাড়লেই ডাক্তার বা হেল্প লাইনে কল করা।

হাল ছেড়ো না বন্ধু

জীবন তো একটাই এত সহজে হেরে যাবে তুমি মন? তোমার মন খারাপ হলেই বন্ধুকে ডেকে বলো "কেমন আছ?" তার কথা শোনো না একটু,  তোমার কথাও বলো তাকে। যেমন ভাবে ক্লান্ত আকাশকে সন্ধ্যে গল্প শোনায় সেভাবে গল্প করো। অনেক কষ্টতেও দেখবে ভাল লাগবেই।